শেখ কামাল: মৃত্যুহীন প্রাণ এবং ক্ষণজন্মা প্রতিভা

এম এম ইমরুল কায়েস
Published : 5 August 2020, 01:43 PM
Updated : 5 August 2020, 01:43 PM
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের জন্মের সময়ে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ব্যস্ততায় ছিলেন পরিবার ও বাড়ি থেকে দূরে। বাঙালির মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে জাতির পিতার জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে কারাগারে রাজবন্দি হিসেবেও।
আর তাই ১৯৪৯ সালের ৫ অগাস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ কামাল শৈশবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যস্ততার জন্য বাবার আদর-স্নেহের স্পর্শ তেমন পাননি। শেখ কামালের শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' এর ২০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর 'আব্বা' 'আব্বা' বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাসিনাকে বলছে, 'হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।' আমি আর রেণু দু'জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, 'আমিতো তোমারও আব্বা।' কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইলো। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না।
প্রতিভাবান তরুণ শেখ কামাল ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট শাহাদাতবরণের সময় তিনি স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
শহীদ শেখ কামাল  ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। পাকহানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কস্থ বাসভবন আক্রমণ করার আগের মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি সরাসরি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর 'এডিসি' হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ক্যাপ্টেন শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন।
'আবাহনী ক্রীড়া চক্র' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে আধুনিক ফুটবলের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন শেখ কামাল। তিনি প্রথম বিদেশি ফুটবল কোচ এনেছিলেন দেশে। ক্রিকেটও খুব প্রিয় ছিল তার, ভাল ফাস্ট বোলিং করতেন। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে শেখ কামাল প্রথম বিভাগের লীগে খেলেছেন সেসময়। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্কেটবল দল ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও শেখ কামালের ছিল দীপ্ত পদচারণা। আইয়ুব খান দেশে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে শেখ কামালও অন্যদের সঙ্গে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ছায়ানটের যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে নিয়মিত সেতার বাজানো শিখতেন। কেবল নিজেই সংগীতচর্চা করেননি, একইসঙ্গে অন্যদেরও উৎসাহিত করেছেন সমানভাবে।
'স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী' নামের সঙ্গীত সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তিনি। নিয়মিত মঞ্চনাটক করতেন শেখ কামাল, কলকাতার মঞ্চেও অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। স্বাধীনতার পর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আন্দোলনের মাধ্যমে নাট্যাঙ্গনে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, সেখানেও তিনি ছিলেন অগ্রণী। বিখ্যাত নাটকের দল 'ঢাকা থিয়েটার' এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
বহুমাত্রিক গুণের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে শেখ কামাল ছিলেন উদার এবং বিনয়ী। দেশের জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পুত্র হওয়া সত্বেও তার ভেতরে কোনও অহমিকার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়নি। খুব দ্রুত সময়ে অন্যকে আপন করে নিতে পারার এক অসাধারণ গুণ ছিল তার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী, দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামাল বিবাহ করেন। খ্যাতনামা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল সারাদেশে 'গোল্ডেন গার্ল' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাতের মেহেদির রঙ না মুছতেই স্বামীর সঙ্গে তিনিও ১৫ অগাস্টের ভয়াল রাতে শহীদ হন।
নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলী ছিল তরুণ শেখ কামালের। স্বাধীনতার পর যখন চারিদিকে আনন্দের জোয়ার, তখন তিনি অবতীর্ণ হন দক্ষ এক সংগঠকের ভূমিকায়। গানের আসরে, নাটকের মঞ্চে ছিল তার সপ্রতিভ উপস্থিতি। খেলার মাঠে ছিলেন অগ্রণী।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী এই ক্ষণজন্মা তরুণ জানতেন কী করে সংগঠনকে প্রাণবন্ত রাখতে হয়।
শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়া ও সংস্কৃতি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। মহান মুক্তিযুদ্ধ, ছাত্ররাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ- সর্বত্র ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। শেখ কামালের অকালমৃত্যুতে দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, রাজনীতিতেও এক অসামান্য ও অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়।
ঘাতকের বুলেট শেখ কামালের শারীরিক মৃত্যু ঘটিয়েছে সত্য, কিন্তু তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আছেন এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে, ক্রীড়ায় ও সংস্কৃতিতে। আজ তার ৭১তম জন্মবার্ষিকীতে এই অসামান্য সংগঠক, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।