অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সুফল গরিব মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 17 Oct 2020, 07:24 AM
Updated : 17 Oct 2020, 07:24 AM

বিশ্বায়নের এই কালে এক দেশের সংকট আরেক দেশকে কত বিচিত্রভাবেই না প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় বাংলাদেশের কাঁকড়া ও কুচিয়া রপ্তানির কথা বলা যেতে পারে। অনেকেই হয়তো জানেন না, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার দেড় মাস আগেই কাঁকড়া-কুচিয়া রপ্তানি খাতে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। বাংলাদেশ থেকে এই পণ্যের ৯০ শতাংশ চীনে রপ্তানি হয়ে থাকে যা থেকে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা আয় হয়। এর সঙ্গে সুন্দরবনের প্রান্তিক জেলে সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র খামারি ও খামারশ্রমিকসহ দশ লাখের ওপর মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। করোনাভাইরাস সংকটে এ বছরের জানুয়ারি থেকেই কাঁকড়া-কুচিয়া আমদানি বন্ধ করে দেয় চীন। সেপ্টেম্বরে এসেও তাদের বাজার খোলেনি। ফলে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, সঙ্গে জীবিকা হারিয়েছেন কয়েক লাখ প্রান্তিক মানুষ।

অতিমারীর ধাক্কায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলো যেখানে রোগটি সামাজিকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী দেশে করোনাভাইরাসের অভিঘাতে স্থায়ীভাবে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা ৭০ লাখ যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। কৃষি উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও পরিবহন সমস্যার কারণে এ খাতেও নানাভাবে তার প্রভাব পড়েছে।

এদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই স্তম্ভ জনশক্তি এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে বাড়তি সমস্যা যুক্ত করেছে কোভিড-১৯। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুটি খাতেই সংকোচনের আলামত দেখা যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রবাসআয়ের সর্ববৃহৎ উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আর্থিক সামর্থ্য কমছে যার ফলে তাদের জনশক্তি আমদানিও হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে, সাভারে ইতিহাসের বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনাটি ঘটার পর থেকে তৈরি পোশাক শিল্পেও বড় ধাক্কা লেগেছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় অনেক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বহু কর্মী কাজ হারিয়েছেন। অন্যদিকে কারখানার পরিবেশ নিরাপদ করার লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে বিশেষ উদ্যোগ চালানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই উদ্যোগ সম্প্রতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল এবং এই শিল্পখাত নতুন করে বিপুল পরিমাণ অর্ডার পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই অতিমারীর কবলে পড়ে বিশ্ব। ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ায় ক্রেতা দেশগুলো থেকে তিনশ কোটি ডলারের অর্ডার বাতিল করা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত ৪৫.৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে যার ফলে এ শিল্পে নিয়োজিত ৪০ লাখ শ্রমিকের (যার ৮০ শতাংশ নারী) মধ্যে ১০ লাখ স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে ছাঁটাই হয়েছেন।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মুখে দেড় থেকে দুই লাখ প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে আটকা পড়েছেন। আবার প্রবাস গমনেচ্ছু প্রায় এক লাখ কর্মী সব প্রক্রিয়া শেষ করেও এই পরিস্থিতিতে বিদেশে পাড়ি জমাতে পারছেন না।

করোনার ধাক্কায় বিশ্বে 'নতুন দরিদ্র' বলে একটি পরিভাষাও চালু হয়ে গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় দারিদ্র্যহার বেড়ে ২৯.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা আগের অর্থবছরে ছিল ২০.৫ শতাংশ। সেই হিসাবে চার কোটি ৯৪ লাখ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। বিশেষজ্ঞদের আরো মত অতিমারীর ধাক্কায় গ্রামীণ দারিদ্র্যের চেয়ে নগর দারিদ্র্য বাড়বে।

তবে অতীতের মতো এবারও বাংলাদেশের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অতিমারীর মোকাবেলা করছে। দুমাসের সাধারণ ছুটির সময় জীবন-জীবিকার বিপুল ক্ষতি পোষাতে সরকার সারা দেশে খাদ্য পৌঁছানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কৃষিপণ্যসহ জরুরি সেবা ও পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। বেসরকারি সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসে। মার্চের শেষ থেকেই বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক মাঠপর্যায়ের বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়োজিত করে ঘরে ঘরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবার্তা দেওয়ার পাশাপাশি মোবাইল মানির মাধ্যমে সারা দেশে সাড়ে তিন লাখ পরিবারের কাছে জরুরি অর্থসাহায্য পৌঁছে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোও যেমন এগিয়ে এসেছে তেমনি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এবং গাজীপুর-সাভারকেন্দ্রিক করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবী কমিটির মতো অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে দরিদ্র মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় যুব-তরুণরা এগিয়ে এসেছেন করোনাভাইরাসে প্রাণ হারানো ব্যক্তির সৎকারে।

অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে ওঠার লক্ষ্যে গত ৩১ মার্চ অফিস-আদালত খুলে দেওয়ার পর থেকে কর্মক্ষেত্রে চাঞ্চল্য ফিরে আসতে শুরু করেছে। রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস কারখানাগুলো খুলতে শুরু করায় অনেক শ্রমিক চাকরি ফিরে পেয়েছেন। প্রবাসী কর্মীরা সৌদিসহ বিভিন্ন দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। দরিদ্র সাধারণ মানুষের কাজের সুযোগ ধীরে ধীরে বাড়ছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস মিলছে। এই জুন মাসে সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অর্জিত হয়েছে ৫.২৪ শতাংশ। এই অর্জনের পেছনে কৃষি উৎপাদন, প্রবাসআয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (চার হাজার কোটি ডলারের বেশি) তিন ক্ষেত্রে রেকর্ডের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকার চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য জিডিপি নির্ধারণ করেছেন ৮.২ শতাংশ, যা বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস থেকে বেশ খানিকটা বেশি। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে চলতি অর্থবছর ১.৬ শতাংশ হারে জিডিপি অর্জিত হবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল এর ব্যাখ্যায় জানিয়েছেন, অর্থবছরের আরো নয় মাস বাকি রয়ে গেছে যে সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশ ভালভাবে কাটিয়ে উঠতে পারবে।

অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গা হওয়ার পেছনে সরকারের এক লাখ টাকারও বেশি আর্থিক প্রণোদনার বড় ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে শিল্পঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা (এর পাঁচ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য), রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা ও প্রবাসফেরতদের জন্য ২০০ কোটি টাকার সহজ শর্তের ঋণ এবং নিম্নআয়ের মানুষ ও কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, এই অর্থ যদি প্রকৃত উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না হয় তবে তা মূল্যস্ফীতি ঘটাবে আর তার ফলে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে।

নতুন বাস্তবতায় আমাদের অর্থনীতির চাঙ্গাভাব দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে হলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি অর্থনীতির জন্য বিদ্যমান হুমকিগুলোকে মোকাবেলা করতে হবে এবং অদূরভবিষ্যতে যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ আকারে দেখা দিতে পারে তা সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে উপযুক্ত নীতি ও পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখতে হবে। তৈরি পোশাক ক্রেতা দেশগুলোতে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ যদি শুরু হয় তাহলে আবার মন্দার কবলে পড়বে এই শিল্প। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙ্গা না হলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতে আগের প্রবাহ নিয়ে আসা কঠিন হবে। এই অবস্থায় রপ্তানিপণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও জনশক্তি রপ্তানির নতুন বাজার খুঁজে বের করার সরকারি নীতিমালায় ব্যাপক জোর দেওয়া প্রয়োজন।

কোভিডের নতুন বাস্তবতায় অনেক খাত ও জীবিকা হয়তো আগের মতো উপার্জনের সুযোগ দেবে না। আবার অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা ও পাঠানোর মতো কিছু যুৎসই ব্যবসা এই সময় অনেকটাই এগিয়ে গেছে, যা অনেক তরুণের জন্য আয়ের সুযোগ এনেছে। অনেক মানুষ গ্রামে ফিরে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে শাকসবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়েছে ফলে এই ব্যবসা থেকে আয়ের সুযোগও বেড়েছে। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ফেসমাস্কের মতো নতুন বাজারচলতি পণ্য বানিয়ে বিক্রি করতে লেগে গেছেন। অর্থায়ন খাতে ডিজিটাল ফাইনান্সিং-এর আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে বিস্তারের সুযোগ এসেছে কারণ সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সুফল দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানো গেলে তবেই তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে। ২০১০ সালের জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের ৮৭ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে জিডিপিতে যার অবদান ৪০ শতাংশ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের যাত্রায় এই খাতটিতে পর্যাপ্ত পুঁজি, দক্ষতা উন্নয়নসহ সব দিক থেকে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হলে উন্নয়নের ফল দীর্ঘস্থায়ী হবে। পাশাপাশি, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, প্রবাসফেরত এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যাতে সঠিক মানুষটির কাছে পৌঁছায় এবং যথাযথ ব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করতে সরকার তৃণমূলে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করতে পারে।

নারীর কর্মসংস্থানও এক্ষেত্রে প্রধানতম বিষয়গুলোর একটি। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নারীর মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো থেকে বিরাট সংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় নারীর কর্মসংস্থানের ওপরও যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।