ইতালি ফেরত ও আমাদের লজ্জা

মো. শফিকুল ইসলাম
Published : 11 July 2020, 02:09 PM
Updated : 11 July 2020, 02:09 PM

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। কখন এটা নিয়ন্ত্রণে আসবে সে সম্পর্কে কেউই কোনো নির্দিষ্ট ধারণা দিতে পারেনি। তারপরও এই করোনাভাইরাস থেকে আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কি না করে যাচ্ছেন। নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, জনসমাজে সেসব উদ্যোগ খুবই প্রশংসিত। তিনি বিভিন্ন সেক্টরের উৎপাদনশীলতা টিকিয়ে রাখতে বিশাল অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণাসহ দরিদ্র মানুষ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এবং জীবিকার জন্য নিয়েছেন বিভিন্ন পরিকল্পনা। করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় দ্রুত বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দেশে এবং বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছেন শেখ হাসিনা।

অনেক দেশের সরকার প্রধান সঠিক ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় এবং অযৌক্তিক মন্তব্য দেওয়ায় নাগরিকের নিকট সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন, সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া পদক্ষেপ এবং নেতৃত্বের কারণে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। দক্ষতার সঙ্গে যেকোনো ষড়যন্ত্র এবং সংকট মোকাবিলা করা তার জন্য নতুন কিছু নয়। তারপরও নতুন করোনাভাইরাস মোকাবিলায়ও তিনি নিয়েছেন দ্রুত পদক্ষেপ। সেজন্য ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামও তার প্রশংসা করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বকে এক হয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মার্চ মাসে ভিডিও কনফারেন্সে কোভিড-১৯ যুদ্ধে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সার্কভুক্ত দেশের সরকার প্রধানদের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।

করোনাভাইরাস সংকটে জনগণের পাশে আছেন এবং থাকবেন বলে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেন দেশের সকল নাগরিককে। করোনাভাইরাস সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রতি মুহূর্তের করণীয় ঠিক করতে দিনরাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাতে সবাই তার কার্যক্রমে আশান্বিত। তিনি সার্বক্ষণিক এ বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী জীবন ও জীবিকা এই দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন যা সাধারণ নাগরিকের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

আর অন্যদিকে এক শ্রেণির অসাধু ও প্রতারক লোকের কারণে বিশ্বে আমাদের মান সম্মান নষ্ট হচ্ছে। ভুয়া কোভিড-১৯ নেগেটিভ রিপোর্ট বিক্রি হয়েছে এবং সেই রিপোর্ট নিয়ে আবার কিছু প্রবাসী বিদেশে গিয়ে কোভিড পজিটিভ হয়েছেন, তাদেরকে বিদেশের বিমানবন্দরে অবতরণ করতে অনুমতি না দেওয়ায় আবার দেশে ফেরত আসতে হচ্ছে, এর চেয়ে লজ্জার আর কি আছে! ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে জানতে পারি বাংলাদেশের সঙ্গে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত সব ফ্লাইট বাতিল করেছে ইতালি। এ সংক্রান্ত নোটিশ জারি করেছে ইতালি সরকার। ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ থেকে ইতালিগামী সব ফ্লাইট/যাত্রী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত যে কোনো দেশের নাগরিক কিংবা যে কোনো দেশ হয়ে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কোনো ফ্লাইট ইতালিতে অবতরণের অনুমতি পাবে না।

করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে এই আশংকায় কোনো এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে কোনো যাত্রী নিতে পারবে না। এমনকি কোনো ট্রানজিট ফ্লাইটেও যাত্রী নেওয়া যাবে না, যারা বাংলাদেশ থেকে যাবে। কারণ বাংলাদেশ থেকে গত সোমবার ইতালিতে যাওয়া একটি বিশেষ ফ্লাইটে ২১ জন করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে দেশটির প্রভাবশালী প্রায় সব পত্রিকার প্রধান শিরোনামে নেতিবাচকভাবে বাংলাদেশের খবর প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট নিয়ে এই প্রবাসীরা ইতালিতে গেছেন বলে শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে। দৈনিক পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে এভাবে 'বাংলাদেশ থেকে ভুয়া করোনার সার্টিফিকেট'। এছাড়াও ইতালির পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামেও লেখা প্রকাশ পেয়েছে যে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ওপর ঐ দেশের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যেন ভালোভাবে নজর রাখে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে কারণ দেশে আটকে পড়া কয়েক হাজার বাংলাদেশি প্রবাসী যারা ইতালিতে যেতে পারছেন না, তাদের চাকরি চলে যেতে পারে। এতে অবশ্যই আমাদের রেমিটেন্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতালি কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করছে। আর সেখানে বাংলাদেশ থেকে গত কয়েকদিনে যত ফ্লাইট গিয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই কেউ না কেউ কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। ওখানে পরীক্ষায় যাদের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে তারা সবাই বাংলাদেশ থেকে ভুয়া রিপোর্ট নিয়েছেন। এতে শুধু ইতালিতে নতুন করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা রয়েছে তাই নয় বরং বাংলাদেশি প্রবাসীদের মান সম্মানে বড় ধাক্কা নেমে আসবে মনে হচ্ছে। এতে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

ইতালিতে লকডাউনের শুরুর দিকে যারা বাংলাদেশে আসছিলেন তারাই এখন ইতালিতে যাচ্ছেন। চাকরি এবং জীবিকার জন্য অনেক বেশি টাকা খরচ করে বিশেষ ফ্লাইটের টিকিটে তারা গিয়েছেন। কিন্তু কিছু ধান্দাবাজ প্রতারকের জন্য এখন প্রবাসী সবাইকেই বিপদে পড়তে হলো। এমনকি আমাদের দেশে থেকে যাওয়া কেউ কোয়ারেন্টিন ভঙ্গ করলেই তিন মাসের কারাদণ্ড শাস্তি পেতে হবে। যেখানে আমাদের প্রবাসীরা কর্মঠ হওয়ায় বাংলাদেশের সুনাম ছিল, এখন ইতালির নাগরিকরা আমাদের সুনজরে দেখছে না। চীনের নাগরিকরাও ইতালিতে গত মার্চ মাসে বৈষম্যের শিকার হয়েছিল চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে বলে। এখন আমাদের অনেক নাগরিকের সাথে সেরকমটা ঘটতে যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস টেস্ট করে বিভিন্ন সংস্থা ভুয়া রিপোর্ট দিল এবং সেই ভুয়া রিপোর্ট নিয়ে প্রবাসীরা যেভাবে বিদেশের বিমানবন্দরে ধরা পড়লেন, এতে করে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ভাবে এবং বিদেশের মাটিতে আমাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট হয়েছে যার প্রভাব খুব শীঘ্রই শেষ হবে না মনে হচ্ছে। যখন বিদেশের মাটিতে আমাদের পাসপোর্ট, লাগেজ, সার্টিফিকেট, ল্যাপটপ আমাদের টাই-স্যুট নানাভাবে চুলচেরা খোঁজাখুঁজি করবে তখন আমাদের লজ্জার সীমা থাকবে না! এর মানে জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা চেতনা, আমাদের সংস্কৃতিসহ হাজারো জায়গায় কালিমার দাগ লেগে গেল কি?

সাধারণ নাগরিকের মনে প্রশ্ন জাগে কিভাবে সাহেদের মত মানুষদেরকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনাভাইরাস চিকিৎসার অনুমতি দিল! স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়ে জনসমাজে নানা ধরনের মন্তব্য রয়েছে এবং এদের কার্যক্রম মানুষের নিকট কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। মানুষ বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজানো দরকার।

তাই আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে আমাদের বিমানবন্দরে ভালোভাবে চেক করে বিদেশে যাত্রী পাঠানো হয়। যাতে আর কোনো দেশ আমাদের প্রবাসী নাগরিকদের ওপর এইভাবে নিষেধাজ্ঞা না দিতে পারে। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরও নজরদারি বাড়াতে হবে যাতে আর কেউ সাহেদের মতো কোভিড-১৯ ভুয়া নেগেটিভ সনদপত্র না দিতে পারে। সাহেদের মতো যারা এই ধরনের প্রতারণার সাথে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এই সময়ে এ জাতীয় জনস্বাস্থ্যবিরোধী কাজের সকল তৎপরতাকে রুখে দিতে না পারলে তা হবে আমাদের জন্য চরম ব্যর্থতা। সরকারকে এ বিষয়ে তাই নিতে হবে যথার্থ এবং কার্যকরী পদক্ষেপ।

পরিশেষে, শুধু সরকারের দায়িত্ব রয়েছে এমন নয়, নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে যাতে বিদেশ ভ্রমণের সময় আমরা অধিকতর সতর্ক এবং সচেতন হই। আমরা যেন ভুয়া রিপোর্টসহ অন্যান্য এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকি। মনে রাখবেন যে আপনি যখন বিদেশ ভ্রমণ করেন শুধু আপনাকে প্রতিনিধিত্ব করছেন না, আপনি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন।