শিক্ষামূলক তথ্যচিত্র নির্মাণের একটি উদ্যোগ

কাজী রহমান
Published : 16 July 2020, 04:53 PM
Updated : 16 July 2020, 04:53 PM

বর্তমান সময়ে আন্তর্জালের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়ানো। গত দু দশক ধরে বাণিজ্য, শিক্ষা, ভ্রমণ ইত্যাদি বিবিধ ক্ষেত্রে আন্তর্জাল আমাদের ওপর প্রভাব রেখেছে, করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহ দিনগুলিতে সেটির ওপর নির্ভরতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। আন্তর্জালে ওয়েবসাইটের সংখ্যা এ বছর প্রায় একশ নব্বই কোটি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, খুব জনপ্রিয় হয়েছে ইউটিউব। বিপুল তথ্যের প্লাবনে ভাসছে মানুষ। বলাই বাহুল্য, তথ্যগুলো যাচাই বাছাই করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় আন্তর্জালে যে পরিমাণ বিষয়বস্তু আছে বাংলা ভাষায় তার কিঞ্চিৎ পরিমাণেও নেই। আর যা আছে তার বেশিরভাগই হয় ইংরেজি content-এর সরাসরি অনুবাদ অথবা অপ্রতিষ্ঠিত তথ্য ও তত্ত্বের মিশ্রণে সৃষ্ট একটা কিছু যা নিতান্তই বিভ্রান্তিমূলক, তাই কোটি কোটি বাংলাভাষীদের জ্ঞানতৃষ্ণা অনেকখানি অতৃপ্তই রয়ে গেছে। তবে এটাও সত্য যে বিষয় নির্বাচন, তার মধ্যে প্রকৃত তথ্যের সম্মেলন ও সেই তথ্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপনা একটি কঠিন কাজ এবং এই কাজটির বাস্তবায়নের জন্য দরকার পেশাগত যোগ্যতা।

'থিংক বাংলা' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এই শূন্যস্থানটি পূরণ করতে উদ্যোগী হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে শিক্ষামূলক তথ্যচিত্র বানানো। এতে থিংক- এর কর্মীরা সাহায্য নিচ্ছেন নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের; তারা প্রমাণিত তত্ত্বের ও প্রতিষ্ঠিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মনোজ্ঞভাবে সেই জ্ঞানকে উপস্থাপন করছেন। ভিডিওগুলো বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার ও আনুষঙ্গিক গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি করা। কপিরাইট নীতিমালা মেনে, সৃজনশীল কনটেন্ট এবং নতুন মনকাড়া অ্যানিমেশনের মাধ্যমে জটিল বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াই থিংক বাংলা-র লক্ষ্য। বাংলা ছাড়াও থিংক ইংলিশ নামে থিংক- এর একটি ইংরেজি শাখা আছে।

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে ফেইক নিউজ ও ভুয়া তথ্যের শেয়ারিং-এর সূত্রে আমরা এক চরম তথ্যসঙ্কটে ভুগছি। কে ভেবেছিল যে গত কয়েক শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলোকপ্রাপ্তির পরেও আমাদের এই দশা হবে! যে বিজ্ঞানকে বিপদমুক্ত মনে করা হয়েছিল এই কয়েক দশক আগেও সেটিও নানান ভাবাদর্শগত টানাপড়েনে খণ্ডিত, সেই কর্তিত জ্ঞানই প্রচার হচ্ছে, প্রয়োগ হচ্ছে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্যে। এই প্রেক্ষাপটে থিংক বাংলা-র প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। প্রতিটি ভিডিওর পেছনে রয়েছে গবেষণা ও সেই বিষয়ের গবেষকদের সাক্ষাৎকার। এরপরে সেই সাক্ষাৎকারের কারিগরি ভাষাকে রূপান্তর করেন সর্বজনবোধ্য ভাষাতে। তারপর বন্যা আহমেদের সাবলীল উপস্থাপনায় ও ইব্রাহিম খলিলসহ অন্যান্য মেধাবী কর্মীর অ্যানিমেশনে সেগুলো হয়ে ওঠে চিত্তাকর্ষক, দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখে শেষ পর্যন্ত। দর্শক হয়ে ওঠেন কৌতূহলী শিক্ষার্থী, উৎসুক হন পরবর্তী ধাপে উত্তীর্ণ হতে।
আমার কাছে 'থিংক' নামটি কৌতূহল-উদ্দীপক। থিঙ্ক– ভাবো, চিন্তা কর, কৌতূহলী হও। জ্ঞান অন্বেষণের প্রথম ধাপ হল কৌতূহল এবং চিন্তা। মানুষের উত্তর খোঁজার শুরুটা হয় গভীরভাবে ভাবা থেকে – কোথায়, কেন এবং কীভাবে এত সব ঘটছে; এইসব সাধারণ প্রশ্নকে নিয়ে ভাবনার শুরুটা হচ্ছে সত্যকে খোঁজার শুরু। সেই ভাবনা থেজে আসবে জ্ঞান, সত্যের সন্ধান।

বিজ্ঞানের প্রতিটা বিষয়ের খুঁটিনাটি বোঝার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্রিটিকাল চিন্তা বা সুচারু বিশ্লেষণধর্মী মন গড়ে তোলা। অ্যারিস্টোটলের স্থির বিশ্বের ধারণা আর নেই, আমাদের মহাবিশ্ব যেমন বদলাচ্ছে – মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলাচ্ছে। আমরা তখনই জ্ঞানের পরবর্তী ধাপে উন্নীত হব যখন আমাদের সবকিছুকে জানতে চাইবার ইচ্ছে থেকে প্রশ্ন করতে পারার অভ্যাস গড়ে উঠবে। থিংক-এর ১০ মিনিটের ভিডিও থেকে হয়তো বিষয়বস্তু সম্পর্কে পুরোটা জানা সম্ভব নয়, কিন্তু সেটা দর্শকের জানবার আগ্রহের সলতেটা উস্কে দিতে পারে। 'থিংক বাংলা' চ্যানেলটির মান, বিশ্বাসযোগ্যতা ও তথ্য ইতোমধ্যে আস্থা অর্জন করেছে এর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে। যে ক'টি ভিডিও এ পর্যন্ত থিংক তৈরি করেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত তথ্যচিত্র থিংক-বাংলা প্রস্তুত করেছে তার মধ্যে রয়েছে "হিমালয় কীভাবে বদলে দিল পৃথিবী?" এতে বর্ণিত হয়েছে কেমন করে ভারতীয় টেকটনিক পাত দক্ষিণ গোলার্ধে গন্ডোয়ানা অতিমহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোটি কোটি বছর জুড়ে ভ্রমণ করে উত্তর গোলার্ধে ইউরেশিয় টেকটনিক পাতের সঙ্গে ধাক্কা খেল এবং সেই ধাক্কায় কেমন করে হিমালয় পর্বতমালা গড়ে উঠল। সুউচ্চ হিমালয় পৃথিবীর জলবায়ুকে আমূল বদলে দিল। লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=b-oFBSJJCik

ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের প্রাচীন ইতিহাস একটি সূত্রে আবদ্ধ নয়, বরং নানান বহিরাগত জাতির মিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই উপমহাদেশের বর্তমানের চিত্র। এই ইতিহাসই বলা হয়েছে "আর্যরাই কি গড়েছিল প্রাচীন ভারত?"

(লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=sCgofiPoeew)

গত কয়েক শত বছরের জীবাশ্মবিদদের গবেষণায় ডাইনোসরদের সম্পর্কে যত তথ্য বেরিয়ে এসেছে, সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই প্রাণীটাকে নিয়ে ততই বদলেছে আমাদের ধারণা। সাথে সাথে বদলে গেছে সিনেমায় বা ছবিতে তাদের চরিত্র। সিনেমা, আর্টসহ বিভিন্ন শিল্প মাধ্যম এবং ডাইনো-বিজ্ঞান কিভাবে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করে, সেটা নিয়েই 'থিংক' এর তথ্যচিত্র "সিনেমায় ডাইনোসরের বিবর্তন"।

(লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=r1EQsY1me6w)

যে হাই হিল জুতা শুরু হয়ে ছিল পুরুষের ফ্যাশন হিসেবে, তা কীভাবে একান্তই নারীর শোভা হয়ে উঠল, এবং আজকের নারীরা এই ফ্যাশন চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কীভাবে সরব হচ্ছেন, সেই ইতিহাস বলা হয়েছে এই ভিডিওতে "হাই হিল: পুরুষের পা থেকে নারীদের পায়ে"।

(লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=pQXSDVqRfUU)

আমাদের সূর্য কীভাবে জ্বলছে, কোটি কোটি বছর ধরে নিজেকে কীভাবে জ্বালিয়ে রাখছে, নিভে যাচ্ছে না, তাই বর্ণীত হয়েছে "সূর্য কেন নিভে যায় না" ভিডিওতে।

(লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=My8jNH13z_4&t=429s)

আমাদের সূর্যের শেষ পরিণতি কী? লাল দানব থেকে শ্বেত বামন হয়ে কৃষ্ণ বামন হবার এই সুদীর্ঘ ও চমকপ্রদ সময়কে এই ভিডিওতে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলা কেন ইংরেজিতেও সূর্যের এই বিবর্তনকে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কোথাও বলা হয়নি। নতুন অ্যানিমেশন ও সুললিত বর্ণনায় এই কাজটি আকর্ষণীয় হয়েছে।

(লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=n7o8QeRT8Zs&t=167s)

মানুষ কি চাঁদে গিয়েছিল? ষড়যন্ত্রতত্ত্ব! বর্তমানে চাঁদে মানুষ যায়নি এমন ধরনের ভুল তথ্য দিয়ে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে সেই সংবাদটিকে শিরোনামে করে এই ভিডিওটি তৈরি। চাঁদে মানুষ অভিযানের বিভিন্ন তথ্য ও প্রমাণে এই কাজটি সমৃদ্ধ। https://www.youtube.com/watch?v=ydFjDDrSToU

বর্তমান করোনা ভাইরাস দুর্যোগ নিয়ে Think বাংলা বেশ কিছু তথ্যচিত্র প্রস্তুত করেছে। তার মধ্যে রয়েছে "করোনাভাইরাস: গুজব ও বিভ্রান্তি", "করোনাভাইরাস: কীভাবে আমাদের কোষ হাইজ্যাক করে",
"করোনাভাইরাস: আপনিই পারেন সংক্রমণ থামাতে", "করোনাভাইরাস: কী কী জানা দরকার"। এছাড়া করোনা সময়ে সরাসরি শ্রমজীবী মানুষের কাহিনী নিয়ে একটি ছয় মিনিটের ভিডিও করা হয়েছে। নাম হল নিছক করোনার গল্প। লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=F8Niyz2YvOM&t=3s