মানুন, বাঁচুন, বাঁচান

শোয়েব সাঈদ
Published : 8 July 2020, 11:01 AM
Updated : 8 July 2020, 11:01 AM

এই লেখাটি লিখছি কোভিড সংকটে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় ঘুরপাক খাওয়া কিছু প্রশ্ন নিয়ে, আসলে হচ্ছেটা কী? করোনাভাইরাস নিয়ে চারিদিকে নানা সরব আলোচনা, টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে, সরকারি ভাষ্যে করণীয় নিয়ে অনবরত প্রচারে জনগণ কতটুকু অনুসরণ করতে পারছে দিনে দিনে বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার জন্ম শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাড়ায় পাড়ায় চলছে লকডাউন। আমার এক কাজিনের করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর শুনে ফোনে কথা বললাম ওর বউয়ের সাথে। বিস্তারিত জানতে চাইলাম এবং শুনে অবাক হয়ে গেলাম ওদের ব্যবস্থাপনায়। কাজিনের বউয়ের সাথে কথা বলে আমার ধারণা হল করোনাভাইরাস পজিটিভ স্বামীর সেবাযত্নে সে নিজের, বাচ্চাদের আর পরিবারের অন্যদের নিরাপত্তা দারুণভাবে উপেক্ষা করছে। এন-৯৫ মাস্ক কী, কোথায় পাওয়া যায় এসব সম্পর্কে ধারণা নেই। সাধারণ মাস্ক পরে স্বামীর সেবাযত্ন করছে, রুমে আসা যাওয়া করছে পর্যাপ্ত রক্ষাকবচ ছাড়াই। ঘরের ফ্লোর মোছার কাজে ব্যবহার করছে মূলত হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন সব এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল/এন্টিবায়োটিক সল্যুশন দিয়ে, ভাইরাস ধ্বংসে যেগুলির কার্যকারিতা বিশ্বব্যাপী প্রশ্নবিদ্ধ। স্যানিটাইজার, দেশীয় সাবান দিয়ে হাত, বিভিন্ন হাতল মোছা আর ব্লিচিং দিয়ে ফ্লোর মোছাসহ কোভিড থেকে সুরক্ষা পাবার সুনির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ দিয়ে ফোন রাখলাম। ফোন রেখে ভাবছিলাম অসংখ্য টিভি চ্যানেলের বাংলাদেশে দিনরাত কোভিড বিষয়ে পরামর্শে কাজ হচ্ছে না কেন? কর্তৃপক্ষ কি তাহলে কোভিড বিষয়ে আসল বার্তা জনগণকে পৌঁছাতে ব্যর্থ? পরক্ষণেই ভাবলাম টয়লেট থেকে ফিরে হাত ধৌত করার বিষয় বুঝাতে যে জাতির যুগ পার হয়ে যায়, সেখানে কোভিডের মত ডেলিকেট বিষয়ে শিক্ষামূলক প্রচারণায় সময় তো লাগবেই। ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই ঠিকঠাক মতো পরবার প্রশিক্ষণটা খুব বেসিক বলেই ধরা হয়। যে দেশে ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিক হারে করোনাভাইরাস ভিকটিম হবার পেছনে নিম্নমানের পিপিই ব্যবহারের পরেই পিপিই পরতে অদক্ষতাকে দায়ী করা হয় সেই দেশে আমজনতার ভুল তো স্বাভাবিক। পরে জেনে মন খারাপ হল ভাইটি সেরে উঠলেও স্বাস্থ্যবিধি না মানার অনিবার্য পরিণতিতে ভাইয়ের বউটি যথারীতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।

বাংলাদেশ সংক্রমণের তীব্রতায় বৈশ্বিক অবস্থানে প্রায় শীর্ষ পর্যায়ে, সংক্রমণের হার কখনো কখনো ২০% এর ওপরে চলে যাচ্ছে। টেস্ট করার স্বল্প সামর্থ্যের মধ্যেই আমাদের হিসেব-নিকেশ, সামর্থ্য বাড়লে রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি বুঝবার জন্যে করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগী বনাম টেস্ট সংখ্যার শতকরা হারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে টেস্টের সংখ্যা বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডে খুবই কম, হাজারে ৪ জনের টেস্ট হচ্ছে। এই সংখ্যার ওপর আরও বিরূপ প্রভাব পড়বে সরকারি ভাবে টেস্ট করতে ফি আরোপের নজিরবিহীন সিদ্ধান্তের ফলে। দিনে এনে দিনে খায় এমন কোটি কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী টেস্ট করতে নিরুৎসাহী হবে যা কমিউনিটি সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা কম কিন্তু প্রতিদিনই ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, আমলাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের হাই প্রোফাইল মানুষের কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা চমকে উঠার মতো। মৃত্যুর এই প্রবণতা কি সাধারণ মানুষের মাঝে একই রকম যা সঠিক ডাটা বা তথ্যের অভাবে আমরা জানতে পারছি না বা আসলেই কম এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এই বিষয়ে নির্দিষ্ট গবেষণা প্রোজেক্টের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত যোগাড় করা জরুরি। সমাজের সচ্ছল শ্রেণি আর প্রান্তিক শ্রেণির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তুলনামূলক চিত্রটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সচ্ছল শ্রেণি আর প্রান্তিক শ্রেণির জীবনযাত্রা তারতম্যে ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতাজনিত পার্থক্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় বিরাট প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশে ডাক্তার, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীদের অতি উচ্চহারে করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণের কারণ নির্ণয়ে একদল ডাক্তারের বিবেচনায় প্রথম কারণ নিম্নমানের পিপিই আর দ্বিতীয় কারণ পিপিই পরতে ভুল-ভ্রান্তি। দ্বিতীয় কারণটি অনেকে ইমোশনাল প্রতিক্রিয়ায় মানতে রাজি নন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে দ্বিতীয় কারণটি উপেক্ষা করার মত নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে কোভিড রোগীর সেবায় যারা রোগীর একেবারে কাছাকাছি দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেন, তাদের সুরক্ষার বিষয়টি অনেকটা বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘরের মত নিশ্ছিদ্র। কোভিড রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের বলয়ে যারা থাকছেন তাদের কোনো প্রকার সুযোগ নেবার সুযোগ নেই। সংক্রমণে সবচেয়ে দুর্বল ক্ষেত্র হচ্ছে হাত আর মুখ। হাত জীবাণুমুক্ত রাখা খুবই জরুরি, বিশেষ করে বার বার মুখে হাত দেবার সংস্কৃতিতে। আসবাবপত্র, হাতলসহ অনেক নন কনভেনশনাল সূত্র থেকেও জীবাণু হাতে লাগতে পারে। সার্জিক্যাল মাস্ক পরে জনসমাগমে যাওয়া গেলেও কোভিড রোগীর সংস্পর্শে দরকার আরও উন্নতমানের মাস্ক; সেই ক্ষেত্রে মাস্কটা হবে এন৯৫ গ্রেডের বা সমমানের। পশ্চিমা বিশ্বে স্বাস্থ্যকর্মীদের এন৯৫ মাস্কটি হয় কাস্টমমেড; সংশ্লিষ্টদের মুখের সাথে ফিট করে সাইজমত। যত বড় ডাক্তারই হউন না কেন, জানতে হয় বা প্রশিক্ষণটা নিতে হয় কিভাবে মাস্কটি পরবেন, ধরবেন এবং নিরাপদে রিসাইকেল করবেন বা ফেলে দিবেন। এই বিষয়গুলো "ডাক্তারদের মাস্ক পরা শিখতে হবে নাকি" ধরনের সহজে উড়িয়ে দেবার বিষয় নয়। উন্নত বিশ্বে গুড ল্যাবরেটরি প্রাকটিসে যতবড় গবেষক/বিজ্ঞানী হউন না কেন ল্যাবে বিশেষ করে লাইফ সায়েন্সের ল্যাবে কাজ করতে গেলে ল্যাবের আর নিজের নিরাপত্তা বিষয়ে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতার সার্টিফিকেটটা নিয়ে রাখতে হয় সেফটি ইন্সপেকশনের সময় দেখানোর জন্যে। ভারতীয় উপমহাদেশের কালচারে নাকে মুখে হাত দেবার প্রবণতা খুব সাধারণ ঘটনা। কোভিড রোগীর সেবা যারা করছেন তাদের মাস্কের বাইরের অংশে ভাইরাস লোড অনেক বেশি, বেখেয়ালে এটি স্পর্শ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একথা ভুললে চলবে না কোভিড পরিস্থিতি নজিরবিহীন, এটিকে অপারেশন থিয়েটারে মাস্ক পরার অভিজ্ঞতার বিচারে দেখলে হবে না, সতর্কতার মাত্রা অনেক বেশি। এখানে ত্রুটি বিচ্যুতি বেশি হয় সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না হবার কারণে, কালচারাল অভ্যাসের কারণে। একটা সময় আমাদের দেশের আমলারা কোনো কনফারেন্স বা মিটিং এ গলায় বা প্যান্টের বেল্টের সাথে পরিচয়পত্র বহন করাতে অপমানিত বোধ করত। এই সংস্কৃতি পরিবর্তন হতে বেশ সময় লেগেছিল। গ্লোবালাইজেশনের ফলে যখন দেখা গেল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক রথী মহারথীদের গলার পরিচয় পত্র ঝুলছে, তখন উপলব্ধি হল এটি অপমানের নয়। আমাদের অস্বাস্থ্যকর সংস্কৃতি থেকে বের করে আনতে অর্থাৎ পরিষ্কার পরিছন্নতার ক্যাম্পেইনে মীনা-রাজুর প্রচারণায় সময় লেগেছে দশকের পর দশক। স্বাস্থ্যকর্মীরা যত অভিজ্ঞ হোক কেন, কোভিড বিষয়ে গত ডিসেম্বরের আগে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না, ফলে কোভিড ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতার চাইতে আপটুডেট নির্দেশনায় হাতেকলমে জানাটা জরুরি। এই জানা বা প্রশিক্ষণের অভাবে ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীদের ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কোভিড-১৯ এর SARS-CoV-2 ভাইরাসটি নাছোড়বান্দা ধরনের। একটু প্রশ্রয় পেলেই মাথায় চড়ে বসে। যে রাষ্ট্রগুলো প্রশ্রয় দিয়েছে তারা সবাই ভুক্তভোগী। যতটা প্রশ্রয় ততটা খারাপ সময় ঐ রাষ্ট্রগুলোর অবধারিত ললাট লিখন। খণ্ডন করার চাবি কিন্তু আবার প্রশ্রয়দাতার হাতেই রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কোভিড মৃত্যু আর সংক্রমণে বিশ্বের এক নম্বর দেশ। এই এক নম্বর হওয়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লজ্জার বদলে অনেকটাই গর্বিত; উনি টেস্ট সংখ্যা কমাতে বলছেন, মাস্ক না পরার সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিচ্ছেন, জনসমাবেশের পক্ষে সাফাই গাইছেন। এক লক্ষ তিরিশ হাজারের বেশি মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতায় দমন করার চাইতে কোভিডকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে আবারো দৈনিক রেকর্ড সংখ্যক সংক্রমণের ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র গেল সপ্তাহে। লকডাউনের বিরুদ্ধে মিছিল করে যে জাতি, সামার উপভোগ করতে সমুদ্র সৈকতে ঝাপিয়ে পড়েন যারা যেন এটাই জীবনের শেষ সামার, কিংবা বারে, নাইট ক্লাবে উপচে পড়া ভিড়ে কোভিড সংকট ভুলে যান যারা, করোনাভাইরাসের চারণ ভূমি হবার ক্ষেত্রে উনারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবার পর অবশেষে মে মাসে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল। এই সফলতা ধরে রাখতে হলে সদা সতর্ক থাকতে হবে, নতুন করে সংক্রমিত রাজ্যগুলোর মত বেপরোয়া হওয়া চলবে না। ব্রাজিলের মত বেপরোয়া আচরণে যুক্তরাষ্ট্রের বহু রাজ্য নতুন করে সংকটে। এটিকে অনেকেই দ্বিতীয় ওয়েভ মানতে রাজী নন, প্রথম ওয়েভের অংশ হিসেবেই দেখতে চাচ্ছেন।

ইউএস ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স গর্ব করে বলছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাস যুদ্ধে জয়ী হতে চলেছে, দ্বিতীয় ওয়েভ হবে না। সেই দম্ভ থাকেনি, জাতি প্রথম ওয়েভের ধাক্কাই সামলাতে পারছে না। গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিল লক্ষাধিক মৃত্যুর বোঝা নিয়ে উৎসব করার সময় নয় এটি। ড. এন্থনি ফাউচি বলেন দৈনিক ২০ হাজার সংক্রমণ নিয়ে দ্বিতীয় ওয়েভের কথা উচ্চারণ করার সময় নয় এখন। এই প্রথম ওয়েভ আগে সামলান পরে দ্বিতীয় ওয়েভের কথা ভাবা যাবে। কোভিড সংকটে কানাডায় মিডিয়া সেলেব্রেটি টরেন্টো জেনারেল হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আইজাক বোগোচ বলেন দ্বিতীয় ওয়েভের বদলে আমাদের অঞ্চলভিত্তিক ছোট ছোট প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করতে হতে পারে এবং এই ক্ষেত্রে এটি দমনে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মত বেপরোয়া হয়ে সব খুলে দেবার পথে না গিয়ে সজাগ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে নিয়ে এগুতে হবে। সংক্রমণের অবাধ সুযোগ দেওয়া যাবে না; ছোট ছোট বুদবুদকে নিয়ন্ত্রণ করে বড় বুদবুদ তৈরির সুযোগ নষ্ট করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার খুব কম সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়েছে ফলে অধিকাংশ মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কানাডার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা থেরেসা ত্যাম বলেন মাত্র ২.৫ মিলিয়ন কানাডিয়ান টেস্টের আওতায় এসেছে যার ৪% সংক্রমিত হয়েছে। পৌনে চার কোটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে মাত্র এক লাখের কিছু বেশি। ফলে ৯৯% এর বেশি কানাডিয়ান সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমতাবস্থায় সংক্রমণ দমনের পথে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই। কোভিড ভাইরাস দমনে এই পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান বিশেষ করে এপিডেমিলজি, ট্রান্সমিশন ধরণ, টেস্ট করার লজিস্টিকস এবং চিকিৎসা পদ্ধতি ভবিষ্যৎ প্রাদুর্ভাব দমনে মূল ভূমিকা পালন করবে। তথ্য উপাত্তে দেখা যায় করোনাভাইরাসের পছন্দ ইনডোর গ্যাদারিং যেমন উপাসনালয়, পার্টি, নাইট ক্লাব, বার। করোনাকে প্রশ্রয় দিতে না চাইলে ইনডোর গ্যাদারিং এর বিরুদ্ধে অবস্থান কঠোর রাখতে হবে। কানাডায় কোভিডকে দমিয়ে রাখার মূল সফলতাই ছিল সামাজিক আর শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। পাশাপাশি দুই দেশ কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের কোভিড ব্যবস্থাপনায় ভিন্নতা ছিল, ফলে ফলাফলও ভিন্ন। কানাডা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে; কি করা হয়েছে, কি করা যেত, কখন অতি প্রতিক্রিয়া, কখন কম প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে সব কিছুর বিশ্লেষণ করে সংশোধন সাপেক্ষে কর্মপন্থা ঠিক করছে, অন্যদিকের ট্রাম্পের অজ্ঞতা আর তথাকথিত সাফল্যের ঢেঁকুর বার বার যুক্তরাষ্ট্রকে বিপদে ফেলছে।

সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে একটি মান বা ফ্যাক্টর R0 রোগ ছড়ানোর মাত্রার নির্দেশক। ম্যাথমেথিক্যাল টার্ম R0 কে অন্যভাবে বলা হয় R নট। এই মান দিয়ে হিসেব করা হয় একজন সংক্রমিত মানুষ কতজনকে সংক্রমিত করতে পারে। R0 ১০ এর অর্থ হচ্ছে একজন সংক্রমিত মানুষ দশ জনে ভাইরাসটি ছড়াতে পারেন। R0 ১ এর নীচে থাকলে জীবানুটি মিলিয়ে যাবে, একের ওপর থাকলে রোগ অব্যাহত থাকবে তবে মহামারী হবে না। একের ওপরে হলে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটবে। কোভিড সংক্রমণে ধারণা করা হয়েছিল R0 মান গড়পরতায় ৩ এর মধ্যে। কিন্তু সম্প্রতি ইমারজিং ইনফেক্সাস ডিজিজ জার্নালে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে এটি ৬ এর কাছাকাছি। কোভিডের এই সংক্রমণ সক্ষমতা বিশ্বব্যাপী ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছে এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে সংক্রমণের চেইনটাকে ভেঙ্গে দেওয়া।

বিশ্বের যে সমস্ত দেশ কোভিড সংক্রমণ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে তারা সবাই লকডাউন, সামাজিক-শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্রমণের চেইন ভেঙ্গে দিয়েই সেটি করেছে। সংক্রমণের চেইনটাকে ভেঙ্গে ফেলা অর্থাৎ সংক্রমণ একজনের কাছ থেকে অন্যজনে ছড়াতে না দেওয়াটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ড্রাগ কিংবা ভ্যাক্সিনের অভাবে সামাজিক শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই সংক্রমণের চেইনটাকে ভেঙ্গে দেবার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। চেইনটাকে ভেঙ্গে দেবার ক্ষেত্রে যারা ব্যর্থ, যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রাজিলকে তাদের অন্যতম ভাবা হয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে সংকট নিরসনে নির্লিপ্ততাকে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ধরা হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কোভিড নিয়ন্ত্রণে সত্যিকারের অ্যাকশনের চাইতে আত্মসন্তুস্টিতে ব্যস্ত থাকার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেকবার সতর্ক করেছে। কোটি মানুষের সংক্রমণ আর লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেসাস সামনে আরও বড় বিপদের আশংকা করছেন এবং বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে সংক্রমণের চেইনটা ভেঙ্গে ফেলতে কঠোর অবস্থানে যেতে আহবান জানিয়েছেন।

কোভিড সংকটে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক এটি আমরা সবাই জানি। সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি আর অব্যবস্থাপনায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। ইতালি থেকে আগত প্রবাসীদের চিহ্নিত করে চলাফেরা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা জটিল পরিস্থিতির বড় উপাদান। এই জটিল পরিস্থিতি এখন জটিলভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে পিকে উঠে বা না উঠে অনেকটা ক্রনিক অবস্থায় আমাদের কোভিড সংকট তুষের আগুনের মত দীর্ঘদিন থাকতে পারে। কারণটা হচ্ছে আমরা সংক্রমণের চেইনটাকে ভেঙ্গে দিতে পারছি না। এর মূল কারণ লকডাউন, সামাজিক শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতে আমাদের চরম অনীহা। আর্থিক বা সাংস্কৃতিক যে কারণেই হোক না কেন আমাদের জনগোষ্ঠীর বড় অংশই অন্যের নিরাপত্তার কিংবা অন্যের স্বার্থ আর স্বাস্থ্যের প্রতি সংবেদনশীল নয়। অন্যের প্রতি এই অসংবেদনশীলতার জন্যে নিজের ক্ষতিকেও আমরা মেনে নেই।

বাংলাদেশের মানুষ এখন কোভিড নিয়ে ভীষণ ত্যক্ত বিরক্ত, কোভিড নিয়ে আর শুনতে চায় না, শুধু মুক্তির পথ দেখতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুক্তির কোনো ম্যাজিক সমাধান নেই আর এই জন্যেই এই লেখায় আমি সংকট মোকাবিলায় সফল আর ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর উদাহরণ দিয়েছি। হতাশ বা ত্যক্ত বিরক্ত হবার মাঝেও কোনো সমাধান নেই। ভ্যাকসিন বের হলেও বাংলাদেশের জনগণের কাছে পৌঁছতে সময় লাগবে। সমাধান অন্য দেশের লোক করে দিতে আসবে না, নিজেদেরই তা করতে হবে। তথ্য আছে যে ঢাকায় আর অন্যান্য শহরে এলাকাভিত্তিক লকডাউন যেখানে কঠোর ছিল সফলতা সেখানে দৃশ্যমান। এই কৌশলের সফলতা স্থানীয়ভাবে শুধু বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিকভাবেও প্রমাণিত। কোভিড সংকট নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমাদের কঠোরভাবে লকডাউন পালন, সামাজিক শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার একমাত্র অস্ত্রটি ব্যবহার করে সংক্রমণের চেইনটি ভেঙ্গে দেওয়া ছাড়া আপাতত কোনো গত্যন্তর নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আর পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার সফলতার উপর নির্ভর করছে আমার, আপনার, চারপাশের সবার ভাল থাকা।