গণস্বাস্থ্যের করোনাভাইরাস শনাক্তকারী কিট নিয়ে সংশয় কেন?

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 26 April 2020, 04:20 PM
Updated : 26 April 2020, 04:20 PM

করোনাভাইরাস শনাক্তে রোগী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত টেস্টিং কিট 'জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট' যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করেছে বলে গণমাধ্যমের খবর এসেছে (সূত্র-১)। 

তবে গণস্বাস্থ্য দাবি করেছে, সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিএসএমএমইউ, আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি কাছে এই কিট সরবরাহ করার কথা থাকলেও তারা আসেননি।

তাদের এই হস্তান্তর অনুষ্ঠানটি ফেইসবুক লাইভে (সূত্র-২) মাধ্যমে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। গণস্বাস্থ্যের বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে এই কাজে যুক্ত রয়েছেন ফিরোজ আহমেদ, নিহাদ আদনান, মোহাম্মদ রাইদ জমিরুদ্দিন ও মুহিব উল্লাহ খোন্দকার।

উদ্ভাবিত কিটের গবেষণা দলের প্রধান বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল সাংবাদিকদের বার বার বলার চেষ্টা করেছেন যে তাদের উদ্ভাবিত 'অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন' এই দুইটির সমন্বয় করে কিট তৈরি করা হয়েছে। এটি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সুনির্দিষ্টভাবে করোনা-রোগী শনাক্ত করতে সম্ভব।" এই নতুন কিটের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে করোনাভাইরাস শনাক্তে একশ ভাগ সফলতা পাওয়ার দাবি করেন তিনি।

দেশের বিজ্ঞানীদের তৈরি এই কিট আমাদের আশার আলো হিসেবে দেখা উচিত ছিল। সারা বিশ্বে সেরোলজিক্যাল টেস্ট যখন ১০-১৫ মিনিটে হয়, তখন গণস্বাস্থ্যের এই ধরনের কিটে ৫ মিনিটে করতে পারাটা সত্যি অনেক বড় প্রাপ্তি ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে সারা দেশে এই কিটের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা সরকারের উদাসীনতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। 

অনেকে বলছেন, সরকার রাজনৈতিক কারণে গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে মশকরা শুরু করেছে। আবার অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, এই কিটের উদ্ভাবন রহস্য নিয়ে। আবেগের বানে ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। 

বিজ্ঞানে আবেগের কোনও স্থান নেই, নেই কোনও রাজনীতির মহারথিদের অবস্থান। বিজ্ঞান চায় শুধু প্রমাণ ও যৌক্তিক আলোচনা। আমাদের এই আবেগীয় আলোচনা শুরুর আগে কিছু মৌলিক আলোচনার প্রয়োজন আছে। এরপর না হয় আলোচনা করা যাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট নিয়ে।

সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ নির্ণয় এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলো পিসিআর। এর বাইরে আরও কিছু ডায়াগনোসিস পদ্ধতি চালু হয়েছে যেগুলোকে আমরা সেরোলজিক্যাল টেস্ট হিসেবে জানি। 

আরটিপিসিআর

সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ শনাক্তকরণে যে পদ্ধতিটিকে 'গোল্ড স্টান্ডার্ড' হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা হলো রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিয়াকশন (আরটিপিসিআর)। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের যখন করোনাভাইরাস প্রবেশ করে তখন এই ভাইরাস তাদের আরএনএ (রাইবোনিউক্লিক এসিড) প্রতিলিপি সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। আর এই আরএনএ শরীরের অন্যান্য অংশের চেয়ে গলা ও নাকেই বেশি প্রতিলিপি তৈরি করে। আরটিপিসিআর করার জন্য সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির শ্লেষ্মা বা কফ নিয়ে পরবর্তীতে ল্যাবে এক্সট্রাকশন করা হয়। নমুনা থেকে আরএনএ-ই বের করতে আধঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টার মত সময় লাগে। পরবর্তী এ আরএনএ ভাইরাসের নিউক্লিও টাইট এর কিছু অংশ সাধারণত ২২-৫০ নিউক্লিও টাইট নিয়ে প্রাইমার তৈরি করা হয়। এই প্রাইমার ভাইরাসটির কাংক্ষিত অংশে লাগিয়ে বর্ধিতকরণ করা হয় যাকে আমরা 'পিসিআর অ্যাম্লিফিকেশন' বলি। পিসিআর এর উদ্দেশ্য হলো আরএনএ সংখ্যা বৃদ্ধি করা। ৩০/৪০ সাইকেল বা চক্রের মাধ্যমে নিদিষ্ট পরিমাণ আরএনএ পাওয়া যায়। মলিকুলার বায়োলজির অন্যতম এই টেকনিক সম্পন্ন হতে ২ ঘণ্টার মত সময় লাগে। অথাৎ একটি নমুনা পরীক্ষা করতে ৪/৫ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এটি অনেকটাই নির্ভূল প্রক্রিয়া। কারণ, SARS-CoV-2 সিকোয়েন্স অন্য কোনও করোনাভাইরাসের সাথে সম্পূর্ণ মিলবে না। আর নিউক্লিউ টাইট এর স্বকীয়তার কারণে পিসিআর সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়। 

সেরোলজিক্যাল টেস্ট কী?

সহজভাবে বলতে গেলে সাধারণত রক্তের নমুনা নিয়ে যখন কোনও রোগ নির্ণয় করা হয় সেটিকে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় 'সেরোলজিক্যাল টেস্ট' বলে থাকি। মূলত রক্ত থেকে সিরাম ও প্লাজমা পৃথক করে এই ধরনের টেস্ট করা হয়।

কেউ যখন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া কিংবা অন্য প্যাথোজেন দ্বারা সংক্রমিত হোন, তখন তার শরীরে অ্যান্টিজেন বা জীবাণু প্রবেশ করে। আর এই সংক্রমণের ফলে অ্যান্টিজেনকে বাধা দেয়ার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আর টেস্টের মাধ্যমে রক্তের সিরামে থাকা অ্যান্টিবডি-কে চিহ্নিত করায় মূলত সেরোলজিক্যাল টেস্ট। 

সাধারণত পয়েন্ট অব কেয়ার (পিওসি) বা যেকোনও জায়গায় যেকোনও পরিবেশে রোগীর কোনও নমুনা শনাক্তকরণের জন্য সেরোলজিক্যাল টেস্ট অনেক জনপ্রিয়। কম সময়ে, কম পরিশ্রমে, সুলভ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রচলিত ল্যাবরেটরি ব্যতিত রোগ নির্ণয়ের জন্য আমরা সাধারণত পিওসি টার্ম ব্যবহার করি। যখন কোন বৃহৎ জনগোষ্ঠির সংক্রমণ শনাক্তকরণের প্রয়োজন পড়ে তখন 'পয়েন্ট অব কেয়ার' টেকনোলজিগুলো আমরা ব্যবহার করি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা গত কয়েক মাস ধরে কভিড-১৯ শনাক্তকরণের জন্য সেরোলজিক্যাল বা সহজ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ৯০-টিরও বেশি সেরোলজিক্যাল কিট ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। (সূত্র-১৫) 

অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে কেন বিতর্ক?

আমি আগেই বলেছি, অ্যান্টিবডি মূলত রোগের জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরে যুদ্ধ করে। এই প্রোটিন জীবাণুর চলাফেরা রোধ করে অনাক্রান্ত কোষকে রক্ষা করে। শরীরে যখনই কোন জীবাণু প্রবেশ করে তখন আমাদের বি-সেল থেকে প্রথমেই এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যাকে আমরা immunoglobulin M বা  IgM (আইজিএম) বলি। সাধারণত এই অ্যান্টিবডি তৈরি হতে ৫ দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে। এটা নির্ভর করবে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিরোধ ব্যবস্থার উপর। IgM খুব কম পরিমাণ তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডি চিহ্নিত করে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনা যে এটি কোন প্যাথোজেনের। 

এরপর তৈরি হয় immunoglobulin G (IgG)। যা শরীরে দীর্ঘক্ষণ থেকে অ্যান্টিজেন বা জীবাণুকে প্রতিরোধ করে যায়। কোন ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পর তৈরি হওয়া এই অ্যান্টিবডি আমরা ল্যাবরেটরিতে enzyme-linked immunosorbent assay (ELISA) টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করি। এটি একটি 'গোল্ড স্টান্ডার্ড' পদ্ধতি। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সাধারণত এটি শেষ করতে ৬/৭ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। ফলে বিজ্ঞানীরা পয়েন্ট অব কেয়ার টেকনিক হিসেবে কিছু কিট তৈরি করেছে। আর যখন কোনও কিটের মাধ্যমে শনাক্তকরা হয়, সেটি দেখে এইটুকু আমরা বুঝতে পারি যে সেই ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছিল কিনা।  (সূত্র-৩)

প্রশ্ন হলো, এই চিহ্নিত অ্যান্টিবডি শুধু কি SARS-CoV-2 বিপরীতে তৈরি হয়েছে নাকি অন্য কোনও প্যাথোজেন থেকে তৈরি হয়েছে, তা কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না। কারণ, যেকোনও বর্হি অ্যান্টিজেন শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের এই প্রতিরোধ ব্যবস্থায় এই IgM/IgG তৈরি হয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি কোভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমিত নাকি ইনফ্লুয়েঞ্জা দ্বারা সংক্রমিত তা কোনও অবস্থায় আমরা বলতে পারি না। শুধু তাই নয়, অ্যান্টিবডি কতদিন আগে তৈরি হয়েছে অথাৎ আপনি অন্য কোন প্যাথোজেন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর আপনার শরীরে এই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয় না। যে কারণে, এই সেরোলজিক্যাল টেস্টগুলোর ফলস পজিটিভ হওয়ার হার অনেক বেশি। (সূত্র-৪)

আবার যদি সংশ্লিষ্ট কিটের সংবেদনশীলতা বা সেনসিটিভিটি কম হয়, তাহলে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণে নেগেটিভ ফল। অর্থাৎ ফলস-নেগেটিভ হার বেশি হতে পারে, যা কোভিড-১৯ নির্ণয়ের অন্তরায়।

অনেকে বলে, অ্যান্টিবডি টেস্ট মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি প্লাজমা থেরাপির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে প্রশ্ন থাকা বাঞ্ছনীয় যে প্রচলিত এই অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে কখনোই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় যে সেটি কোভিড-১৯ বিপরীতে তৈরি কিনা।

কোভিড-১৯ যেহেতেু ভয়ানক ছোঁয়াচে, তাই আপনাকে প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগকে শনাক্ত করার লক্ষ্য থাকতে হবে। সেটি করা গেলে, আপনার কমিউনিটিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম হয়। 

অন্যদেশগুলো যা বলছে

ভারতের কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্স (আইসিএমআর) গত ২৩ মার্চ এক বিবৃতিতে বলছে, কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের জন্য আইসিএমআর সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে দুই ধরনের আরটি-পিসিআর কিটের অনুমোদন দিয়েছে। এইগুলো ১০০% ট্রু-পজিটিভ ও ট্রু-নেগেটিভ ফলাফল দিয়েছে। (সূত্র-৫)

২২ এপ্রিল আর একটি বিবৃতিতে তারা জানিয়েছেন যে,  ICMR has also arranged and made available rapid antibody test kits with the clear understanding that these tests cannot replace the RT-PCR tests to diagnose the COVID-19 cases. সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, কোভিড-১৯ পরীক্ষায় র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কখনোই আরটিপিসিআর সমকক্ষ হতে পারে না।

নিউজিল্যাণ্ডে একমাত্র কোম্পানি হিসেবে মেডসেফ (Medsafe) র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু করেছিল। এই পয়েন্ট অব কেয়ার (পিওসি) ডায়াগনস্টিককে গত ২২ এপ্রিল নিষিদ্ধ  ঘোষণা করে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। (সূত্র-৬)

যুক্তরাজ্য সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে  ৩৫ লাখ অ্যান্টিবডি কিটকে কেনার পর তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। কারণ, এইসব কিট কখনোই মানসম্মত নয় বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে। (সূত্র-৭) 

জাপান কেবল আরটিপিসিআর নির্ভর টেস্ট করছে। এই দেশে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী কোম্পানি র‌্যাপিড ডিটেকশন কিট প্রস্তুত করলেও সরকার এখনো তাতে সায় দেয়নি। 

যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ডও এই ধরনের অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এর মান সঠিক নয় বলে সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে বেশ আলোচনা হচ্ছে। (সূত্র-১৬) 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যা বলছে

পয়েন্ট অব কেয়ার (পিওসি) ডায়াগনস্টিক নিয়ে ডব্লিউিএইচও সরাসরি বলছে, গবেষণার জন্য কেবল ইমিউনু ডায়াগনোস্টিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে কোনভাবে ক্লিনিক্যাল ব্যবহারে উচিত হবে না, যতক্ষণ না বিস্তারিত নির্দেশনা না পাওয়া যায়। 

গত ৮ এপ্রিল ওই বিবৃতিতে সংস্থাটি কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের অ্যান্টিজেন টেস্টের বিষয়ে বলে, "WHO does not currently recommend the use of antigen-detecting rapid diagnostic tests for patient care, although research into their performance and potential diagnostic utility is highly encouraged।" 

অথাৎ ডব্লিউএইচও রোগীদের জন্য অ্যান্টিজেন শনাক্তের অতিদ্রুত ডায়াগনোস্টিক পরীক্ষা করার সুপারিশ করবে না। তবে এর মান বাড়ানোর জন্য আরো ভাল গবেষণা করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। (সূত্র-৮)

কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি টেস্টের জন্য যেসব প্রচলিত সেরোলজিক্যাল কিট বা পদ্ধতি চালু হয়েছে, সেইগুলোর যথেষ্ঠ সমালোচনা উঠে এসেছে ডব্লিউএইচও প্রতিবেদনে। তারা বলছে, "WHO does not recommend the use of antibody-detecting rapid diagnostic tests for patient care।" 

সুতরাং এই কথা স্পষ্ট যে, ডব্লিউএইচও সেরোলজিক্যাল টেস্টগুলোকে এখনো অনুমতি দেয়নি। তার কারণ, এই টেস্টগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন বরাবরই থাকছে।

অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে এফডিএ কী বলছে?

১৭ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ঔষধ অধিদপ্তর (এফডিএ) সেরোলজিক্যাল টেস্টের বিশদ আলোচনা করেছে। তারা সরাসরি বলছে যে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে  SARS-CoV-2 সংক্রমণ নির্ণয় করা সম্ভব তার কোন বৈধতা দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া সংস্থাটি কখনই তা আশাও করে না। (সূত্র-৯-১০)

তবে সংস্থাটির emergency use authorization (EUA) আওতায় যারা করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণের কিট জমা দিতে আগ্রহীদের তাদের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। বিক্রির উদ্দেশ্যে সেরোলজিক্যাল টেস্ট কখনোই ব্যবহার করা উচিত নয়। বাজারে প্রাপ্ত এইসব সেরোলজিক্যাল টেস্ট এফডিএ অনুমোদিত নয় বলেও তারা উল্লেখ করেছেন। 

গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে কেন বিতর্ক?

গত ১৮ মার্চ হঠাৎ করে বাংলাদেশি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এর ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঘোষণা দেন, তারা একটা টেস্ট কিট তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে ১৫/২০ মিনিটেই `র‌্যাপিড ডট ব্লট' নামের টেকনিকের মাধ্যমে কভিড-১৯ শনাক্তকর করা সম্ভব হবে। (সূত্র-১১)

ওইদিনই তারা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে এই ডায়াগনোসিস পদ্ধতিটির নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল আমদানির অনুরোধ জানিয়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়। 

অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে করা 'র‌্যাপিড ডট ব্লট' পদ্ধতি করোনাভাইরাসে শনাক্তকরণের ঘোষণা আমাদের আশার সঞ্চার করেছিল। ১৯ মার্চ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে এর কাঁচামাল আমদানির অনুমতিও দেয়।

এপ্রিলের শুরুতে কাঁচামাল পাওয়ার পর তারা এই কিটের উৎপাদন শুরু করে দেয়। ১১ এপ্রিল তারা এইসব কিট সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দেবে বলে সংবাদ মাধ্যমে ঘোষণা দেয় (সূত্র-১১)। ঠিক দশ দিন পর তারা কিট হস্তান্তর যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক জটিলতায় স্থগিতের ঘোষণা আসে (সূত্র-১২)। আমরা জানি না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ওই দিন আদৌও তারা কিট তৈরি করেছিল কিনা! তবে এর প্রায় ১৪ দিন পর গত ২৫ এপ্রিল তারা কিট হস্তান্তরের অনু্ষ্ঠানের আয়োজন করে। আর সেখানে তৈরি হয় নানার প্রশ্ন।

# গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রথমে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণের জন্য 'র‌্যাপিড ডট ব্লট' পদ্ধতিটির আবেদন করেছিল। কিন্তু হন্তান্তরের সময় ঘোষণা দেয় যে, তারা অ্যান্টিজেন সনাক্তকরণের জন্য কিটও তৈরি করেছে। তারা বলছে, অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির মধ্যে যে ফাঁকটি থাকে তা থেকে বের হওয়ার জন্য তারা এই দুই পদ্ধতি আবিস্কার করেছে। তারা বলছে, একটি প্লাস্টিক ডিভাইসের মধ্যে দুই ফোঁটা বাফার (buffet) বা বিশেষ দ্রবণ দেয়ার পর স্যাম্পলের সিরাম যোগ করা হয়। এরপর এই সিরামে থাকা অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি দেখার জন্য গোল্ড কনজুগেট সলিউশন দেয়ার পর ব্লট পেপারে দুইটি দাগ পাওয়া যায়। 

এই দাগটি কি অ্যান্টিজেনের না অ্যান্টিবডি- তার কোনও উত্তর ছিল না। 

# গণস্বাস্থ্যের দাবি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পরই দেহে অ্যান্টিজেন পাওয়া যায়। অ্যান্টিজেন পাওয়ার ৫-৭ দিন পর অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ায় মৃদু উপসর্গকারীদের র‌্যাপিড ডট ব্লট অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে কিছু রোগী মিস হচ্ছে। আর সেই কারণে তারা অ্যান্টিজেন টেস্ট করার মাধ্যমে প্রাথমিক ফেইজের রোগীদেরও চিহ্নিত করতে পারবেন। (সূত্র-১)

গণস্বাস্থ্য বারবার বলছে, তারা তাদের কিটের কার্যকারিতা দেখার জন্য ৫টি কভিড-১৯ নমুনা পেয়েছে (সূত্র-১ এবং ১১)। আর এই  নমুনাগুলো থেকে তাদের অ্যান্টিজেন টেস্ট শতকরা ৬৮ ভাগ সফলভাবে ফল পেয়েছেন। তার মানে এই গবেষক দল ৫টি নমুনার মধ্যে ৩ দশমিক ৪টি নমুনায় অ্যান্টিজেন পেয়েছে। বাকী ১ দশমিক ৬ জন রোগী ধরা পড়েনি । আবার তারা এটাও দাবি করেছে, তারা ৯৩ শতাংশ সফলভাবে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণ করেছে। তার মানে ওই একই ৫ টি নমুনায় তারা ৪ দশমিক ৬ রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি দেখতে পেয়েছেন। কেবল দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। 

বিষয়টি সত্যি হাস্যকর ও লজ্জাকর। ৫টি স্যাম্পল টেস্টের মধ্যে ৩ দশমিক ৪ টিতে অ্যান্টিজেন + ৪.৬ টি অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। তার মানে হচ্ছে মোট স্যাম্পল হচ্ছে ৮টি। তারা কি মনে করছে, এইসব স্যাম্পলে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি উভয় পাওয়া গেছে? সেটা সম্ভব নয়। অ্যান্টিবডি যদি তৈরি হয় তাহলে সেখানে অ্যান্টিজেন পাওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ। তাই তাদের এই কিটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকা অমূলক হবে না। 

# আগেই বলেছি সেরোলজিক্যাল টেস্টগুলোতে ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভ হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। এই ক্ষেত্রে মাত্র ৫টি স্যাম্পল টেস্ট করে আপনি কিছুতেই দাবি করতে পারেন না যে আপনার কিটের ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভ নেই। সেটার পাসেন্টেস কতটুকু তা আপনারা সাংবাদিকদের প্রশ্নে উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু ব্যর্থই নয়, বরং গণস্বাস্থ্য বলার চেষ্টা করেছে যে, সেনসিটিভিটি নিয়ে প্রশ্ন করা অপ্রয়োজনীয় বরং কিট করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ করতে পারছে কিনা সেটাই মুখ্য বিষয়।

# বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেরোলজিক্যাল কিট তৈরি করছে।  কেউ কেউ আবার আইজিএম ও আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট ৯৫.১ শতাংশ সফল বলেও দাবি করেছে। (সূত্র-৪)। তারা অন্তত শতাধিক রোগীর স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষার পরই তারা এই দাবি করেছে। কিন্তু গণস্বাস্থ্য মাত্র ৫টি টেস্টকে আমলে নিয়ে যে শতাংশ করার চেষ্টা করেছেন, তা সায়েন্টিফিক্যালি অনৈতিক। কিটের গ্রহণযোগ্যতা আনতে সংস্থাটির আরও বেশি টেস্ট আমলে নেয়া উচিত। 

এইক্ষেত্রে অবশ্য তারা দাবি করতে পারেন, সরকার তাদের অসহযোগিতা করছে। অথচ তাদের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, এই কিট উদ্ভাবনে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা, ঔষধ প্রশাসন এবং করোনাভাইরাস পজেটিভ রোগীর রক্তের নমুনা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ভূমিকার প্রশংসনীয়। 

তাহলে, কেন তারা আরো বেশি টেস্ট করলো না? কেন তারা ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভের তথ্য জানালেন না? কেন তারা বারবার গণমাধ্যমে আপনাদের কিটের সফলতার হার শতভাগ বলে দবি করেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। একজন গবেষক হিসেবে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ আমার কাছে বেমানান। তবে গবেষণার মৌলিক দিক এই কিট উদ্ভাবনে মার খেয়েছে।

# ধরা যাক, গণস্বাস্থ্যের এই কিটে কোভিড-১৯ আক্রান্ত শতকরা ৬৮ জনকে প্রাথমিক অবস্থায় অ্যান্টিজেন শনাক্তকরণের মাধ্যমে চিহ্নিত করা গেল। বাকী ৩২ জনকে ধরতে ব্যর্থ হলো। আর ৩২ জন যদি পজিটিভ হয়, তাহলে এদের দ্বারা যে অন্যরা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর যদি মনে করা হয়, এই ৩২ জনের সবাইকে তারা অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করবেন, সেখানেও কিন্তু প্রশ্ন থাকবে। তা হলো- এই ৩২ জনের অ্যান্টিবডি সফলভাবে পাওয়া যাবে না। 

যারা এই কিটের ব্যবহার নিয়ে অতি উৎসাহী তারা একবার ভাবুন, আপনি কিংবা আপনার পরিবার কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর যদি এই ৩২ জনের মত এই কিটের মাধ্যমে শনাক্ত না হোন, তাহলে আপনি খুশি থাকতে পারবেন? শঙ্কার মধ্যে পড়বেন না?

বরং আপনার সময় ক্ষেপন হবে। আপনাকে সেই আরটিপিসিআর প্রতি ধরনা দিতে হবে।

এছাড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর উপসর্গ দেখা দেয়। ভাইরাসটি যখন অ্যান্টিজেনের প্রতিলিপি তৈরি করে, তখন সেটি কোষের অভ্যন্তরে ঘটে। প্রাথমিক অবস্থায় রক্তে কিভাবে অ্যান্টিজেন পাবেন? আর পেলেও সেটার ঘনত্ব কতটুকু? গণস্বাস্থ্যের কিটের অ্যান্টিজেনের ঘনত্বের সংবেদনশীলতা কতটুকু তা কি নির্ণয় করা হয়েছে? 

গণমাধ্যমে যে চিত্র সংস্থাটির পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে তা কেবল অ্যান্টিবডি টেস্ট। অ্যান্টিজেন টেস্টের বিস্তারিত তথ্য সংস্থাটি কোথাও দিয়েছে কিনা চোখে পড়েনি। 

শুধু তাই নয়, এই অ্যান্টিজেন যে শুধু করোনাভাইরাসের তা কিন্তু হলপ বলা যায় না। সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বরের অ্যান্টিজেনও থাকতে পারে। তাই এই পদ্ধতিটি ত্রুটিযুক্ত হতে পারে।

# ঠিক একই প্রশ্নের জন্ম নেবে অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে। নন-স্পেসিফিক প্যাথোজেনের অ্যান্টিবডি আর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার অ্যান্টিবডির মধ্যে তফাৎ করার সাধ্য আপাতত এইসব সেরোলজিক্যাল টেস্টে নেই। তাই, এই টেস্টের মাধ্যমে আপনি কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারবেন না, আপনি কভিড-১৯ আক্রান্ত নন। তবে আশার কথা হলো, অ্যান্টিবডি টেস্ট যখন করা হয়, তখন রোগী সেরে উঠার পর্যায়ে থাকে।

# স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ওষুধ বা ডিভাইস তৈরি হলে, এর কিছু প্রটোকল মানতে হয়। যা গণস্বাস্থ্য মেনেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের জন্মনিয়েছে। সায়েন্টিফিক্যালি গণস্বাস্থ্যের উৎপাদিত কিট ইনভিট্রো টেস্টের ডেভেলপমেন্ট স্ট্রেজে রয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল পাওয়ার পর তা সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেমন ঔষধ প্রশাসনের ২০১৫ সালের মেডিকেল ডিভাইস নিবন্ধন নির্দেশনায় বলা হচ্ছে, ক্লিনিক্যাল Evaluation, Evidence,  Investigation, Performance,  Safety এইসব বিষয়ে উত্তীন্ন হওয়ার পর তা জমা দিতে হয়। 

৯ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট বলা হচ্ছে, Notified Body is a third-party, accredited body which will be approved by DGDA for the purpose of verification, testing and certification of the manufacturer of medical devices in Bangladesh for the purpose of registration with DGDA. (সূত্র-১৪)

ঠিক এই ধাপগুলো সম্পন্ন না করে, কিভাবে একটি কোম্পানি দাবি করতে পারে যে তারা কিট উৎপাদন করছে? ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে উত্তীর্ন না হয়ে চিকিৎসাবিদ্যার কোন ঔষধ বা ডিভাইস অনুমোদনের কোন রেওয়াজ বিশ্বে নেই। তাই গণস্বাস্থ্যের এই দাবি যথার্থ অনৈতিক আবদার ছিল।

গণমাধ্যমে তারা বারবার বলছেন, যে সরকারের কেউ এই কিট নিতে আসেনি। বিষয়টি আসলে, প্রচলিত গাইডলাইন অনুযায়ী যায় না। আপনার আবিস্কার মূল্যায়নের জন্য ঔষধ প্রশাসন আপনার ঘরে যাবে না বরং আপনাকে কিটের প্রটোকল, ডেটা, প্রকাশনা জমা দিয়ে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। 

# বিজন কুমার শীলরা যে কিট তৈরি করেছেন, তার মূল্য ৩০০/৩৫০ টাকার মধ্যে বলে দাবি করছেন। শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে তিনি নিজেই বলেছেন তাদের ১ মিলিলিটার গোল্ড কনজুগেটে সলিউশনের দাম ৪৮০ ডলার বা ৪০ হাজার টাকা। এই রি-জেন্ট দুইফোঁটা করে লাগে। প্রতি ফোঁটায় যদি ১০ মাইক্রোলিটার করে লাগে তাহলে দুইফোঁটায় লাগবে ২০মাইক্রো মিলিলিটার মত রি-জেন্ট। প্রশ্ন হলো ১০০০ মাইক্রোলিটার (১ মিলি) দাম ৪০০০০ হাজার হলে তাহলে প্রতি টেস্টে (২০ মাইক্রোলিটার) খরচ পড়বে ৮০০ টাকা। এছাড়া তো আনুসঙ্গিক খরচ তো আছে। এখন প্রশ্নটা আপনাদের কাছে থাকলো, আপনারা যদি এই কিটকে সফলভাবে প্রয়োগই করতে চান তাহলে ভর্তুকি দেবেন কিনা! যদিও বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক, তবে কিটের ব্যবহারকে রংচং- এ করতে গণস্বাস্থ্যের কম মূল্যের কিট সরবরাহের দাবি মিথ্যানির্ভর বিজ্ঞাপন নয়তো? 

আমরা চাই, আমাদের গবেষণার মূল্যায়ন করা হোক। আমাদের মেধার সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হোক। ছোট-বড় সব ধরনের গবেষণায় আমাদের কাছে মূল্যবান। তবে গবেষণার সায়েন্টিফিক নৈতিকতা মেনে চলা প্রতিটি গবেষকের কাম্য। যেটি আমরা গণস্বাস্থ্যের কিট আবিষ্কারের ক্ষেত্রে দেখতে পাইনি। বিশ্বের যেসব দেশ এই সেরোলজিক্যাল টেস্টের কিট আবিস্কার করেছেন, সেইসব দেশের গবেষকরা অন্তত তাদের গবেষণার নিবন্ধ প্রি-প্রিন্ট জার্নালে জমা দিয়েছে, যাতে করে গবেষণার তথ্য সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে শেয়ার করা সম্ভব হয়। আমরা তথ্য জানতে পারি। গণস্বাস্থ্যের উচিত ছিল, এই ধরনের নিবন্ধ প্রকাশ করা। কিন্তু তা না করে এর ট্রাস্টি সব সময় দাবি করেছেন, যে তাদের আইডিয়া চুরি হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনাদের এই ধরনের গবেষণা অনেক আগেই বিভিন্ন জার্নালে এসেছে। তথ্য গোপন করে, জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করা কখনোই কোন গবেষকের কাজ হতে পারে না।

পাবলিক সেন্টিমেন্ট দিয়ে কখনো জীবন-মরণের সম্পর্ক জড়িত বিষয়ে সরকারের উপর চাপ তৈরি করা ঠিক নয়। সরকার যদি আপনাদের কিটের প্রতি সদয় না হতো, তাহলে নিশ্চিয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাদের কিট চীন থেকে নিজ উদ্যেগে আনার ব্যবস্থা করতো না।

কিটের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তা নির্ভর করবে এর সফলতার উপর। নিজে নিজে শতভাগ সফল দাবি করার জন্য গণস্বাস্থ্যের উচিত ছিল অপেক্ষা করা- তাদের প্রটোকল মেনে তৃতীয় পক্ষ কতটা সফল হচ্ছে, সেটি দেখার জন্য। ৫টি নমুনা নয়, অন্তত শতাধিক নমুনা টেস্ট করার পরই বলা উচিত ছিল, যে আপনাদের কিট কার্যকরী। 

আপাতত বির্তক চলছে, হয়তো চলবে। আমরা সেই বিতর্কে আর না জড়াই। গণস্বাস্থ্যের কিট কার্যকরী কি না তার মূল্যায়ন সরকার করুক। তবে সরকারের উচিত হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফডিএ কিংবা সিডিসির গাইড লাইন সঠিকভাবে অনুসরণ করা। কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের সেরোলজিক্যাল টেস্টগুলোর প্রতি নজর না দিয়ে আপাতত আরটিপিসিআর মনযোগ দেয়া। মনে রাখতে হবে, সেরোলজিক্যাল টেস্ট কখনোই নির্ভরযোগ্য নয়,যতটা আরটিপিসিআর গ্রহণযোগ্য। 

বিশ্বের কয়েকটি দেশ প্রথম দিকে সেরোলজিক্যাল কিটগুলো ব্যবহার করে আসলেও এখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা স্বীকার করে নিয়েছে যে এইসব কিটের টেস্টের ফলাফল গ্রহণযোগ্য নয়। তাই র‌্যাপিড ডিটেকশন কিটের বিষয়ে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের উচিত হবে আরো বেশি পর্যালোচনা করা। 

আমরা এই কিটের কেউ বিরোধিতা করছি না, কেবল মৌলিক সায়েন্টিফিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করছি, যা এই ধরনের কিটের অধিকতর উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আমরা অবশ্যই গর্বিত হবো, যদি আমরা এই ধরনের টেকনোলজি বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবেলায় ব্যবহার করতে পারি। আমার বিশ্বাস সরকার গবেষণা কিংবা নতুন উদ্ভাবনীতে বিপক্ষে নয়। তাই আবেগ নয়, বরং মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, কোভিড-১৯ সনাক্তকরণের শক্তপোক্ত পথই অনুসরণ করি। আবেগের বশবর্তী হয়ে কাউকে ঝুঁকিতে না ফেলি। আশা করি, সামনের দিনগুলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আরো বেশি সময় নিয়ে, গবেষণার সকল আঙ্গেল অনুসরণ করে এই র‌্যাপিড ডট কিটের মানোন্নয়নে এগিয়ে আসবে।

তথ্যকণিকা
১. https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1751144.bdnews
২. https://www.facebook.com/rtvnews247/videos/2304899676482798/UzpfSTEwMDAwMTMwMjMxMjIxNTozMDYwNjExMjk0OTk0MTQ6NzU6MDoxNTg4MzE2Mzk5OjI1MDA3MDYyNjk3NzcyMDU2MzU/?__tn__=%2CdCH-R-R&eid=ARDzRswNUMGQZWWxGaOTVDFXN8arB9Us8x-b1ONefXFTkrhJc4btb-4p8UfzPxllLat5xdk9De8IwSJ3&hc_ref=ARSLmZdVXTirXwwDaw9HEzQztkr8xS72SQEbdIFOKStxkmRD8d0FgTro2wRkWVzx7zA&fref=nf
৩. https://www.nature.com/articles/d41586-020-00827-6?utm_source=facebook&utm_medium=social&utm_content=organic&utm_campaign=NGMT_USG_JC01_GL_Nature&fbclid=IwAR0SuVhKpic4fTnY6KJdGZsnC8NdrRzF3E2QNRNOEPl1JJIQHtjm2znE7mY
৪. https://www.medrxiv.org/content/10.1101/2020.03.26.20044883v1.full.pdf
৫. https://icmr.nic.in/sites/default/files/press_realease_files/ICMR_Press_Release_23032020.pdf
৬. https://www.health.govt.nz/news-media/media-releases/covid-19-point-care-test-kits
৭.https://www.theguardian.com/world/2020/apr/09/uk-government-urged-to-abandon-poor-finger-prick-antibody-tests-coronavirus
৮. https://www.who.int/news-room/commentaries/detail/advice-on-the-use-of-point-of-care-immunodiagnostic-tests-for-covid-19
৯. https://www.fda.gov/medical-devices/letters-health-care-providers/important-information-use-serological-antibody-tests-covid-19-letter-health-care-providers
১০. https://www.fda.gov/news-events/press-announcements/coronavirus-covid-19-update-serological-test-validation-and-education-efforts
১১. https://bangla.bdnews24.com/health/article1736272.bdnews
১২. https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1649715/%E0%A7%A7%E0%A7%A7-%E0%A6%8F%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%9F-%E0%A6%B9%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%87
১৩. https://bangla.bdnews24.com/health/article1745466.bdnews
১৪. https://www.dgda.gov.bd/index.php/2013-03-31-05-16-29/guidance-documents/127-medical-device-registration-guideline-2015
১৫. https://www.nature.com/articles/s41551-020-0553-6

১৬. https://www.sciencemag.org/news/2020/04/antibody-surveys-suggesting-vast-undercount-coronavirus-infections-may-be-unreliable