ডেসকো-র ‘ডিসকো’ বিল ও গ্রাহকের পিঠে অযাচিত কিল

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 5 July 2020, 02:54 PM
Updated : 5 July 2020, 02:54 PM

বিদ্যুত বিভাগ হচ্ছে সরকারের এমন একটি খাত যার সাথে দেশের ৩ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক সরাসরি  জড়িত। গত কয়েকমাসে, বিশেষ করে করোনাকালের এই বিপন্ন সময়ে মানুষ যখন গেরিলা ঘাতক কোভিড-১৯-এর ভয়ে সন্ত্রস্ত, অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত ঠিক তখনই বিদ্যুতের অস্বাভাবিক বিলের নিষ্ঠুর ও অবিবেচক খাঁড়া নেমে এসেছে।

বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদবাক্য 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' বলতে যা ‍বুঝায় তার সবচেয়ে যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। এই খাঁড়ার অজুহাত হিসেবে তারা করোনাকে ব্যবহার করলেও এর পেছনে রয়েছে অপেশাদারিত্ব আর অদক্ষতার চূড়ান্ত প্রকাশ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তারা মিটার না দেখেই আন্দাজে বিল তৈরি করেছেন এবং সেসব বিল গ্রাহককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জীবনের কোনো প্রয়োজনই আন্দাজের উপর নির্ভর করে চলে না। যে প্রয়োজন সরাসরি অর্থসংশ্লিষ্ট তার ক্ষেত্রে আন্দাজের সুযোগ থাকা উচিৎ নয়। তার চেয়েও বড় কথা হলো বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল কাঠামোর স্বচ্ছ এক কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তখন এই বিভাগ প্রায় আদিম ও পশ্চাদপদ এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলছে। কিন্তু বিদ্যুত বিভাগ ওসবের তোয়াক্কা না করেই আন্দাজের অযৌক্তিক পথে হেঁটেছে। আন্দাজ মানে অস্বচ্ছতা ও অনির্দিষ্টতার জননী, এবং চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে তা দুর্নীতিরও উৎস হয়ে উঠতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান যার সাথে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ জড়িত তার কর্মকাণ্ড আন্দাজ নির্ভর করা মানে তাকে এমন এক স্বাধীনতা দেওয়া যার অপপ্রয়োগ অনিবার্য। আমাদের মতো পর পর তিনবার দুর্নীতির শীর্ষে থাকা দেশের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি অনিবার্য।

তবু, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই করোনাভাইরাসের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে বিদ্যুত বিভাগ কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে মিটার না-দেখে আন্দাজে বিল করতে  বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বিলটা যখন আন্দাজে করেছে তখন তারা 'গড় বিল' বলে চাতুরিপূণভাবে  অভিহিত করে সেটা এমনভাবে করেছে যেখানে গত বছরের বিলের সঙ্গে কোনো সঙ্গতি রক্ষা করেনি। না করার কারণ হিসেবে ওরা কয়েকটি গৌণ ও পিচ্ছিল যুক্তি দেখিয়েছে।  মার্চের বিলটা ওরা মিটার দেখে এপ্রিলের বিলে ২০% বৃদ্ধি করেছে। কেন করেছে?

১. বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে তারা বলেছিল করোনাকালে কেউ যেহেতু কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেনা ফলে বিদ্যুত কনজামপশন বেশি হচ্ছে। এই যুক্তিটি উত্থাপন করার আগে তাদের মাথায় এটা কেন এলো না যে একজন পরিবারে একাধিক লোক থাকতে পারে।  সেই পরিবারের যদি একজন মাত্র কর্মজীবী হন, তিনি ঘর থেকে বের না হলেও বিদ্যুতের কনজাপশনে কোনও হেরফের হওয়ার কথা নয়। কারণ পরিবারের নিয়মিত সদস্যরা আগের মতোই বাসায় থেকে যে-পরিমাণ বিদ্যুত তারা ব্যবহার করতেন, সেই পরিমাণ বিদ্যুতই তিনি ব্যবহার করবেন। তার উপস্থিতির কারণে কোন যুক্তিতে বিদ্যুত ব্যবহারের পরিমাণ বাড়বে? তিনি কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন না বলে অতিরিক্তি বাল্ব বা অন্য কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুত কনজামপশন বাড়াবেন? বাড়ালে সেটা কোন মাধ্যমে? তার মানে, পুরোটাই কল্পনার মাধ্যমে তারা অনুমান করছেন এই বৃদ্ধির ভাবনাটি। আর ব্যাপারটা কেবল ভাবনাতেই রাখেন নি, প্রয়োগও করেছেন । অথচ এর কোনওই ভিত্তি তারা দেখাতে পারবেন না।

২. ‍ সরকারিভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৮ থেকে ১০% । তারপরও ওই বৃদ্ধির কারণে বিল এত বেশি হতে পারে না। এক হাজার টাকার বিলে বড় জোর আরও একশ টাকা যুক্ত হয়ে এক হাজার একশ হতে পারে , কিন্তু তা দুই  আড়াই হাজারে লাফ দিয়ে বাঁদরের মতো মগডালে পৌঁছায় কি করে?

৩.  ডেসকো বলেছিল স্ল্যাব সুবিধা দেওয়া হবে, কিন্তু গত তিন মাসে তাদের প্রতিশ্রুত সেই সুবিধা না দিয়ে উল্টো বিল বাড়িয়ে দিয়েছে।

অর্থাৎ , পদে পদে বিদ্যুত বিভাগের অদক্ষতা, অপেশাদারিত্ব আর স্বেচ্ছাচার আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

বিল করার ক্ষেত্রে তাদের   অপেশাদারিত্বের নমুনার  খুঁটিনাটি দিকগুলো একটু দেখা যাক।

ডেসকোর প্রকৌশলী মহিউদ্দিন সাহেব বলেছেন, "এপ্রিল মাসে মিটারের রিডিং আনতে পারিনি। মার্চ মাসের ব্যবহৃত ইউনিটের সঙ্গে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে যোগ করে এপ্রিলের বিল করা হয়েছিল। এই হিসাবের ফলে অনেকের এপ্রিল মাসের হিসাবে গরমিল হলেও মে মাসের মিটার রিডিংয়ের ফলে সেটা ঠিক হয়ে গেছে।

"মে মাসে মিটার দেখে বিল করতে গিয়ে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে অনেক গ্রাহকেরই প্রকৃত বিলের চেয়ে কম বিল করা হয়েছে। তখন তার বাদ পড়া বিলটি মে মাসের বিলের সঙ্গে যোগ হয়ে যায়। এসব কারণে মে মাসে অনেকের বিলের পরিমাণ বেড়ে যায়।"

তার এই কথার সাথে যদি আমার নিজের বিলগুলো মিলিয়ে দেখি তাহলে বেশ কিছু অসঙ্গতির উত্তর তাতে মেলেনা।

আমি যে-বাসায় গত কয়েক বছর ধরে আছি , সেখানে দেখতে পাচ্ছি গত বছরের এপ্রিল মাসের বিল এসেছিল ৫৯৯৪ টাকা। এ বছরের এপ্রিল মাসের বিল হয়েছে ৪৭৫৪ টাকা। ধরা যাক, মিটার রিডিং করেননি বলে, প্রায় ১০০০ টাকা কম এসেছে।

ধরা যাক, তারা এই  ১০০০ টাকা পরের মাসের বিলের সাথে যুক্ত করে নিয়েছেন। তা যদি যুক্ত হয় তাহলে কত হতে পারে মে মাসের বিল? আমি মে মাসের যে বিলটি পেয়েছি তার পরিমাণ ১২৬৬১ টাকা। অথচ গত বছরের এই মে মাসের বিল ছিল ৭৩০৮ টাকা। যদি ধরেও নেই যে  এই বছরের মে মাসে আমি গত বছরের মতোই বিদ্যুত কনজিউম করেছি তাহলে সেই  কম নেওয়া ১০০০ টাকা যুক্ত হয়ে বিলটি হতে পারে ৮৩০৮ কিংবা তার কাছাকাছি কোনো সংখ্যা। আর  বিদ্যুতের ৮ থেকে ১০% দাম বৃদ্ধির ফলে সেটা ৮৩০৮ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৯০০০ টাকা হতে পারতো। কিন্তু ১২৬৬১ টাকায় তা লাফিয়ে উঠবে কেন? কিসের ভিত্তিতে তারা এই আন্দাজি বিলটি করলেন? সাড়ে তিন থেকে প্রায় ৪ হাজার টাকা বেশি ।

তারা বলেছেন গড়মিল ঠিক করে দেবেন। কিন্তু  গড়মিল ঠিক তো করেনিইনি, উল্টো আরও বেশি গড়মিল তৈরি করেছেন। এবং ঘটনার এখানেই শেষ নয়। জুন মাসের যে বিল হাতে এসেছে  সেটাতেও মে মাসের মতোই গড়মিলের চূড়ান্ত।  ১২০৭১ টাকা বিল করা হয়েছে। অথচ, গত বছরের  এই মাসে আমার বিদ্যুত বিল ছিল ৫৫৯০ টাকা। তার মানে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে  তারা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তো করেইনি , উল্টো পরপর , দুবার সমস্যার বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে। জানি না, পরে মাসে তারা কী করবে।

এবার তাদের সমন্বয়ের আরেক দিকে আসা যাক। ওজোপাডিকো-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, 'এপ্রিল মাসের বিল পরের মাসের বিলের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। বিল নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে তার সমাধানও করে দেওয়া হবে। করোনাভাইরাসের কারণে মিটার দেখে এ মাসে বিল করা যায়নি। এ কারণে এমনটি হতে পারে। এতে গ্রাহকের কোনো লোকসান হবে না। আমরা সব ঠিক করে দেব।'(প্রথম আলো ১৩ মে ২০২০, ০৯:১৪)

আমি ধরে নিচ্ছি সমন্বয়ের ব্যাপারে তাদের সদিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু কিভাবে তারা সেটা সমন্বয় করবেন? পরের মাসে বিল কমিয়ে, তাই তো?  কিন্তু যে-ভাড়াটিয়া ওই ভুতুড়ে বিল পরিশোধ করে পরের মাসেই যদি সেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়ে থাকেন তখন তিনি বিদ্যুত বিভাগের গড়মিলের কারণে যে অতিরিক্ত টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন তা  সমন্বয়ের কারণে তিনি তো আর ফেরত পাবেন না। কারণ তার জায়গায় যদি অন্যকোনো ভাড়াটিয়া চলে আসে সেই সুবিধাটা তিনিই পাবেন। ফলে তারা যে বলছেন, গ্রাহকের লোকসান হবে না – এই নিশ্চয়তা এখানে নেই। এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রচুর লোক চাকরি হারিয়ে কিংবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। সুতরাং বিদ্যুত বিভাগের সদিচ্ছা থাকলেও চলে যাওয়া ওই ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে নেওয়া অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেওয়ার  কোনই নিশ্চয়তা নেই। অন্যদিকে, যদি ধরেও নেই যে, যে-ভাড়াটিয়ারা  এখনও আগের বাসাতেই থেকে গেছেন তাদেরকে হয়রানির মধ্যে ফেলার কী অধিকার আছে বিদ্যুত বিভাগের?

মোট কথা, আমার মতো একজনের ক্ষেত্রেই যদি প্রায় ৩/৪ হাজার টাকা তারা হাতিয়ে নিয়ে থাকে তাহলে ৩ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন অংকের সমন্বয়ে কত হাজার কোটি টাকা হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। জনগণের কষ্টের টাকা তারা এভাবে আন্দাজের ভিত্তিতে গড়মিলের শিকার করতে পারে না।

তারা বলেছেন, 'যাদের বিল বেশি হয়েছে তারা অফিসে আসলে বিল ঠিক করে দেয়া হবে।' (ইউ.এন.বি নিউজ ,May 07, 2020, )

প্রশ্ন হলো আপনার অফিসে বসে আন্দাজে বিল করবেন , আর আন্দাজে বিল করার ভুলের মাসুল আপনি না দিয়ে, উল্টো গ্রাহককে দৌঁড়ঝাপ করে আপনাদের কাছে গিয়ে ঠিক করতে হবে কেন? আপনাদের ভুলের জন্য প্রথমে গ্রাহককে আর্থিকভাবে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছেন, এখন তা সমাধানের জন্য আবারও তাদেরকে আপনাদের অফিসে গিয়ে তা সমাধান করতে হবে?  বিদ্যুত বিভাগের এই অদূরদর্শিতা ও  অপেশাদারিত্ব   মানুষের মধ্যে যে –ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে তা এক কথায় নজিরবিহীন। তাদের অদক্ষতা শেষ পর্যন্ত এই সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ব্যাপকভাবে।  তাদের অদক্ষতা এমনই এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে স্বয়ং বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীর বাসা এবং  প্রতিষ্ঠানও  এই ভূতুড়ে বিল থেকে রেহাই পায়নি।  এবং এমন ঘটনাও আছে যে কয়েক মাস যাবৎ যে ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া নেই, সেই ফ্ল্যাটেও বিদ্যুত বিল এসে বসে আছে। ৩ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহককে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে বিদ্যুত বিভাগ সরকারকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।

শনিবারই দেখলাম, ভুতূড়ে বিদ্যুত বিলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শুরু হয়েছে, এটা একটা ভালো লক্ষণ। শাস্তি হবে- সেটা না হয় বুঝলাম, আপনাদের সদিচ্ছাও অনুমান করতে পারছি।  কিন্তু ইতিমধ্যেই  অতিরিক্ত বিল দিয়ে গ্রাহকদের বিপাকে ফেললেন, তারপর সমাধানের জন্য গ্রাহককে আপনাদের অফিসে যাওয়ার হয়রানিতে ফেললেন, এখন আপনারা শাস্তি দিতে যাচ্ছেন  দায়ীদেরকে। কিন্তু আপনাদের দোষে হাতিয়ে নেয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেবেন কিভাবে? আমাদের হয়রানিও বন্ধ করার কি কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?  সরকারের এত বড় একটা খাত , সেখানে কোনা দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব থাকবে না—এটা অকল্পনীয়। মানুষ যখন করোনাভাইরাসের সাথে লড়াইয়ে দিশেহারা তখন,  কোটি কোটি মানুষের সাথে হয়ারানির মতো নিষ্ঠুর খেলা তারা কিভাবে খেলতে পারেন?

তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। বিল বাড়িয়ে নেওয়ার পর সেটি আবার সমন্বয় করা মানে পাহাড় ঠেলার কাজ। ইতিমধ্যে বিদ্যুত বিভাগ প্রমাণ করেছে তারা হিসেবের কতোটা জানে! শঙ্কা হয়, সব হিসেব সমন্বয় করার নামে আরেক চোট গ্রাহকের ভোগান্তি বাড়বে বই কমবে না।

লাফঝাঁপ করে 'ডিসকো' স্টাইলে এই লেজেগোবরে পরিস্থিতি তৈরি করার চেয়ে ডেসকোর উচিৎ ছিল আন্দাজে বিল না করে একটু অপেক্ষা করা কিংবা এমন একটা পদ্ধতি বা উপায় বের করা যাতে করে সাধারণ মানুষের এই ভোগান্তিতে পড়তে না হয়।