বঙ্গমাতার জন্মদিন

আনিসুর রহমান
Published : 8 August 2020, 10:03 AM
Updated : 8 August 2020, 10:03 AM

আজ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। তিনি ১৯৩০ সালের এই দিনে জন্মেছিলেন। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৯০।

শুরুতেই ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে আমার স্কুলজীবনের একটি ঘটনার কথা বলে নিতে চাই। আমি টাঙ্গাইলের মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। সময়টা সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদের শাসনামল। পাঠ্যপুস্তকে আমরা খণ্ডিত ইতিহাস পড়ার সুযোগ পাই। আমাদের ইংরেজি ব্যাকরণ যা ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, পড়াতেন জলিল স্যার। তার পুরো নাম শেখ মো. আবদুল জলিল। তিনি ইংরেজি ব্যাকরণ পড়ালেও প্রায় ক্লাসেই সময় বের করে ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ টেনে আমাদের গল্প শোনাতেন। তার আলাপের অনেকটা জুড়ে থাকত বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা। তার গল্পগুলো আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম।

ওই শৈশব-কৈশোরে মনে মনে প্রশ্ন উঁকি দিত, স্যার ইংরেজি পড়াতে এসে ইতিহাসও কেন পড়ান? পরে একটু বড় হয়ে উপলব্ধি করেছি, জলিল স্যার সতর্ক ছিলেন, পাঠ্য বইয়ে খণ্ডিত ইতিহাস পড়ে আমরা যেন ইতিহাস সম্পর্কে অপূর্ণাঙ্গ ধারণা নিয়ে বেড়ে না উঠি।

আমার শৈশবকালে হাট-বাজারে দোকান সাজিয়ে নানা দেশের সুন্দর সুন্দর পোস্টার বিক্রি হতো। জলিল স্যারের ইতিহাস নিয়ে নানা গল্প শুনে ইচ্ছে হল বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি কিনে আনব। না, পোস্টারের দোকানে বঙ্গবন্ধুর ছবি পেলাম না। তার সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেছার ছবি সম্বলিত পোস্টার পাব সেও তো দূরহ বিষয় ওই দিনে।

জলির স্যারের ইতিহাস বিষয়ক আলাপে বঙ্গমাতার কথা তখনও বিশদ কিছু বলেননি। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সম্ভবত চায়ের দোকানের কোনো এক আড্ডা থেকে বঙ্গবন্ধু আর ওনার সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সম্পর্কে কিছু কথা কানে এসেছিল। যা শুনে খটকা লেগেছিল। বঙ্গমাতা সম্পর্কে তখনও তেমন কিছু না জানলেও মনে মনে হোঁচট খেলাম। পরের দিন স্কুলে গিয়ে মধ্যাহ্ন বিরতিতে জলিল স্যারের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গমাতা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। স্যার আমার কথা শুনে, হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন, কিছু একটা ঘটেছে। স্যার শুরুটা করেছিলেন এইভাবে-

বঙ্গবন্ধু,

ওনার সহধর্মিনী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব,

তাদের পরিবার সম্পর্কে কী জানে মানুষ? কতটা জানে?

জেনে রাখ- বঙ্গবন্ধু হলেন এই দেশের প্রতিষ্ঠাতা। রুচি ও সংস্কৃতির দিক থেকেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত মার্জিত ও উচ্চমানের। ওনার সহধর্মিনীও ছিলেন তাই।

বঙ্গবন্ধু তো রাজনীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে, দেশের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়িয়েছেন। বেশির ভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। পারিবারিক ঝড় ঝক্কি বঙ্গমাতাই সামাল দিয়েছেন। বঙ্গমাতা পেছন থেকে প্রেরণা দিয়েছেন বলেই বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্পর্কে কেউ কেউ না জেনে, আবার কেউ রাজনৈতিক কারণে নানা কথা বলে। ওরা শিক্ষার কথা বলে! জেনে রাখ, বঙ্গবন্ধু দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী দুই জন মেধাবী ছেলের সঙ্গে। শেখ হাসিনার স্বামী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ রেহানার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক। কী বুঝলি? বঙ্গবন্ধু যেমন মহামানব ছিলেন, তার সহধর্মিনী বঙ্গমাতাও তাই। স্বাধীনতার পক্ষের সরকার যদি কোনোদিন কায়েম হয়, সব মিথ্যাচার বন্ধ হবে। জলিল স্যারের এই আশাবাদ ছিল আজ থেকে তিন দশক আগে। স্যার এখন অবসর জীবন যাপন করছেন।

এই তিন দশকে দৃশ্যত অনেক মিথ্যাচার বন্ধ হলেও মিথ্যাচারকারীরা পোশাক আর বুলি বদল করে স্বাধীনতার পক্ষের কাফেলায় বড় বড় জায়গা দখল করেছেন। কিন্তু বঙ্গমাতার ব্যক্তিত্ব, বঙ্গমাতার মহিমা, বঙ্গমাতার অবদান কি আমরা মূল্যায়ন করতে পেরেছি? আমার তো খুব একটা মনে পড়ে না শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়ের কারো মুখ থেকে বঙ্গমাতা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা এমনকি আমাদের বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, পণ্ডিত, অধ্যাপকদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য লেখা বা মূল্যায়ন যেখানে বঙ্গমাতার অবদান উঠে এসেছে। এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অল্প কয়েকজন। আমার জানা মতে সুফিয়া কামালের স্মৃতিচারণ এবং ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, এবিএম মুসা, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ এবং শেখ হাসিনার লেখাজোখায় বঙ্গমাতা সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়। তবে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে বঙ্গমাতা সম্পর্কে তার জীবনের প্রথম দিকের কিছুটা আমরা জানতে পারি। বঙ্গবন্ধুর কারাগার রোজনামচাতেও বঙ্গমাতার কথা আছে।

উপনিবেশ উত্তর আধুনিক ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তার সহধর্মিনী কস্তুরবার প্রসঙ্গ, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কমলা নেহরুর কথা, চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে তার সহধর্মিনী বাসন্তী দেবীর উল্লেখ; এমনকি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে উইনি ম্যান্ডেলার নামের উপর যতটা আলো ফেলা হয়েছে, ইতিহাসে সেই ভাবে আমরা বঙ্গমাতার অবদান মূল্যায়ন এখনো করিনি।

'ভারতমাতা' অভিধা কস্তুরবার সঙ্গে যুক্ত হয়নি। ভারতমাতা বলতে দেশ ভারতকেই বোঝায় কেবল। তেমনি জিন্নাহর স্ত্রী রতনবাই জিন্নাহ নামের সঙ্গে পাকিস্তান মাতা যোগ হয়নি। তবে ব্যতিক্রম এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, এই দিকে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামের সঙ্গে 'বঙ্গমাতা' অভিধাটি আমরা তার জন্যে যথাযথ নির্ধারণ করতে পেরেছি। এই অভিধা একান্তই তার প্রাপ্য।

ভারত মাতা বলতে দেশ ভারতকে এবং পাকিস্তান মাতা বলতে দেশ পাকিস্তানকে বোঝায় ঠিক। কিন্তু বঙ্গমাতা বলতে দেশ বঙ্গকে নয়, ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেই বোঝায়। এই সম্মান বা অর্জন তার অবদান আর বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে একীভূত। এখানে একটা বিষয় আমি পরিষ্কার করতে চাই, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী হবার বদৌলতে কেবল বঙ্গমাতা হননি, বঙ্গমাতা একটি শব্দ বা পদবাচ্য যা বেগম মুজিবের আত্মত্যাগ প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে তার নিবিষ্ট জড়িয়ে থাকার স্বীকৃতির সঙ্গে এক্কেবারে মানানসই। অভিধানে 'বঙ্গমাতা' পদবাচ্যটি কেবল তার জন্যে নির্ধারিত এবং প্রবর্তিত। বাঙালি মায়ের চিরন্তন ছবি তিনি। কোনো জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের ইতিহাসে এরকম মহীয়সী ব্যক্তিত্ব দ্বিতীয়টি আমাদের জানা মতে নাই।

এই পর্যায়ে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং এবিএম মুসার বিবৃত স্মৃতিচারণ থেকে দুয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। তাহলে আমাদের জন্যে আরো পরিষ্কার হবে 'বঙ্গমাতা' অভিধার তাৎপর্য আমরা মর্মে উপলব্ধি করতে পারব।

১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আট দলীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ রাওরালপিন্ডি পৌঁছান। নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ, জুনিয়র সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এইচ এম কামরুজ্জামান, ময়েজ উদ্দিন আহমদ। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে ছাড়া গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান।

যে কারণে, ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইবুনালের বিশেষ অধিবেশন আহবান করা হয়েছে। উক্ত কোর্টের সম্মতিতে শেখ মুজিবকে প্যারোলে (সাময়িকভাবে মুক্তি দিয়ে) রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিতব্য গোলটেবিল বৈঠকে নেয়ার জন্য। একই দিনে ড. ওয়াজেদ মিয়া তার গাড়িতে করে শাশুড়ি ফজিলাতুন্নেছা, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর ফুফাত ভাই মোমিনুল হক খোকাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট অবস্থিত ট্রাইবুনাল কোর্ট অফিসের নিকটে পৌঁছান। এর মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীপক্ষের এক আইনজীবীর কাছ থেকে বেগম মুজিব জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। বেগম মুজিব খবরটা শুনে ক্ষুদ্ধ হন।

একদিকে দুই একজন আওয়ামী লীগ নেতা এবং দুই জন সাংবাদিক সংবাদ সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী এবং ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নেয়ার জন্যে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেগম মুজিব ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন বাংলার মানুষের মনের ভাষা কী? তার স্বামী শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পশ্চিমা সামরিক সরকারের হাতে নাই। একই সঙ্গে তিনি তার স্বামীর মানসিক দ্বন্দের কথাও অনুমান করতে পেরেছিলেন। তিনি এই দ্বিধা আর দ্বন্দ থেকে উদ্ধার করার জন্যে স্বামীর কাছে বার্তা পাঠালেন। মুসা ভাই যেভাবে লিখেছেন, তা হুবহু উল্লেখ করছি, "হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন; কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে আসবেন না।"

একবার ভেবে দেখুন, কী বড় বাঁচাটা না বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালি জাতিকে বঙ্গমাতা বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

প্রায় একই রকম দ্বিধা আর মানসিক দ্বন্দ ছিল ৭ মার্চের ভাষণের আগে। এই সময়ও বঙ্গমাতা দৃঢ়তার সঙ্গে তার স্বামীকে ঈঙ্গিত দিলেন, কে কি বলল বা পরামর্শ দিল- তার চেয়ে বড় কথা দেশের জনগণকে তুমি জানো এবং বুঝো। উপস্থিত বুদ্ধিতে মনে যা আসে তাই বলে এসো। বাকিটা ইতিহাস! সাতই মার্চের ভাষণ আজ গবেষণার বিষয়, জগতের বিস্ময়।

এখানেই শেষ নয়; তিনি দলের নানা পর্যায়ে কর্মীদের বিপদে আপদে খোঁজখবর নিতেন। ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছিল বাঙালির ঠিকানা। এক 'বাঙালি মা পানের বাটা নিয়ে বসে আছেন। তার স্নেহের পরশ মাখা দরদি হাতের পানের খিলি আর খাবার খেয়েছেন কত বাঙালি মায়ের ছেলে, তাও এক ইতিহাস। তিনি এক অবাক করা মা।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তখনও প্রত্যাবর্তন করেননি। বঙ্গমাতা মেয়ের জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে পাঠালেন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে খবর নিতে। প্রধানমন্ত্রী জানালেন, উনি ৩২ নম্বর গিয়ে বঙ্গমাতার সঙ্গে দেখা করে তার সঙ্গে আলোচনা করেই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের দিনক্ষণ ঠিক করবেন। হয়েছিলও তাই।

বাংলার জন্মের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এরকম অনেক দিন আর ক্ষণের নিভৃত আড়ালের মানুষটি বাঙালির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী, মুক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী, মহিয়সী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

আমাদের সকলের বঙ্গমাতা।