বিশ্ব হার্ট দিবস ২০১২: বিশেষ নজর নারী ও শিশুদের প্রতি

ডা. শুভাগত চৌধুরী
Published : 29 Sept 2012, 02:19 PM
Updated : 29 Sept 2012, 02:19 PM

এখনও লোকপ্রচার এ রকম যেঃ
হৃদরোগ ও রক্তনালীরোগ বা স্ট্রোকের মতো জীবনযাত্রার অসুখগুলো বয়স্ক লোক ও ধনীদেরই বেশি হয়। তাছাড়া, নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি। এতদিন এ সব তথ্যই সত্য বলে মনে করা হত। এখন এর বিপরীত ঘটনার তথ্যপ্রমাণ বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে। জানা গেছে, সব ধরনের জনগোষ্ঠীর সব বয়সের মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে। নারী, এমনকী শিশুরাও এ রোগের হাত থেকে রেহাই পায় না। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির গুরুতর অসুস্থতা ও অক্ষমতার জন্য পরিবার ও সমাজকে দারুণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আর রোগীর প্রাণনাশের সমূহ শঙ্কা তো রয়েছেই।

বিশ্ব হার্ট দিবসঃ
প্রতিবছর ২৯ শে সেপ্টেম্বর আমাদের সাম্প্রতিক হৃদ-সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও জনসচেতনতা সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়। পাশাপাশি, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের গুরুভার কমানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টায় এই দিনটি আমাদের প্রেরণাও জোগায়।

এ বছর নারী ও শিশুদের হৃদ-সমস্যার ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। হৃদ-স্বাস্থ্যকর কার্যকলাপের মাধ্যমে তাদের হৃদ-সুরক্ষার জন্য। বছরটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, এ বছরেরই মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনে ১৯৪ দেশের সরকার অ-সংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও ক্রনিক শ্বাসতন্ত্রের ব্যাধির বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াই করতে সম্মত হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সব রোগে মৃত্যু ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার অঙ্গীকারও করেছে সরকারগুলো। অ-সংক্রামক রোগে বিশ্বের ৩৮ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়। এর অর্ধেকের মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ ও স্ট্রোক। তাই এ বছরের বিশ্ব হার্ট দিবসটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবছর হৃদরোগ ও স্ট্রোকে যে ১৭.৩ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়্ একে প্রতিরোধ করা সহজ হবে যদি সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সব রোগে অকাল মৃত্যু ২৫ শতাংশ কমানো যাবে।

একটি বিশ্ব, একটি ঘর, একটি হৃদযন্ত্রঃ
নারী ও শিশুদের হৃদ-সুরক্ষা যেহেতু এ বছরের বড় লক্ষ্য, তাই একটি শিরোনামে অভিযানটি শুরু হচ্ছে। 'একটি বিশ্ব, একটি ঘর, একটি হৃদযন্ত্র।' স্বাস্থ্যকর আহার, শরীরচর্চা ও তামাকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে সংসারের প্রিয়জনদের হৃদপিন্ডের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য।

দেখা যাচ্ছে, হৃদরোগ ও রক্তনালীর রোগ নারীদের মধ্যে প্রধান ঘাতক রোগ। কোনও কোনও দেশে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় এ সব রোগে। প্রতি মিনিটে একটি মৃত্যু। তাই এ সব রোগের ঝুঁকিগুলো তাদের জানা উচিত ও জেনে সুরক্ষা-ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

শিশুদেরও হৃদরোগের আশংকা কম নয়ঃ
জন্মের আগে, মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই শিশুর হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকির সূচনা হতে পারে। আবার শৈশবে অস্বাস্থ্যকর খাবার, শরীরচর্চার অভাব ও ধূমপানের জন্য কৈশোরে এ সব রোগের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।

শিশুদের উপর পড়তে পারে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের দ্বিগুণ বোঝা। কোনও প্রিয়জন অসুস্থ হলে শিশুকে মনোবেদনা সইতে হতে পারে। আবার নিজের দেহে সমস্যা তৈরি হলে এর দৈহিক পরিণতিগুলোর ঝুঁকিও তার জন্য বিরাট বেদনাদায়ক।

আধুনিক সমাজে শিশু-কিশোরদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসঃ
আজকাল শিশুরা গ্রহণ করছে বিপুল পরিমাণ ক্যালরি এবং চিনি ও মন্দ-চর্বিতে পূর্ণ খাবার। কম্পিউটার গেমসহ বসে বসে নানা রকম খেলার আয়োজনে ব্যস্ত থাকা তাদের করছে শরীরচর্চাবিমুখ। অনেক দেশে তামাক ও সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার এবং এর সহজলভ্যতার জন্য তরুণরা আসক্ত হচ্ছে ধূমপানে। এছাড়া অন্যদের সিগারেটের ধোয়া পরোক্ষভাবে সেবন করে অসুস্থ হচ্ছে শিশু ও নারীরা।

১. সক্রিয় হওয়া চাইঃ
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর ৬ শতাংশের কারণ শরীরচর্চার অভাব। ঝুঁকি-উপাদানগুলো হল- শৈশবে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও শরীরচর্চার অভাব। এভাবে জীবনযাপন করা শিশুটি পূর্ণবয়স্ক হলে তার হৃদরোগের আশঙ্কা খুব বেশি হয়।

সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন মাত্র ত্রিশ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম করলেই হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।

শরীরচর্চা মানেই ব্যায়াম নয়। গেরস্থালি কাজ, বাগানে কাজ করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছতার কাজ, এ সবও শরীরচর্চা। শিশুদের এ সব করতে বলা যায়। তাহলে তার হৃদ-স্বাস্থ্য রক্ষা হবে।

২. খেতে হবে হৃদ-স্বাস্থ্যকর খাবারঃ
আজকাল মানুষ ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবারের দিকে ঝুঁকছে। এ সব খাবার চিনি, নুন, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাটে ভরপুর। পৃথিবীতে মৃত্যুর দশটি প্রধান ঝুঁকির অন্যতম হল অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ।

হৃদ-স্বাস্থ্যকর খাদ্য হবে ফল ও সবজিতে ভরপুরঃ
প্রিয় খাবার পুরোপুরি বর্জন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই মিষ্টি খাবার একেবারেই বর্জন করার চেয়ে চকলেট বা অন্যান্য মিষ্টির বদলে খেতে পারেন আম বা অন্য কোনও মিষ্টি ফল।

স্বাস্থ্যকর খাবারকে শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা যেতে পারে। খাদ্যতালিকায় রঙিন শাকসবজি বেশি করে যুক্ত করুন।

দিনে এক চা চামচের বেশি নুন খাওয়া যাবে না। আর সব খাবারই খেতে হবে কম। ছোট প্লেটে, ধরে-ধরে।

ধুমপান ও তামাককে 'না' বলতে হবেঃ
প্রতি দুজন ধূমপায়ীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় তামাকসেবনজনিত রোগে।

দুর্ভাগ্যবশত অনেক শিশু-কিশোর ক্রমেই ধূমপানে আসক্ত হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই প্রবণতা। বড়দের অনেকেই ধূমপান ছাড়লেও তরুণরা এতে আকৃষ্ট হচ্ছে। আবার পরোক্ষ ধূমপানের কারণে প্রতিবছর শিশুসহ ৬ লাখ অ-ধূমপায়ী লোক প্রাণ হারাচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে খুব ছোট শিশুদের ঘটছে আকস্মিক মৃত্যু।

ধুমপান ছেড়ে দিয়ে পরোক্ষ ধূমপানও এড়াতে পারলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশ কমে যায়।

১. ঘরে ধূমপান অবশ্যই নিষিদ্ধ, পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য।

২. ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া উচিত যাতে তারা নিজেরাই অ-ধূমপায়ী হয়ে উঠে।

৩. ধূমপান বর্জন করা অবশ্যই উচিত। কাজটা কঠিন মনে হলে নিতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ।

৪. জানতে হবে নিজের স্বাস্থ্য-সূচকগুলোর মান।

আরেকটা জিনিস, হৃদ-স্বাস্থ্যের নিয়মিত চেকআপ চাই। ডাক্তারের কাছে গিয়ে রক্তচাপ, কোলেস্টরেল ও গ্লুকোজের মাত্রা, শরীরের ওজন ও বিএমআই পরিমাপ করানো উচিত।

নিজের ঝুঁকি সম্পর্কে জেনে নিয়ে, হৃদ-সুরক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করে জীবনধারাকে প্রয়োজনে সেভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।

প্রিয়জনদের জীবনকেও সুরক্ষার বর্ম দিতে হবে, সহায়তা করতে হবে যাতে তারা হৃদপিন্ডকে সুস্থ, সতেজ ও সবল রাখতে পারে।

হৃদরোগ ও স্ট্রোক হল প্রতিরোধযোগ্য রোগ। অনেক সময় উচ্চরক্তচাপ, উঁচুমানের কোলেস্টেরল গ্রহণ, বেশি ওজন ও স্থূলতা, তামাক ব্যবহার ও ডায়াবেটিসের মতো ঝুঁকি এদের উস্কে দিতে পারে।

স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে, নিয়মিত ব্যায়াম করে ও তামাক বর্জন করে ঝুঁকিগুলো অনেকটাই এড়ানো যায়, প্রতিরোধ করা যায় হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক।

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
: চিকিৎসক, অধ্যাপক ও লেখক।