এবার ঈদে করোনাভাইরাস-ই যাবে বাড়ি!

তুরিন আফরোজ
Published : 20 May 2020, 04:14 PM
Updated : 20 May 2020, 04:14 PM

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ গত রোববার (১৭ মে ২০২০) আড়াই ঘণ্টা ধরে মাঠ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন। সেই কনফারেন্সে তিনি বলেছেন, "ছুটিতে অনেকেই গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। তা ঠিক হবে না। এটি কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রী জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য যে সব নির্দেশনা দিয়েছেন, তা সকলকে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি রোগী এখন আছে ঢাকায়; তাই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এবার ঈদে যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই থাকার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।" 

১৭ মে তারিখের ভিডিও কনফারেন্সে আইজিপি বেনজীর আহমেদ জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে ঈদের সময় অন্য বারের মতো বাড়ি যাওয়া ঠেকাতে পুলিশ এবার কঠোর থাকবে। তিনি আরও বলেন, "সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত যেন কোনোভাবেই ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় এবং ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে কেউ যেতে না পারে। একইভাবে প্রতিটি জেলা ও মহানগরীও জনস্বার্থে কঠোরভাবে এ বিষয়টি বাস্তবায়ন করবে।" 

যেহেতু করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ঢাকা শহরেই সব চাইতে বেশি তাই এই ঢাকা অবরোধের ঘোষণা সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত জরুরী। এই সিদ্ধান্ত যে নিতান্তই জনস্বার্থে নেয়া সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ নেই। আমরা সকলেই চাই, এই মুহূর্তে ঢাকা থেকে লোকজন নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি না করে। তাই, ঈদে মানুষের বাড়ি ফেরা  প্রতিহত করা জনস্বার্থে নেয়া সরকারের একটি সিদ্ধান্ত।    

অথচ এই ঘোষণা আসার ঠিক পরদিনই (১৮ মে ) আমরা দেখলাম এক বিচিত্র চিত্র! কাতারে কাতারে মানুষ সরকারী নির্দেশ উপেক্ষা করে ঢাকা শহর ত্যাগ করছে ঈদ উদযাপন করার জন্য। কী ভয়াবহ এক পরিস্থিতি! যখন করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা উর্ধ্মূখী, ঠিক তখনই এ ধরনের আত্মঘাতীমূলক আচরণ আমাদের জন্য চরম দুর্দশা ডেকে আনবে। রাষ্ট্র যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হবে, তখন এই আমরাই কিন্তু সরকারের সমালোচনায় তীব্রভাবে লিপ্ত হব। কিন্তু দোষটা আসলে কার?

অনেকেই ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছেন, এই যে এত লোক "অবরুদ্ধ ঢাকা" ত্যাগ করছে, তার বিরুদ্ধে পুলিশ কেন কোন কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না? পুলিশ কেন মেরে-পিটিয়ে তাদের ঢাকা শহরের খোঁয়াড়ে ঢুকাচ্ছে না? সরকারের উচিৎ এই মুহুর্তে পুলিশ-আর্মি দিয়ে "ঢাকা-অবরোধ" কার্যকর করা। আর তা না পারলে করোনা মহামারী কালে দেশের মঙ্গল হবে কী করে? পুলিশ-প্রশাসনের এই নির্বিকার ভূমিকা কিছুতেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। কী বলবেন আইজিপি বেনজীর আহমেদ?

কিন্তু সত্যি-ই যদি সরকার-পুলিশ-প্রশাসন এই মুহুর্তে কট্টরপন্থী উপায়ে ঢাকা-অবরোধ কর্মসূচী সফল করতে উদ্যোগী হয়, তাহলে কী কী ঘটতে পারে? সমালোচনার ঝড় বইবে অনেকটা এরকম- 

প্রথমত, এই সরকার একটি অথর্ব এবং ব্যর্থ সরকার। কোন কাজ-ই ঠিক মত করতে পারেনা। কথিত ত্রাণ চুরি আর দূর্নীতি করতে যেমন ওস্তাদ, ঠিক তেমন-ই নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী। মানুষ ঈদে বাড়ি যাবে, এটা তাদের মৌলিক অধিকার। সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিকদের চলাফেরার স্বাধীনতা রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৩৬)। কিন্তু সরকার ঢাকা-অবরোধ কর্মসূচি কঠোরভাবে কার্যকরী করার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে। 

দ্বিতীয়ত, ঈদ একটি ধর্মীয় উৎসব। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য ঈদ পালন করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক মাস সিয়াম সাধনা করে করোনার জন্য জনগণ যদি পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ঈদ-ই না করতে পারে তবে আর এই জীবনের মূল্য কী? আর বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রতিটি নাগরিকের-ই ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের অধিকার রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৪১)। অতএব, এই সরকার ঢাকা-অবরোধ কর্মসূচি কঠোরভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার হরণ করছে।

তৃতীয়ত, এই সরকার ইসলাম ধর্মের শত্রু। করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে দেয় না। এখন মুসলমানরা যাতে ঠিক মত আনন্দের সাথে ঈদ পালন করতে না পারে তার জন্য নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে উদ্যত হয়েছে। কই, পূজা বা বড়দিনে এমন কোন "অবরোধ কর্মসূচি" গ্রহণ করতে তো দেখিনা! এই ধর্মীয় বৈষম্য সংবিধান বিরোধী (অনুচ্ছেদ ২৮)। তাছাড়া, এই সরকার চায় আমরা প্রতিবেশী ভারতের মত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হই। হিন্দু তোষণ না করলে এই সরকারের চলে না। প্রকৃতপক্ষে ভারতকে খুশি করতে, মুসলমানদের ঈদ এর আনন্দকে ম্লান করতেই এই প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই সরকারের বিরূদ্ধে এই মুহূর্তে প্রত্যেক সাচ্চা মুসলমানের "জিহাদ" ঘোষণা করা উচিৎ।

চতুর্থত, এই সরকার একটি জালিম সরকার। সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার তোয়াক্কা করে না। আর্মি-পুলিশ দিয়ে ক্ষমতায় টিকে আছে। সুযোগ পেলেই সংবিধান স্বীকৃত ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে চলেছে (অনুচ্ছেদ ৩২)। এভাবে এই সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হবে না। দরকার হলে এই মুহুর্তে আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে হবে।    

আশ্চর্য এক জাতি আমরা! আমাদের মূল সমস্যা গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের নিগূঢ় ভালবাসা। কিন্তু গণতন্ত্রকে ধারণ করার মত পরিপক্কতা আমাদের এখনও হয়নি। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে আমাদের সুশীলগন সারাক্ষন শুধু বিভেদের রাজনীতিকে উস্কে দিতে ব্যস্ত। "সব দোষ নন্দ ঘোষ" মার্কা যুক্তি দিয়ে সুযোগ পেলেই সরকারের তুলো ধূনো করছেন। তাঁদের মতে চলমান মহামারীর মূল কারণ মোটেও করোনাভাইরাস নয় বরং "আওয়ামী লীগ সরকার"। তাঁরা আরও বলেন, আজ যদি দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র (!) থাকতো, আজ যদি দেশে শতভাগ অংশ গ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন হতো, তাহলে বাংলাদেশে করোনা মহামারী দেখা দিত না। কি হাস্যকর যুক্তি! করোনা মহামারী তথাকথিত পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ সমূহতেও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি অথবা প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, কোন রাষ্ট্রই করোনা ভাইরাসের মরণ কামড় থেকে বাঁচতে পারেনি।     

আর ওদিকে আমাদের সরকার-প্রশাসন-নীতি-পরামর্শকগণ জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ। তাই গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে সরকার জনগণের উদ্ভ্রান্ত ও আত্মঘাতী আচরণের সাথে আপোষকামি না হয়ে পারে না। সরকার চাইলে কঠোর হতেই পারে, আইজিপি বেনজীর আহমেদকে যতদুর এই জাতি চিনে তাতে তাঁর কাছে অসম্ভবকে সম্ভব করা মোটেই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার নয়। বেনজীর সাহেবের নজিরবিহীন সফলতার ঝুড়ি অনেক ভারী। কিন্তু আজ করোনাভাইরাসের মত ভয়াবহ মহামারী রোধে তাঁকে আবেগী সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না। যে যতই সমালোচনা করুক, যে যতই মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলুক, দিন শেষে জনগণের বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষার দ্বায়ীত্ব রাষ্ট্রের তথা সরকারের ওপরই বর্তায়। তাহলে আইজিপি বেনজীর আহমেদ কেন পারছেন না "ঢাকা-অবরোধ" কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে? সরকার নিরব দর্শকের ভূমিকায় কেন?

আসলে সরকার এবং সরকার-বিরোধী, দু'পক্ষই বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে চান। জনপ্রিয়তা অর্জনে ও রক্ষায় কেউ কাউকে ছাড় দিতে চান না। এতে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ ব্যাহত হচ্ছে সেটা কারো মাথায় আসছে না। আর জনগণ? সার্কাসের সিংহের মত, ড্রামের তালে তালে অগ্নিবলয়ের মাঝ দিয়ে লাফের পর লাফ দিয়ে বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে। করোনা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। আসন্ন ঈদ উদযাপনের পর করোনা পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে তা আমরা কেউ কি অনুমান করতে পারছি? আমরা কি জানি না আজকের (২০ মে) তারিখে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ১৬০০ ছাড়িয়েছে? কিন্তু তবুও আমাদের ঈদের আনন্দে সামান্য ঘাটতি হলে চলবে না। আমরা ঢাকা ছেড়ে যে যার গ্রামে ঈদ করতে যাব, ঈদের কোলাকুলির মধ্যে দিয়ে করোনাকে ছড়িয়ে দেব আপনজনদের মাঝে। 

এবার ঈদে তাই মানুষ নয়, করোনা-ই যাবে বাড়ি!