ঘাতক মঈনুদ্দীনকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার এখনই সময়

জুয়েল রাজ
Published : 1 August 2020, 05:09 PM
Updated : 1 August 2020, 05:09 PM

গত ১৬ জুলাই, নাগরিকত্ব বাতিল সংক্রান্ত মামলায় সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দেওয়া 'ব্রিটিশ নাগরিক' শামীমা বেগমের পক্ষে একটি আদেশ দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের  আপিল আদালত। ওই আদেশে আদালত বলেছেন, যুক্তরাজ্য সরকার শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই  লড়তে তিনি ব্রিটেনে ফিরতে পারবেন। 

একই দিনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে ব্রিটেনে। মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে আদালত কতৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের খলনায়ক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন দেশটির  হোম সেক্রেটারি প্রীতি প্যাটেলের বিরুদ্ধে ৬০ হাজার পাউন্ডের একটি মানহানির মামলা করেছেন। এই দুইটি বিষয়ই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই ব্রিটিশ নাগরিক সম্পর্কিত এবং জঙ্গিবাদ এবং গণহত্যার অভিযোগ সম্পর্কিত।    

চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের রিট গত মাসে ইংল্যান্ডের হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, চ্যালেঞ্জিং হেটফুল এক্সট্রিমিজম রিপোর্ট ইউরোপিয়ান প্রটেকশন রেগুলেশন লঙ্ঘন করেছে। একই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত তথ্য বেআইনিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

ওই রিপোর্টটি প্রকৃতপক্ষে প্রকাশিত হয় গত বছর অক্টোবরে। কমিশন প্রাথমিকভাবে মঈনুদ্দীনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার পর ২০ মার্চ পর্যন্ত তা সরকারের ওয়েবসাইটে ছিল। পরে এ থেকে তার রেফারেন্স সরিয়ে দেওয়া হয়। মুছে ফেলা হয় তার ব্যক্তিগত তথ্য।

ডেইলি মেইল এর  প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশ ছাড়েন মঈনুদ্দীন এবং ব্রিটেনে এসে ব্রিটিশ  নাগরিকত্ব পান। তিনি দাবি করেছেন, প্রকাশিত ওই রিপোর্ট তাকে মারাত্মক হতাশাগ্রস্ত করেছে। বিব্রত করেছে। এই অভিযোগ প্রকাশের আগে তার সঙ্গে কমিশন যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তার দাবি। তিনি আরও বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আইনজীবীরা যখন তাকে লিখেছেন, তখন তিনি আরেক দফা দুর্ভোগে পড়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন ফর কাউন্টার এক্সট্রিমিজম প্রকাশিত একটি রিপোর্টের সঙ্গে এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট। কমিশনের স্পন্সর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হলেও, আমরা এখন মন্তব্য করতে পারছি না যে, আইনি প্রক্রিয়া চলমান কিনা।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চৌধুরী মঈনুদ্দীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী  ও সরাসরি  জড়িত ছিলেন বলে আদালতে প্রমাণিত। কিন্তু অব্যাহতভাবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন। ফলে তিনি যে মামলা করছেন তাতে বলা হচ্ছে, কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজমের ডকুমেন্ট 'চ্যালেঞ্জিং হেটফুল এক্সট্রিমিজম' স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টুইটার অ্যাকাউন্টে শেয়ার করা হয়েছে। এ অ্যাকাউন্টের অনুসারী প্রায় ১০ লাখ। এই টুইটে রিটুইট করেছেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল, বিবিসির সাংবাদিক মিশাল হুসেইন, মানবাধিকার বিষয়ক ক্যাম্পেইনার পিটার ট্যাটচেল। ওই রিপোর্টে চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে অভিহিত করা হয়েছে ভয়াবহ সহিংস অপরাধের জন্য দায়ী হিসেবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ। চৌধুরী মঈনুদ্দীন অভিযোগ করেছেন তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উল্লেখ করে  হোম সেক্রেটারি তার টুইটে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি তার মানহানির কারণ হয়েছে।

ব্রিটিশ সরকারের নিশ্চয় এখন দায়িত্ব,  চৌধুরী মঈনুদ্দীনের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা। ঘাতক চৌধুরী  মঈনুদ্দীনকে ফেরানোর সুবর্ণ সুযোগটা এখানেই। এখনই সময় বাংলাদেশেকে  ব্রিটিশ সরকারের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে দেশে ফিরিয়ে নিতে যেসব বাঁধা ছিল,  সেইসব আর ধোপে  টিকবে না। প্রথমত, এতোদিন মঈনুদ্দীনের অপরাধের প্রমাণ নিয়ে যে জটিলতা ছিল, সেই জটিলতা পুরোটাই কেটে গেছে।  

বাংলাদেশের আদালতে তার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তার নামে ইন্টারপোলে দীর্ঘদিন রেড অ্যালার্ট জারি ছিল। ব্রিটেনের গণমাধ্যমে সে সময় সংবাদ হয়েছে, ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত আসামী মঈনুদ্দীনের  ব্রিটেনে বিলাসী জীবন যাপন নিয়ে।  একটি দেশের  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন স্বীকার করে নিয়েছেন বা বিবৃতি দিয়েছেন যে,  মঈনুদ্দীন একজন যুদ্ধাপরাধী,  এর পরে তো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চৌধুরী  মঈনুদ্দীনের অপরাধ  নতুন করে প্রমাণের আর  কিছু নেই। মঈনুদ্দীনকে বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি করতে  অন্যান্য বড় বাঁধা ছিল-  ইউরোপীয়  ইউনিয়ন আদালত, মৃত্যুদণ্ডের সাজা এবং বাংলাদেশের সাথে বন্দি-বিনিময় চুক্তি। ব্রেক্সিটের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন দৃশ্যপটের বাইরে চলে গেছে।   বন্দি-বিনিময় চুক্তি সমস্যা নির্ভর করবে দুই দেশের সরকারের সদিচ্ছার উপর। 

কারণ, চৌধুরী মঈনুদ্দীন ছাড়াও ৭১-এর মানবতা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে এমন অনেক ব্যক্তিই এখনো ব্রিটেনে জীবিত আছেন। এদেরকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় বলে কেউ অভিযোগ করতেও আগ্রহী হন না। চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ফেরত নিলে এমন অনকেরই পরিচয় প্রকাশ্যে আসবে। সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধী ক্ষেত্রে, দ্রুত বন্দি-বিনিময় চুক্তির উদাহরণ ব্রিটেনের আছে। কট্টর ইসলামী প্রচারক ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত  ওমর মাহমুদ ওসমান যিনি আবু কাতাদা নামে পরিচিত। ২০০০ সালে ব্রিটেনে মিলিনিয়াম উৎসবে ব্যর্থ সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, ১৯৯৮ সালে জর্ডানে বোমা হামলার অভিযোগ ছিল আবু কাতাদার বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালে আবু কাতাদাকে জর্ডানের হাতে তুলে দিয়েছিল ব্রিটেন। এবং সেটা বন্দি বিনিময় চুক্তি করেই। জর্ডানের ক্ষেত্রে যদি সন্ত্রাসী হামলার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য বন্দি-বিনিময় চুক্তি সম্ভব হয়। যুদ্ধাপরাধের মত  ভয়ংকর অপরাধ আদালত কর্তৃক প্রমাণিত  হওয়ার পরে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক সত্যায়িত হওয়ার পরেও খুব বেশি কঠিন হওয়ার কথা না।

সর্বোচ্চ সাজা নিয়ে যদি ব্রিটেন দেন-দরবার করতেই চায় সেই ক্ষেত্রে, আবু কাতাদাকে জর্ডানের হাতে তুলে দেয়ার উদাহরণ ব্রিটেনের আছে। সেই বিষয়ে চৌধুরী মঈনুদ্দীনের ক্ষেত্রে আদালতে মীমাংসিত বিষয় কিভাবে পুনর্বিবেচনা করা যায় এসব আইনি বিষয় নিয়ে আগাম ভাবতে পারেন। এবং যেহেতু তার  অবর্তমানে বা অনুপস্থিতিতে বিচার সম্পন্ন হয়েছে সেই ক্ষেত্রে  তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যায় কিনা সেটিও বিবেচ্য হতে পারে। 

১৯৯৩ সালে আবু কাতাদাকে ধরতে অভিযান চালানো হলে একটি ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে যুক্তরাজ্য পাড়ি জমান আবু কাতাদা এবং এখানে এসে রাজনৈতিক  আশ্রয় প্রার্থনা করেন। অবশ্য পরের বছরই জর্ডান সরকারের পক্ষ থেকে অবহিত হয়ে তাকে যুক্তরাজ্যের জন হুমকি বলে চিহ্নিত করা হয় এবং জর্ডানে ফেরত পাঠাতে মামলা চালু করা হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৩ সালে  জুলাইয়ে আবু  কাতাদাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে জর্ডানে ফেরত পাঠায় যুক্তরাজ্য। জর্ডানে ফেরত পাঠানো হলে তাকে নির্যাতন করা হবে না এবং মামলার বিচারকার্য নতুন করে শুরু করা হবে- এমন শর্ত জুড়ে দিয়ে যুক্তরাজ্যকে ওই চুক্তি করাতে বাধ্য করেন কাতাদা। এবং একটি মামলায় আবু কাতাদা খালাস পেয়েছেন। সবকিছু  বাদ দিলেও  যেহেতু জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্রিটেনের আইনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সুযোগ আছে সেই সুযোগটা অন্তত কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। আর চৌধুরী মঈনুদ্দীন যদি নিজেকে নির্দোষ মনে করেন, তাহলে বাংলাদেশের আদালতে সুযোগ আছে তার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে  মামলা থেকে খালাস পাওয়ার। 

চৌধুরী মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের জন্য হুমকি  কিনা?  

ব্রিটেনে কোনও চাকরির জন্য আবেদন করলেও সেখানে উল্লেখ করতে হয়, কখনো কোনও অপরাধের  জন্য পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল কিনা। কোনও লাইসেন্স নিতে হলেও সেটি উল্লেখ করতে হয়। এবং নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে তো সেটি আরো ব্যাপকভাবে খোঁজ নেওয়া হয়। চৌধুরী মঈনুদ্দীন সেখানেও নিশ্চয় প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) এর চাকরি   কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের ট্রাস্টির শপথনামায়ও মিথ্যাচার করেছেন নিশ্চয়ই । 

ব্রিটেন এবং ইউরোপে জঙ্গিদের মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ২১০৫ সালের  ১৭ ডিসেম্বর হাউজ অফ কমন্সে "মুসলিম ব্রাদার হুড রিভিউ: মেইন ফাইন্ডিং" শিরোনামে এগারো পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বারোটি দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় পরিচালিত হওয়া এই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে ব্রিটেন এবং ইউরোপে মুসলিম ব্রাদারহুড, হামাস সহ নানা ধরনের ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। যুক্তরাজ্যস্থ অন্য সংগঠনের পাশাপাশি এই দীর্ঘ সম্পর্কের অন্যতম প্রধান অকুস্থল হিসেবে বিভিন্ন মসজিদ এবং সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ব্রিটেনের অভিজ্ঞ দুইজন সরকারি আমলা স্যার জন জেনকিন্স এবং চার্লস ফার কতৃক পরিচালিত এই তদন্তে উঠে আসে কিভাবে পশ্চিমা বিশ্বের উদার অভিবাসন নীতি এবং আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে নামে বেনামে বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনের মাধ্যমে ফান্ড কালেকশন করে সেই টাকা গরিব-দুঃস্থদের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের জঙ্গি সংগঠনদের আর্থিক সহায়তা দান করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিনের 'ইসলামিক ফোরাম ফর ইউরোপ (IFE)' ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিতে খুবই সক্রিয়। পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের স্থানীয় সরকারের কিছু অংশ 'রেসপেক্ট পার্টি'- এদের দ্বারা সমর্থিত। রিপোর্টে ইসলামিক ফোরাম ফর ইউরোপ (IFE) এর সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়টিও সেখানে উল্লেখ করা হয়। উক্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর সেই সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী  ডেভিড ক্যামেরন, হাউজ অব পার্লামেন্টে তার এর লিখিত বক্তব্যে বলেন, "আমরা ইতিমধ্যে এই তদন্ত রিপোট গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়েছি এবং যথাযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছি। ব্রিটেনে বসবাস করে ব্রিটেনে অথবা বিশ্বের যেকোনো দেশে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার।" 

উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে দাওয়াতুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন। এরপর ইসলামিক ফোরাম অব ইউরোপ গঠন করেন- যাদের বিরুদ্ধে সরকারের এই প্রতিবেদনে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ফেরত নিতে এই বিষয়গুলোও কাজে দিবে নিশ্চয়।

মুসলিম কাউন্সিল অব গ্রেট ব্রিটেন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন চৌধুরী মঈনউদ্দিন। তিনি ইস্ট লন্ডন মসজিদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এরপর থেকেই ব্রিটেনের গণমাধ্যমগুলো চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ইসলামী নেতা হিসেবে উল্লেখ করে আসছে।  আদালতে  দণ্ডপ্রাপ্ত এবং মানুষ হত্যার মত অপরাধে জড়িত থাকার দায় মাথায় নিয়ে একজন লোক ধর্মীয় নেতা হয় কী করে? ব্রিটেনের ইসলাম ধর্মালম্বী সাধারণ মানুষ এবং ধর্মীয় নেতা যারা আছেন তাদের প্রতিবাদ জানানো উচিত, যাতে চৌধুরী মঈনুদ্দীনের মত ঘৃণিত  এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে আপনাদের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেওয়া না হয়।

চৌধুরী মঈনুদ্দীন, লুৎফুর রহমান বা আবু সাঈদকে নিয়ে  যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রচারের কাজটা ব্রিটেনের  মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছেন। কমনওয়েলথ অফিস,  ব্রিটেনের সরকারের উচ্চ মহলসহ সব জায়গায় তারা মানবতাবিরোধী চৌধুরী  মঈনুদ্দীনকে বাংলাদেশের হাতে ফিরয়ে দিতে দাবি জানিয়ে আসছেন। 

চ্যানেল ৪ যখন ১৯৯৫ সালে 'ওয়ার্ল্ড ওয়ার ক্রাইম ফাইল' শিরোনামে ডকুমেন্টারি প্রচার করে,  সেসময় সেই প্রতিবেদন বিস্তারিত ফাইল বাংলাদেশ সরকারকে পাঠিয়েছিল। তখনকার বিএনপি সরকার সেই ফাইল কী করেছিল বা আদৌ ফাইলটি আছে, না গায়েব হয়ে গেছে- তা কেউ জানেন কিনা জানি না। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনায় আসলে, ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শহীদ প্রফেসর গিয়াস উদ্দীনের বোন  ফরিদা বানু রমনা থানায় চৌধুরী মঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা করেছিলেন। পরবর্তীতে রমনা থানা থেকে মুন্সী আতিক নামে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঘটনা তদন্তে লন্ডন এসে ছিলেন। এবং যতদূর জানা যায়,  ফিরে গিয়ে একটা তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন। 

ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সামাজিক যে আন্দোলন দরকার, তা ১৯৯২ সাল থেকেই জোরালোভাবেই করে আসছেন। ব্রিটেনের যে সমস্ত জায়গায় এ ব্যাপারটি উত্থাপন করা যায়,  স্মারকলিপি দেওয়া যায় সেসব কাজই করা হয়েছে। দিন শেষে আসলে বিষয়টি দুই দেশের সরকারের আইনি পদক্ষেপের উপর নির্ভর করছে। 

ব্রিটেনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখা,  ওয়াকার্স পার্টি, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গণ ফোরাম, সমন্বয় কমিটি, সেন্টার ফর জেনোসাইড সার্ভিস বেলজিয়ামসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। সর্বশেষ গণজাগরণ মঞ্চ ও ওয়ার্কিং ফর জাস্টিস এর সাথে যুক্ত হয়েছে। 

ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট তালিকায় থেকেও লন্ডনে বিলাসী জীবন যাপন করছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কুখ্যাত রাজাকার চৌধুরী মঈনুদ্দীন। একাত্তর সালে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম খলনায়ক এই ব্যক্তি।

শুধু যুদ্ধাপরাধ নয়, আইএস এ যোগ দেওয়া মুসলিম তরুণ-তরুণীদের যারা উদ্বুদ্ধ করেছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে,  সেসব ধরে অনুসন্ধান করলেই হয়তো বের হয়ে আসবে আরও অনেক কিছুই। আইএস-এ যাওয়া শামীমাকে ব্রিটেন আনতে কোনভাবেই রাজি ছিল না ব্রিটিশ সরকার।  অন্যদিকে  চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে তাদের অনীহা রয়েছে বলেই জেনে আসছি আমরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের বক্তব্যের পর চৌধুরী মঈনুদ্দীনের মামলার সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে এখন। আর এই অনুকূল সময়েই সরকারকে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি করতে হবে। 

বাংলাদেশের ইতিহাসের দায় মেটাতে বুদ্ধিজীবী  হত্যাকাণ্ডের  এ  প্রমাণিত ঘাতকের সাজা নিশ্চিত করা  প্রয়োজন।