ভাইরাসের বিশ্বায়ন ও পরিবর্তিত বিশ্ব

তারিক হাসান
Published : 2 May 2020, 12:52 PM
Updated : 2 May 2020, 12:52 PM

নব্বই এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পতনের পর যখন এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠে তখনই গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন ধারণাটি ব্যাপক আলোচনায় আসেI এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী পশ্চিম ইউরোপের ধনী রাষ্ট্রগুলো বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য, বাজার, পুঁজি, বিনিয়োগ, তথ্য ও সংস্কৃতির উপর নিজেদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিশ্ববাসীর সামনে বিশ্বায়নের প্রেসক্রিপশন উপস্থাপন করে এবং ক্রমান্বয়ে তা কার্যকরও করেI এতে করে পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে  বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত উপাদান 'করোনাভাইরাস' এবং এর বিশ্বায়নI বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অন্যান্য অনুষঙ্গ ও উপাদানের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হওয়া উপাদানটির চাহিদাগত একটি পার্থক্য রয়েছে; ইতোমধ্যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকর উপাদানগুলো নিয়ে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও পুঁজিবাদী বিশ্বের ছিল অপরিসীম আগ্রহI কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত উপাদান 'করোনাভাইরাস' নামের এই মরণ ঘাতকের বিশ্বায়ন চায়নি কেউইI কিছু রাষ্ট্র পুঁজি ও বাণিজ্যের বিশ্বায়ন চাইলেও কিছু রাষ্ট্র চায়নিI কিন্তু কোনো রাষ্ট্রই চায়নি এই মরণ ঘাতকের বিশ্বায়নI প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর; বিশ্বব্যাপী প্রথমবারের মতো একটি বিষয়ে ঐকমত্য দেখা গেলেও কারও চাওয়া না চাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে এই ভাইরাস বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে নিজেকে বিশ্বায়িত করেছে আপন গতিতেI

অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নে ধনী রাষ্ট্রগুলো ব্যাপক সাফল্য নিজেদের ঘরে তুললেও ভাইরাসের বিশ্বায়ন তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে যা  সামাল দিতে কতটা সফল হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে নাI বিশ্বায়নের সব উপাদানগুলোতে ছিল গতিশীলতা; তবে নতুন সংযোজিত উপাদান 'ভাইরাস' বিশ্বায়িত হয়েছে অতি দ্রুত কিন্তু থামিয়ে দিয়েছে সমগ্র বিশ্বের গতিকেI তাই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রই ভাইরাসের বিশ্বায়নকে স্বাগত না জানালেও প্রতিহত করতে পারেনিI

ভাইরাসের বিশ্বায়ন এর সূতিকাগার চীনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনিI স্বল্প প্রাণহানির পাশাপাশি অর্থনীতিতে যৎসামান্য যে প্রভাব ফেলেছিল চীন তা দ্রুত কাটিয়ে উঠে বরং অর্থনীতিতে নতুন করে গতি সঞ্চার করেছে যা পশ্চিমা বিশ্বকে হতবাক করেছেI অন্যদিকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র ভাইরাসের বিশ্বায়ন এর ধাক্কায় বেসামালI নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষতি সামাল দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক সময় ও মূল্য দিতে হবেI

নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদারীকরণের মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ ও চীন নিজেদের অবস্থানকে এতটাই শক্তিশালী করেছিল যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি অর্থনীতির দেশগুলো তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় যাবার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেI ভাইরাসের বিশ্বায়ন নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন ঘটাবে বলেই পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেনI সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ দিন ধরেই বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির একক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলI অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠন, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিও-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখে আসছিলI

ভাইরাসের বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী যে নতুন মাত্রাগুলো পরিলক্ষিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে সেগুলো হল- 

এক. চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বের নতুন মাত্রা; 

দুই. বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা; 

তিন. বেকারত্ব বৃদ্ধি ও তীব্র খাদ্য সংকট; 

চার. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ধস; 

পাঁচ. আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের সংকোচন;

ছয়. রেমিটেন্স নির্ভর দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট;

সাত. জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব সংকট; 

আট. দুর্যোগে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারষ্পারিক অসহযোগিতার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব সংকট; 

নয়. বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ এর ভূমিকা কমে যাওয়া ও

দশ. আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মেরুকরণI

সর্বোপরি ভাইরাসের বিশ্বায়ন যে প্রশ্নটি বিশ্ববাসীর সামনে এনে দিয়েছে তা হল বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে কি থাকবে না। নিয়ন্ত্রণের লাগাম কি চীনের হাতে চলে যাচ্ছে কিনাI চীন অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যকে খর্ব করার জন্য বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেI বিশ্ব বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় ইতোমধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে পিছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে গেছেI এর মাঝেই বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রকের জায়গাটি চীন নিজেদের করে নিবে বলে মনে করা হচ্ছেI

ভাইরাসের বিশ্বায়ন বিশ্বে ক্ষমতার নতুন মেরুকরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছেI বিশ্বব্যাপী তৈরী পণ্য এবং শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সরবরাহ চেইনের প্রায় ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যে চীনের দখলেI যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্য ও ইইউ এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো ভাইরাসের বিশ্বায়নের আগ্রাসনে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ বেকারত্ব, খাদ্য সমস্যা, পুঁজি সংকট, বাণিজ্য ঘাটতি, শিল্প উৎপাদন, বাজেট ঘাটতিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেI নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই রাষ্ট্রগুলোর দীর্ঘদিনের আধিপত্য ও প্রাধান্য ক্ষুণ্ণ হবে I বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, বাণিজ্যিক চুক্তি এবং জলবায়ু উন্নয়ন ও বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের মতো বৈশ্বিক উদ্যোগগুলোর উপর নিজেদের অর্থ সঙ্কটের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হবেI ফলে চীনের সামনে অবারিত হবে নিজের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করারI  

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্রকল্প সাহায্য, কারিগরি সাহায্য, বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চীন ইতোমধ্যে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেI ২০১৫ সনে চীনের নেতৃত্বে ব্রিকস এর সদস্য রাষ্ট্র চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও সাউথ আফ্রিকা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এনডিবি নামে যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে ক্রমান্বয়ে এর কর্মপরিধি ও সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হবে বলে বলা হচ্ছেI এই ব্যাংক শক্তিশালী হলে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ দুর্বল হয়ে পড়বে যা প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কমাবে; কারণ সবাই জানে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ এর উপর যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকায় বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রই যুক্তরাষ্ট্রকে সমীহ করেI

ভাইরাসের বিশ্বায়ন বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বিশ্বের আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিতেও নতুন মাত্রা যুক্ত করবে এবং সেখানেও মুখ্য ভূমিকায় থাকবে চীনI বিশ্বের অনেক দেশই নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি চীনমুখী করে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হবেI ভাইরাসের বিশ্বায়ন পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কূটনীতিতেও পরিবর্তন আসবেI দক্ষিণ এশিয়ায় সঙ্গত কারণেই চীনের প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকবে ভারতI ভারতও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীনমুখী পররাষ্ট্রনীতিকে প্রাধান্য দিবে বলেই মনে করা হচ্ছেI

চীন-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাথে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারেI তাই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতি প্রকৃতি নির্ণয়ে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবেI এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতিকেই সব রাষ্ট্র প্রাধান্য দিয়ে আসছেI ভাইরাসের বিশ্বায়ন পরবর্তী বিশ্বে চীনকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক কূটনীতি সাজানো অসম্ভবI বাংলাদেশকে তাই এখনই চীনের সাথে সম্পর্কের গতি প্রকৃতি নির্ণয়ে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবেI