চীন নিয়ে দোলাচলে জাপান

Published : 3 July 2020, 08:29 AM
Updated : 3 July 2020, 08:29 AM

কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে জাপান-চীন সম্পর্ক কিছুটা বৈরিতার দিকে মোড় নিয়েছে। উভয় দেশের জন্যই একটি বড় হতাশার বিষয় ছিল এপ্রিল মাসে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং এর বহুল প্রত্যাশিত জাপান সফর স্থগিত হওয়া। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বহু বছরের অশান্তি ও অনিশ্চয়তার পরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এপ্রিলে শি-কে জাপানে রাষ্ট্রীয় সফর করতে সম্মতি জানাতে সফল হন। সর্বোচ্চ চীনা নেতার জাপানে সরকারি সফর বিগত দশ বছরে একবারই হয়েছে। এমনকি শি জিন পিং-ও দশ বছরেরও বেশি ব্যবধানের পরে জাপানে তার রাষ্ট্রীয় সফর করতেন। উভয় দেশই এ সফরটির মাধ্যমে অস্থিতিশীল ভূ-কৌশলগত এশীয় পরিস্থিতিতে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে এবং তাদের সম্পর্কের এক নতুন যুগের সূচনা করতে আগ্রহী ছিল।

কিন্তু তা আর হলো না। কোভিড-১৯ সংকটের মারাত্মক প্রভাবে শি এবং আবে উভয়ই ভবিষ্যতের কোনও তারিখ প্রস্তাব না করেই এ সফর স্থগিত করতে সম্মত হন। একরকমভাবে, শি-র পরিদর্শন কোভিড-১৯ সংকটের কারণে 'দুর্ঘটনা-কবলিত' হয়ে গেছে।

তবুও দুই দেশই মহামারীর প্রথম দিকে পারষ্পারিক সহযোগিতার নীতিতে এগোচ্ছিল এবং জাপানের কয়েক শ নাগরিককে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল চীন। এছাড়া চীন বিপুল পরিমাণে প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন মুখোশ, গাউন এবং এমনকি জাপানিদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধও সরবরাহ করেছিল। 

কিন্তু শিগগিরই মার্কিন-চীন সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং কোভিড-১৯ সংকটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লুএইচও) ভূমিকার মতো কিছু ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠলে জাপান গ্যাড়াকলে পড়ে যায়। বিশেষত, প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প 'ভাইরাস সংক্রমণে চীনের ভূমিকা'র কথা বলে যে অভিযোগ তোলেন তা জাপানের বৈদেশিক নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এক বিরাট অস্বস্তি তৈরি করে।

পাশাপাশি তাইওয়ানের বিষয়টিও তাদের সম্পর্ককে আরও জটিল করতে যথেষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) মধ্যে অনেকগুলি রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছিল যা সেই সময় তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইন-ওয়েন এর পুনর্নির্বাচনে তাদের খুশির ব্যাপারটি গোপন করেননি। একথা  প্রায় সবাই জানেন, সাই ইন-ওয়েন চীনের মূল ভূখণ্ডের সাথে তাইওয়ানের একীভূত হওয়ার ঘোর বিরোধী।  

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, প্রধানমন্ত্রী আবে এবং মুখ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিহিদ সুগাসহ এলডিপি-র শীর্ষ নেতারা অনুরোধ করেছিলেন তাইওয়ানকে পর্যবেক্ষক হিসেবে ডাব্লুউএইচও এর আলোচনায় অংশ নিতে অনুমতি দেওয়া উচিত। চীন যে এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল তা বলাই বাহুল্য।

৫ মার্চ রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর জাপান সফর স্থগিতের বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। একই দিন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে বিনিয়োগ কাউন্সিলের সাথে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি সেদিন চীনের ওপর নিজ দেশের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার নির্ভরশীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চীনা সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার কারণে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রথমদিকে জাপান মুখোশ, মেডিকেল গাউন এবং ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছিল। 

উল্লেখ্য যে, জাপানে ব্যবহৃত গাউন এবং মুখোশের মত সুরক্ষা সরঞ্জামগুলোর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই চীনা ছিল। জাপানি উৎপাদনকারীরা এ পণ্যগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ঠ সুবিধা করতে পারছিল না। এবং বিস্ময়করভাবে, শার্প এর মতো কিছু বৈদ্যুতিক কোম্পানি এ ক্ষেত্রে বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেছে। এ পরিস্থিতিতে জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবে একটি নতুন নীতি অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন- যা চীনের উপর নির্ভরশীল এমন পণ্যগুলির উৎপাদন জাপানে স্থানান্তরিত করতে পারে। 

এ আওতার বাইরের পণ্যগুলোর ক্ষেত্রেও আসিয়ান জোটের মতো অন্যান্য জোটে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তাদের উত্পাদন প্রক্রিয়াকে ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষেত্রটিকে বৈচিত্র্যময় করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী।

শিগগিরই জাপানে উৎপাদন প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনার নতুন নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। প্রথমত,  ৭ এপ্রিল জাপানি সংস্থাগুলিকে জাপানে স্থানান্তরিত করতে বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষেত্রটিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে উত্সাহ দেওয়ার জন্য পরিপূরক বাজেটে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে জাপান।

দ্বিতীয়ত, একই মাসে দেশটির জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিল (এনএসসি) একটি বিশেষ অর্থনৈতিক দল গঠন করে, যাদের বছর শেষের আগেই জাতীয় অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য একটি নতুন কৌশল তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমবারের মতো, জাতীয় অর্থনৈতিক সুরক্ষার অপরিহার্যতার কথা বিবেচনায় নেওয়ার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের (এমইটিআই) একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, আবের নেওয়া নতুন এ উদ্যোগ নিয়ে চীন সরকারের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এদের অনেকেই জাপানি সংস্থাগুলোর সাথে ভবিষ্যতে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছিলেন। আবের নতুন নীতিটির অর্থ কি তবে এই যে- মহামারীর সময়ে চীন থেকে জাপানে ফিরিয়ে নেওয়া জাপানি সংস্থাগুলো আর চীনে ফিরবে না?

চীনভিত্তিক জাপানি সংস্থাগুলিকে দেশে ফিরে তাদের উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনের জন্য এই প্রথমবার বলা হচ্ছে না। চীন-জাপান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বহু পুরাতন, বৃহত্তর এবং জটিলভাবে বিস্তৃত। এমনকি শীতল যুদ্ধের তীব্রতার সময়ও, জাপানিরা বেইজিংয়ের সাথে 'সেকেই বুনরি' (রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে পৃথকীকরণ) নীতির আলোকে ব্যবসা বজায় রেখেছিল।

আজ জাপানের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার চীন এবং সেখানে হাজার হাজার জাপানি সংস্থা তাদের ব্যবসা করছে। চীনের সাথে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বহু পুরনো। এছাড়াও, বাজেটে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সীমিত বরাদ্দের মাধ্যমে জাপানি সংস্থাগুলি চীন ছেড়ে চলে যাবে- সে আশা করাও প্রায় অসম্ভব। 

আবের এবারের উদ্যোগটি নতুন না হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে জাপানের মূল দৃষ্টিভঙ্গির বহির্প্রকাশ বলা যেতে পারে। 

প্রফেসর শিন কাওশিমা পরিস্থিতি যথাযথভাবে তুলে ধরে বলেছেন: "জাপান ও চীনের মধ্যে সরবরাহের শৃংখলা অক্ষুণ্ণ থাকবে, চীনা বাজার এখনও গুরুত্বপূর্ণ এবং জাপান চীন থেকে বাজার সরিয়ে নিতে উৎসাহিত করছে না।"

চীন নীতি নিয়ে জাপান দোলাচলে রয়েছে। কেননা, জাপানকে যুক্তরাষ্ট্রের উপর তাদের সুরক্ষাজনিত নির্ভরশীলতা এবং চীন থেকে প্রাপ্ত প্রচুর অর্থনৈতিক সুবিধার মধ্য ভারসাম্য রক্ষা করতে হচ্ছে। 

হংকং এর বিষয়টি এটি প্রমাণ করার জন্য আরও একটি উদাহরণ। প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশটিতে , প্রায় ১৪০০  জাপানি সংস্থা রয়েছে। যা জাপানের মোট বাণিজ্যের ২ দশমিক ৫ শতাংশ । জাপান গত ২৮ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার সাথে যোগ দিয়ে হংকংয়ের নতুন সুরক্ষা আইন সম্পর্কে চীনকে নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়। চীনের সমালোচনা করতে জাপান যে জি-৭ গ্রুপকেও ব্যবহার করবে সেই বিষয়েও তার অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছে। 

তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটাকেই জাপানের ভারসাম্য রক্ষার কৌশল হিসেবেই দেখছেন।