রাষ্ট্রের উদাসীনতায় মানুষ নিয়তিবাদী!

রাশিদুল রাশেদ
Published : 1 August 2020, 05:29 PM
Updated : 1 August 2020, 05:29 PM

এই ঘোর করোনাকালেও মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে না হাসপাতালে! মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কপালে যা আছেএই ভাবনা নিয়ে ঘরে থাকছে। প্রাণের প্রতি কেমন মায়া মানুষের?

এই মুহূর্তে হাসপাতালে না যাওয়ার হাজারো যুক্তিও আছে। অতীত কেলেংকারির প্রসঙ্গ না হয় বাদ থাকুক এ যাত্রায়। জেকেবি, রিজেন্ট, সাহাবউদ্দিন মেডিকেলের কেলেংকারি এতটাই টাটকা যে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষ এখন আসলে ভীতসন্ত্রস্ত। একে তো সত্যিকার অর্থে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের চিকিৎসা নেই, তার ওপর দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার একের পর এক কেলেংকারির যেসব খবর আসছে, তাতে শ্রমেঘামে অর্জিত পয়সা খরচ করে ভূয়া রিপোর্ট পাওয়ার চাইতে না পাওয়া ভালো। কুচিকিৎসা পাওয়ার চেয়ে চিকিৎসাহীন থাকা বা বিনা চিকিৎসায় মরাও ভালো। যেহেতু মরতে একদিন হবেই, তাহলে কুচিকিৎসা নিয়ে মরার দরকার কি? বিজ্ঞানবেষ্টিত আধুনিক যুগে এইসব যুক্তি আর নিয়তিবাদী চিন্তার মধ্যে মানুষ খুঁজে নিতে চাইছে একটু স্বস্তি।

আসলে অন্যায়, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এই রাষ্ট্রকে জেঁকে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। দুর্নীতির শেকড় মাটির এতটা গভীরে চলে গেছে যে, এক ঝটকায় উপড়ে ফেলার অবস্থায় নেই। বিচারহীনতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও এই দেশে প্রকট। কদিন আগে সদরঘাটে ময়ূর লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিংবার্ড নামের ছোট লঞ্চে থাকা ৩৪ জন মানুষের প্রাণ ঝরে গেলো চোখের পলকে। এই আধুনিক যুগে, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নৌপরিবহন কাঠামো কতটা দূর্বল হলে ঝড়ঝঞ্ঝাহীন পরিস্থিতিতে, কূলে ভেড়ার সময় এমন কাণ্ড হতে পারে, অকালে ঝরে যায় এতগুলো তরতাজা প্রাণ, সেগুলোর হিসেব করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।

এমন অন্যায়, অশ্লীলতার উদাহরণ আমাদের চারপাশে আছে ভুরিভুরি। প্রতিদিনই ঘটছে চোখের সামনেও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ২১ জুলাই প্রতিবেদন এসেছে 'ভাতিজিকে ধর্ষণ মামলায় জামিন পেয়ে মোটর শোভাযাত্রা'-শিরোনামে। কুমিল্লার এই ঘটনা এখনও বিচারাধীন কিন্তু যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই সোহেল মিয়ার মোটর শোভাযাত্রা রীতিমতো আতঁকে ওঠার মতো বিষয়। প্রশ্ন জাগে, ধর্ষিত ওই মেয়েটির আশ্রয় হতে পারছে কি রাষ্ট্র? নাকি 'কপালে ছিল', অনিশ্চয়তায় এমন বিশ্বাস জন্মাবে তার কোমলমতি মনে? 

করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে পুলিশ দারুণ 'ইমেজ' তৈরি করেছিল দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা দিয়ে। সেই পুলিশের এক এসআই চট্টগ্রামের এক কিশোরের আত্মহত্যার জন্য দায়ী বলে অভিযোগ। 'মারুফকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন এসআই হেলাল: তদন্ত কমিটি'-বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রতিবেদন পড়লে পুলিশ নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়বে না সাধারণ মানুষ? অথচ বিপদে-আপদে এই পুলিশের কাছেই যাওয়ার কথা মানুষের। সেখানেও এমন বিপত্তি!

গত ২৩ জুলাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদন ছেপেছে 'মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস করে কোটিপতি: সিআইডি' শিরোনামে। এর কদিন পর প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন অন্তত চার হাজার শিক্ষার্থী। এরাই পাশ করে এসে একদিন ডাক্তার হবে, মানুষকে চিকিৎসা দিবে। ফাঁস হওয়া চিকিৎসকরা রোগীদের যে 'ফাঁসিতে' চড়াবেন, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকার সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে আমজনতা চিকিৎসদের সেবার চেয়ে নিয়তির কাছে নিজেকে সপে দেওয়া নিরাপদ মনে করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে হানা দিয়েছে বন্যা। মহামারী সামাল দিতে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা দিতে। সেগুলোও শতভাগ পৌঁছাচ্ছে না মানুষের দ্বোরগোড়ায়। বন্য থেকে জান-মাল রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এখনও আধুনিক হয়নি। যতটুকু নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে ফাঁক-ফোকর আর দুর্নীতির ইয়ত্তা নেই। বাঁধ ডিঙিয়ে বানের পানি ঘর-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মানুষ, পশু সবই যাচ্ছে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই দুর্দিনেও ত্রাণ নিয়ে নানা অভিযোগ, চুরি, কেলেংকারির খবর আসছে প্রতিদিন। দুঃসময়ে রাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়িয়ে থাকা মানুষের পায়ের নিচে মাটি পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই।

আসলে চোরাকারবারী, ঋণখেলাপী, মানবপাচারকারী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, ত্রাণ-লুটেরা, চুরি-ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজি, মনোনয়ন বাণিজ্য, ঘুষখোর, ভূমিদস্যু, রাজনৈতিক সুবিধাবাদী, প্রতারক- এমন হাজারো নীতিহীন 'পেশাজীবী' আমাদের চারপাশে। উঁকি দিলেই দেখা মেলে। চারিদিকে যেভাবে অন্যায়, অনিয়ম অব্যবস্থাপনা সংগঠিত হচ্ছে, তাতে বোধকরি আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়াটা অনেকাংশে দায়ী। কেননা, একমাত্র আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলেই যেকোনও রাষ্ট্রে সুশৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং অন্যায়, অনিয়ম সংঘঠিত হয় খুব কম। তা হয়নি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নোকের ডগায় বসে এদের বহাল তবিয়তে থাকা, সত্য ও সাধারণের ওপর ছড়ি ঘোরানো, মিছিল-মিটিং-টেবিল বৈঠকে লম্বা লম্বা কথা বলা, পরামর্শ বিলিয়ে বেড়াতে পারে এরা। এবং এগুলোই সোজা কথায় সমাজ রাষ্ট্রের অবক্ষয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অন্যায়ের পোষণের খণ্ড খণ্ড চিত্র। 

দীর্ঘদিন ধরে এগুলো দেখতে-দেখতে, বিচার না পেতে-পেতে সয়ে গেছে সাধারণ মানুষের। তাই এসব অন্যায়, অনিয়ম অব্যবস্থাপনা কারও কারও কাছে চরম আতংকের হলেও সাধারণ মানুষ আজকে এসব নিয়ে তেমন আতংকগ্রস্ত হয় না। রাষ্ট্রের উপেক্ষায়, উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে যেহেতু দুর্নীতিগ্রস্থ, লুটেরা শ্রেণি অন্যয়কে স্বাভাবিক রীতি বানিয়ে ফেলেছে এবং শেষ আশ্রয় হিসেবে রাষ্ট্রকে যেহেতু সাধারণ মানুষ পাশে পাচ্ছে না, সেহেতু তারা এই অন্যায়অবিচার, অনাচারদূরাচারের শিকার হওয়াটাকে ধরে নিয়েছে নিজেদের নিয়তি হিসেবে! গ্রামের মানুষের ভাষায় কথাটা এরকম-যা আছে কপালে!

'নিয়তি' বা "নিয়তিবাদ" শব্দটি দার্শনিক আলোচনায় বেশ প্রাণবন্তভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে ধর্ম দর্শনের আলোচনায় ব্যাপকভাবে বিস্তার করে লাভ চলছে বটে। সাধারণত লক্ষ্য করা যায় যে, স্বাধীন ইচ্ছা যখন অকার্যকর হয়ে থাকে, তখন মানুষ নিয়তির উপর আস্থা রাখতে স্বচেষ্ট হয় এবং নিয়তিকে নির্বিঘ্নে মেনে নিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত করে থাকে। 

বাঙালির সন্তান দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়তির দোহাই-এর বিরুদ্ধে করেছিলেন সাহসী উচ্চারণ। আরও ছিলেনঅক্ষয়কুমার দত্ত, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং এদের ওস্তাদ ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শিক্ষক ডিরোজিও। সাধারণ মানুষকে বাস্তবতা শেখানো, বাস্তবতার সাথে পরিচয় করাতে সদা সচেষ্ট ছিলেন এসব বুদ্ধিমান মানুষ। কিন্তু আজ সৃজনশীল, জ্ঞানী ও গুণী মানুষের মধ্যে অনেকেরই মুখ লুকিয়ে থাকার প্রবণতা বেশি। অথচ রাষ্ট্রকে পথ দেখানোর দায়িত্ব এই শ্রেণির উপরও বর্তে।

যদিও ঢালাওভাবে সবকিছুকে মেনে নেওয়া এক ধরনের মনোরোগ হিসেবে মনে করা হয়। তবুও মনোরোগের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষ নিয়তিকে নিশ্চিত মেনে নিয়েছে। যা সুচিন্তা তো দূরের কথা, মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাকে রীতিমতো ব্যাহত করছে । মানসিক দৈন্যতা তৈরি করছে, যা আর্থিক দৈন্যতার চেয়ে আরও বেশি নিকৃষ্ট। মানসিক এই দৈন্যতা দূর করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যেটা এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও রাষ্ট্র পালন করতে পারেনি শতভাগ। কিংবা কতটুকু পেরেছে, তা রাষ্ট্রকেই খতিয়ে দেখতে হবে।

পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা প্রতিকূলতায়, সীমাবদ্ধতায় এবং রাষ্ট্রের উপেক্ষায় অসহায় বাঙালির নিয়তিবাদী হয়ে ওঠা নিয়ে আলাপচারিতায় সেদিন হঠাৎ করেই কবিতার ছলে মনে হলো লিখে ফেলি-

অথচ পঞ্চাশ বছর বয়স তোমার!

নীতি রাজ্যে পরিণত হওয়ার কথা!

কিন্তু নৈতিক সংকট কেটে উঠতে,

ইচ্ছা হবে কবে তোমার?