এম আর আখতার মুকুল: বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল ‘মাস্টোর’

স্বদেশ রায়
Published : 26 June 2020, 10:13 AM
Updated : 26 June 2020, 10:13 AM

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু প্রায়ই লাঞ্চ শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে সিনিয়র কয়েকজন সাংবাদিককে ডাকতেন। ফয়েজ আহমদ, এম আর আখতার মুকুল, আব্দুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ প্রায়ই এ ডাক পেতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের এজেন্সি, দলীয় নেতা কর্মীদের বাইরে তার বিশ্বস্ত সাংবাদিকদের কাছ থেকে দেশের বাস্তব অবস্থার খোঁজখবর নিতেন। আর এরাও বঙ্গবন্ধুর এই আস্থার মূল্য দিতেন। তারা নানানভাবে দেশের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন। এমনই একটি আলাপকালে একদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আচ্ছা তোরা বলতো আমার পরে কে?' উপস্থিত কেউ উত্তর দিয়েছিলেন, শেখ ফজলুল হক মনি, কেউ বলেছিলেন, শেখ কামাল। এম আর আখতার মুকুল নিশ্চুপ ছিলেন প্রথমে। বঙ্গবন্ধু তাকে ঠাট্টা করে বলেন, 'কী, আমার পলিটিক্যাল মাস্টোর (বঙ্গবন্ধু অনেক সময় মাস্টারকে মাস্টোর বলতেন হাস্যচ্ছলে) চুপ কেন?' এম আর আখতার মুকুল তখন বলেন, 'বঙ্গবন্ধু, যদি অভয় দেন তো বলি। বঙ্গবন্ধু হেসে বলেন, 'তোকে কবে আমি কথা বলতে নিষেধ করেছি। বল তুই কী বলতে চাস।' তখন এম আর আখতার মুকুল বলেন,' রাজনীতিতে কার পরে কে, এটা কখনই বলা যায় না। যেমন দেখুন না আপনার নিজের ক্ষেত্রে, সোহরাওয়ার্দীর পরে তো আপনার আসার কথা ছিল না। আপনার পরে তো আতাউর রহমান খান ছিলেন, সালাম সাহেব ছিলেন, রাজশাহীর মুজিবুর রহমান ছিলেন কিন্তু আপনি সবাইকে ডিঙ্গিয়ে চলে এলেন। এবং নিজে ইতিহাস সৃষ্টি করেই এই আসনে আসলেন।' বঙ্গবন্ধু মাথা চুলকে বললেন, 'এই জন্যেই তো তোকে আমার পলিটিক্যাল মাস্টোর বলি। কোথাকার পানি কোথায় নিয়ে গেলি।' এম আর আখতার মুকুল ভাই পরবর্তী সময়ে আড্ডায় বলেছেন, সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বলিনি ঠিকই, তবে এটাই তো পানির ধর্ম। আসলে পানি যে কোথা থেকে কোথায় গড়াবে কেউ বলতে পারে না। এম আর আখতার মুকুল ভাই নেই আজ ষোল বছর। আজ ২৬ জুন তার মৃত্যুর ষোল বছর পূর্ণ হবে। এ সময়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের টানা বারো বছর আর আগের পাঁচ বছর মিলে ১৭ বছর সফল প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার দিকে তাকালে সত্যি মনে হয় এম আর আখতার মুকুল রাজনীতি বিশ্লেষণে কতটা সঠিক ছিলেন।

শুধু রাজনীতি নয় বাস্তব জীবনে এম আর আখতার মুকুল ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববাদী এবং জীবন সম্পর্কে সীমাহীন অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ একজন মানুষ। তাছাড়া একজন সফল সাংবাদিককে সব সময়ই ভালো সমাজবিজ্ঞানী হতে হয় যার সর্বোচ্চ প্রকাশ আমাদের জীবদ্দশায় আমরা লেখক সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিন ও লেখক সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল এর ভেতর দেখেছি। মানুষ ও সমাজকে এত বেশি চিনতেন তারা তাই মানুষের, সমাজের ও রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে কখনই এদের কোনো ভুল মন্তব্য করতে দেখেনি। যেমন আবু জাফর শামসুদ্দিন এরশাদ পতনের অনেক আগেই লিখেছিলেন, এরশাদ পতনের পর তারই রেপ্লিকা ক্ষমতায় আসবে। তার কারণ, সামরিক ও বেসামরিক আমলরা আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করবে না। সত্যিই এরশাদ পতনের পরে ৯১-এ জিয়া, এরশাদের রেপ্লিকা খালেদা জিয়াই ক্ষমতায় এসেছিলেন। আবার আবার ৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পরে একদিন বিকেলে সাগর পাবলিশার্সে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময়ে তৎকালীন বিএনপি'র তথ্যমন্ত্রী শামসুল ইসলাম (শামসুল ইসলাম ব্যক্তি জীবনে এম আর আখতার মুকুলের বন্ধু ছিলেন এবং খুবই পড়াশুনা করতেন, সাগর পাবলিশার্স তার প্রায় নিত্যদিনের স্থান ছিল) আসেন। শামসুল ইসলাম ঢুকেই এম আর আখতার মুকুলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'কি তোমাদের খবর কি?' এম আর আখতার মুকুল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, 'আঁচাচ্ছে।' এম আর আখতার মুকুলের উত্তর শুনে শামসুল ইসলামের কপালে একটু ভাঁজ পড়ল। তারপরে তিনি বললেন, 'আরে রাখো।' আমরা উপস্থিত কয়েকজন ঠিক তাদের কথার অর্থ বুঝতে পারছিলাম না। এম আর আখতার মুকুলের তীক্ষ্ম চোখে সেটা বাদ যায়নি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী তুমি এত সুন্দরবন, সুন্দরবন করো- তুমি বোঝ না? আমি জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে তাকে বলি, ভাই আঁচাচ্ছে মানে কি। তিনি বলেন, 'সুন্দরবন গেছ কতবার?' হেসে উত্তর দেই, 'ভাই ঠিক হিসেব নেই, তবে অনেকবার।' তিনি বলেন, 'সুন্দরবনের ভেতর বাঘ দেখেছো?' বলি, 'হ্যা দেখেছি।' তিনি তখন বলেন, 'বাঘ শিকার মিস হবার পরে কি করে তা দেখেছো?' বলি, 'না, সেটা দেখার কখনো সুযোগ হয়নি।' তিনি বলেন, 'তবে শোনো কি করে। বাঘ শিকার মিস করার পরে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকে। তারপরে এক সময়ে তার ঝিম কেটে যায়। এবার বলো, তারপরে কী করে, তারপরে কী করে জানো। পায়ের নখগুলো জিহ্বা দিয়ে চাটে, গাছের গায়ে নখ টানে। এই জিহবা দিয়ে চাটা আর গাছের গায়ে নখ টানাকে কী বলে জানো। এটাই বলে আঁচানো। এটা সুন্দরবনের বাওলীদের ভাষা। আমি চরমপত্র করা লোক। আমি সারা দেশের ভাষা জানি।'

তখন মুকুল ভাইয়ের দিকে আরো জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে বলি, 'কিন্তু মুকুল ভাই আপনার কাছে ইসলাম ভাই জানতে চাইলেন, আপনার খবর কি আর আপনি বললেন, আঁচাচ্ছে।' মুকুল ভাই এবার আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, 'দেখ আমি আবার বলি, আমি চরমপত্র করা লোক। তোমার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার কথার অর্থ বুঝে গেছো। কিন্তু তারপরেও সবার সামনে খোলসা করতে চাও, আচ্ছা শোনো, উনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আওয়ামী লীগের খবর কী? আর আওয়ামী লীগের এখন কী খবর জানো? আওয়ামী লীগ এখন আঁচাচ্ছে। ৯১-এ তার শিকার মিস গেছে। সে কিছুদিন ঝিম ধরে ছিল। এখন সে নিজেই তার নখ ধারালো করছে। আর এর পরে বিএনপিকে এমন একটা থাবা দেবে- তাতেই বিএনপি কাৎ।' এম আর আখতার মুকুলের কথা মিথ্যে হয়নি। সত্যি এরপর পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ, একের পর এক কঠোর হরতাল, রাজপথে হাজারো লোক আর শেষ পর্যন্ত জনতার মঞ্চ করে বিএনপিকে বাঘের মতই থাবা দেয় আওয়ামী লীগ। আর সেই থাবাতে বিএনপি নিজেরাই এক রাতের মধ্যে আইন পাশ করে পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করে চলে আসতে বাধ্য হয়। এখানেই ছিল সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য। এখান থেকেই বোঝা যায় কেন ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বজ্রকন্ঠের পরে সবথেকে জনপ্রিয় হয় এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র।

এম আর আখতার মুকুল ভাইকে একদিন জিজ্ঞেস করি, 'মুকুল ভাই আপনার পড়ার ভঙ্গিমা তো আছেই তারপরেও আপনি কি মনে করেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আপনার চরমপত্র কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল দেশের মানুষের কাছে?' তিনি আমাকে বলেন, 'শোনো, সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য কি? মূল্য উদ্দেশ্য মানুষকে সত্য জানানো। মানুষকে কিছু সঠিক তথ্য দেয়া। তাই তুমি কলাম লেখ, কথিকা লেখ আর রিপোর্ট লেখ সবকিছুর মাধ্যমে তোমাকে কিছু সঠিক তথ্য মানুষকে দিতে হবে। শুধু কথার ফুলঝুরি আর মন্তব্য থাকলে মানুষ সেটা গ্রহণ করে না। আমার চরমপত্রের সব থেকে বড় দিক ছিল প্রতিটি চরমপত্রে কিছু সঠিক তথ্য থাকত, যুদ্ধের সঠিক খবর থাকত। প্রপাগান্ডা যে থাকত না তা নয়। ওটা যুদ্ধের পার্ট। তবে আমি সব সময়ে কিছু সঠিক তথ্য দেবার চেষ্টা করে গেছি। সেটা আমি রণাঙ্গনে যোগাযোগ রেখে জোগাড় করতাম, বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রেখে জোগাড় করতাম- এমনকি ভারতের সামরিক ও বেসামরিক উচ্চ আমলা পর্যায়ে যোগাযোগ রেখে জোগাড় করতাম। আর সঠিক তথ্যগুলো মিলে যেত বলেই মানুষ দিনে দিনে চরমপত্রই গ্রহণ করে।'

এম আর আখতার মুকুলের জীবন বড় বৈচিত্রময় জীবন। তার জীবনের একটা অংশ তার লেখা রূপালী বাতাস সোনালী আকাশ পড়লে জানা যায়। সম্ভবত এটা চিত্রালীতে ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিল। আসলে বাস্তবে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এসে যেমন রিপোর্টার থেকে সম্পাদক পর্যন্ত হন এম আর আখতার মুকুল তেমনি সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন শাখা থেকে জেনারেল ম্যানেজারি পর্যন্ত করেছেন। আবার কখনো কখনো রাজরোষের কারণে তাকে সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যবসা করতে হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে তিনি বিড়ির ব্যবসা, চালের ব্যবসা থেকে শুরু করে বাস ব্যবসা অবধি সবই করেছেন। এই ব্যবসা করতে গিয়েও কিন্তু তিনি তার সাংবাদিকতার চোখকে বিসর্জন দেননি। বরং সেখান থেকেও তিনি অর্জন করেছেন সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা। তিনি বাসের ব্যবসা করতে গিয়ে গভীরভাবে পরিচিত হন লঙ রুটের বাস ও ট্রাক ড্রাইভারদের জীবন নিয়ে। যে জীবনের গল্প শুনে আমি এতই আকৃষ্ট হয়েছিলাম যে তাদের জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখব বলে অনেকদিন কাজ করি তাদের জীবনের ওপর। আর কাজ করার সময় মনে হতো এখানে এসে আমি নতুন আর কী পাচ্ছি, সবই তো শুনেছি এম আর আখতার মুকুল ভাই এর কাছে।

জীবনের নানান চড়াই উৎরাই পার হলেও এম আর আখতার মুকুলের মতো সৌভাগ্যবান মানুষ বাংলাদেশে খুবই কম জন্মেছেন। তিনি আমাদের ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনের সেই মূল ৯ নেতার একজন। তিনি ৫৪-এর নির্বাচনের একজন নিবেদিত কর্মী। ৬৬-এর ছয় দফার একজন সর্বোচ্চ সমর্থক সাংবাদিক। ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমদের নির্বাচনী প্রচারের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত একজন নেতা, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুধু একজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি চরমপত্রের স্রষ্টা। আমাদের আজ যারা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক শুধু তাদেরই নয়, প্রতিটি তরুণ-তরুণীর দায় রয়েছে এম আর আখতার মুকুলকে জানা। তাকে না জানলে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে জানা অনেকখানি অপূর্ণ রয়ে যাবে। তার এই প্রয়াণ দিবসে তাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। আর বলতে পারি, মুকুল ভাই আপনাকে ভোলার কোনো পথ আপনি রেখে যাননি। আপনার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।