মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি: পরীক্ষার হ্যাঁ-না বিতর্ক

মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম
Published : 1 Sept 2012, 04:02 PM
Updated : 1 Sept 2012, 04:02 PM

সম্প্রতি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে ভর্তি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনানুষ্ঠনিকভাবে ঘোষিত নীতিমালা দেশের হাজার হাজার মেধাবী তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের জীবন গড়ার আকাঙ্ক্ষাকে ভয়াল দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে। এদের সবাই গেল ১২ বা ১৩ বছর ধরে চিকিৎসকের মহান পেশায় আত্মনিয়োগের স্বপ্নে ছিল বিভোর। দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে, নানা প্রতিকূলতা ও দৈন্যতা জয় করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই স্বপ্নকে ছিনিয়ে আনার অধ্যবসায়েও নিয়োজিত ছিল। হঠাৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আর কোনও নতুন পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতা নয়; মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তাদের অর্জিত ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই এবার সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে প্রার্থী ভর্তি করা হবে।

১৯৯৭ সাল থেকে প্রচলিত প্রতিযোগিতামূলক ভর্তিপরীক্ষা নানা সময়ে দুর্নীতি, প্রশ্ন-ফাঁস, প্রশ্নপত্রের মানের ভয়াবহ ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনার দোষে বিতর্কিত হলেও, ভর্তির জন্য একটি উপযুক্ত ও ন্যয্যতাভিত্তিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। মুখস্থ-নির্ভর মূল্যায়ন, অব্যাহত প্রশ্নপত্রের মানের ঘাটতি, দুর্নীতি, প্রশ্ন-ফাঁস, ও অব্যবস্থাপনার সুযোগে ভর্তিপরীক্ষা সহায়ক কোচিং-ব্যবস্থার প্রচলন দিনে দিনে কোচিং-বাণিজ্যের বিষবৃক্ষে পরিণত হয়ে ভর্তিচ্ছুদের হয়রানি ও পীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রার্থী, অভিভাবক ও সমাজের বিভিন্ন অংশের উদ্বিগ্ন মানুষ ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতির যথার্থ সংস্কার, দুর্নীতিমুক্ত কঠোর ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার দাবি করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাই বলে ভর্তিপরীক্ষা বাদ হয়ে যাবে এটা ভাবেননি কখনও। হুট করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সরকারি এই ঘোষণা সবাইকেই বিস্মিত ও বিচলিত করেছে; বিক্ষুব্ধ করেছে ভর্তিপ্রার্থীদের এক বিরাট অংশকে, বিশেষ করে গেলবারের অকৃতকার্য প্রার্থী যারা অন্য কোথাও ভর্তি না হয়ে কঠোর পরিশ্রম, নিবিড় পাঠচর্চা ও ব্যপক অনুশীলন করেছে। অনেক আশায় তাদের অভিভাবকদের কেউ কেউ ধার-কর্জ করে, গয়না-গাটি বিক্রি পর্যন্ত করে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুখ-স্বপ্ন লালন করেছেন। সরকারের এই ঘোষণা অনিশ্চিত করেছে তাদের ভবিষ্যৎ। এরা সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে পুলিশি বাধা ও পীড়নের শিকার পর্যন্ত হয়েছে। সুবিচার প্রার্থনা করতে গেলে আদালত পর্যস্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে।

এই বাস্তবতার বাইরেও কেউ কেউ যে বিষয়টাকে স্বাগত জানাননি তা-ও নয়। ধারণা করা যেতে পারে যে ভুক্তভোগীরা বিষয়টিকে যার যার স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করবে। এই কঠিন সংকটের মুখে সময় এসেছে বিষয়টাকে নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন কল্যাণ-দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করে একটি জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ গড়ে তোলা। আশা করা যায় আজকের এই নিবন্ধ সেই কঠিন কাজে সামান্য ভূমিকা রাখবে।

ভর্তিপরীক্ষা বাতিল করার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভর্তিচ্ছুদের মেধা ইতোমধ্যেই যাচাই হয়ে গেছে বলে যে দাবি করেছেন তা অর্ধেক সত্য। সন্দেহ নেই যে, সব পরীক্ষায় কোনও না কোনও পর্যায়ের মেধা যাচাই করে। তবে ভুললে চলবে না যে, সব মেধাই বিষয়বস্তু বা প্রেক্ষিতভিত্তিক। এক বিষয় বা প্রসঙ্গের মেধা যে অন্য বিষয় বা প্রসঙ্গে লাগসই নয় তা সাধারণ জ্ঞানের বিষয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় যে মেধা-যাচাই হয় তা সাধারণ শিক্ষার মেধা। সে মেধা উচ্চশিক্ষার সাধারণ বা প্রাকযোগ্যতা নির্দেশ করলেও, চিকিৎসাশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা বা ব্যবসায় শিক্ষার মতো বিশেষায়িত শিক্ষায় যে বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন হয় তা পরিমাপ বা নির্দেশ করে না। এমনকি সাধারণ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই সাধারণ মেধার মানদন্ড প্রয়োগ fitting square pegs in round holes বা বৃত্তাকার গর্তে চৌকোন খুঁটো আটার মতই ব্যর্থ কাজে পর্যবসিত হতে পারে। মনে রাখা দরকার যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা একটি মানভিত্তিক পরীক্ষা, এখানে প্রতিযোগিতার কোনও মাত্রা নেই; শিক্ষার্থীরা এখানে তাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব এমন একটা গ্রেড পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে মাত্র। ফলে এর ফলাফলকে প্রতিযোগিতার সূচক হিসাবে ব্যবহার শুধু বোকামিই নয়, ধৃষ্টতামূলক; বৈধতা ও ন্যয্যতা পরিপন্থী।

তাই এই সিদ্ধান্ত যারা নিলেন, সে সব ব্যক্তির কাছে এই গুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি যে উপেক্ষিত হয়েছে তা কোনও বিচারেই তাদের মর্যাদা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ সব সম্মানীয় ও উচ্চ-দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ কেন বেমালুম ভুলে গেলেন যে, এখনও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতিতে, প্রশ্ন-প্রণয়ন ও উত্তরপত্র যাচাইয়ে বস্তুনিষ্ঠতার ঘাটতি রয়েছে। তারই নিরসনে মার্ক-ভিত্তিক ফলাফলের পরিবর্তে গ্রেড-ভিত্তিক ফলাফল প্রকাশের প্রবর্তন ঘটে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই জানেন যে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি সর্বোচ্চ মাত্রায় বস্তুনিষ্ঠ হতে হয়। কারণ এর মাধ্যমে প্রার্থীদের মাঝে সুক্ষতম পার্থক্য নির্দেশ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে উচ্চ-দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ কোন বিচারে বস্তুনিষ্ঠতার অভাবসম্পন্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মার্ককেই প্রতিযোগিতার মানদন্ড হিসাবে প্রতিপন্ন করতে সম্মত হলেন? একে যদি কেউ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এমনকি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা না ভাবতে চায় তার পক্ষেই বা কী যুক্তি থাকে? তাদের কাছে এ বিষয়টি একবারও বিবেচিত হল না যে অপ্রকাশিত বা গোপন মার্কের ব্যবহার বৈধতার বাইরেও নির্বাচনী-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছ্বতা বিনষ্ট করে গণমানুষের আস্থায় চিঁড় ধরাতে বাধ্য? অনেকেরই জানা যে পাশের দেশ ভারতে এ ধরনের প্রয়াস একাধিকবার বৈধতা ও স্বচ্ছ্বতার কারনে আদালত কর্তৃক প্রত্যাখাত হয়েছে। আমাদের আদালতেরও বিষয়টি আমলে নেয়া দরকার।

ভাবতে অবাকই লাগে যে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য ও দেশের ভবিষ্যৎ যাদের উপর ন্যস্ত তারা এমন সাধারণ বিষয়ও বিবেচনায় আনতে সমর্থ নন যে একটি অস্বচ্ছ্ব প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির মহাআখড়ায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বহন করে। তবে কোন দুর্নীতি বন্ধের উছিলায় এই পরিবর্তন? কেউ কি চান যে দুর্নীতির ক্ষেত্রটি প্রশ্ন-পত্র ফাঁস ও বাণিজ্যের গন্ডি থেকে শিক্ষা বোর্ড অফিসগুলোর চৌহদ্দিতে ঢুকে সমগ্র শিক্ষাপদ্ধতিকে দুর্বিপাকগ্রস্ত করে তুলুক? মার্ক-প্রথা ও মেধাতালিকা বিলোপের ফলে আমাদের বোর্ড অফিসগুলো বহুদিন ধরে দুর্নীতিমুক্ত থাকার যে সুনাম বহন করে আসছিল আমরা কি তার সদর্প পুনঃপ্রত্যাবর্তন চাই? তাহলে এই সিদ্ধান্তে জনসাধারণ কর্তৃপক্ষের ভর্তিপ্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত করার সদিচ্ছা খুঁজে না পেয়ে, যদি উল্টোটার দুর্গন্ধ পায়, কে ঠেকাবে তাদের?

আমরা কি এত দ্রুত ভুলে গেলাম যে স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পর আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলো যে ভয়াবহ নকল-সংষ্কৃতির দানবে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল মাত্র কয়েক বছর হল আমরা সেই দুরারোগ্য নকল-সংষ্কৃতির রাহুমুক্ত হয়েছি। মূল্যায়নে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ও জিপিএ প্রথার প্রবর্তনে আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে নৈর্ব্যক্তিক, নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য মূল্যায়নের আস্থা ফিরে আসায় লেখাপড়ায় নতুন মাত্রা ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। একমাত্র মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলকে ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষার মর্যাদা দিলে সেই দানবের সগৌরব প্রত্যাবর্তন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রতিককালের সব অর্জন, বর্তমানের সব স্বপ্ন ও সংস্কার উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ সব সম্ভাবনা গুড়িয়ে দিতে পারে। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জ্ঞান-ভিত্তিক মেধা-নির্ভর সমাজ গঠনের ডাক দেন, তখন মেধা চুরি আর জ্ঞান-নিধনের এমন নিশ্চিত আয়োজন প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকেই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করে না, রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমনে অনাস্থা আনে। জনমনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- কোন স্বার্থ চিন্তা বা কার প্ররোচনা সর্বব্যপী দুর্নীতির এই দুষ্ট-জাল বিস্তারের প্রেরণা জোগাচ্ছে? এমন ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তকে হঠকারী ও সমাজদ্রোহী আখ্যা দিলে কার কী বলার থাকবে?

আরও অনেক বিষয়ই ভেবে দেখার আছে। আমাদের দেশে শহর, মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকা-ভেদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা মানের যে তারতম্য আছে তা পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। নির্দিষ্ট প্রাক-যোগ্যতার ভিত্তিতে ও সমন্বয়ে ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষা, যেমনটি এতদিন ছিল, মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকার প্রার্থীদের সুযোগের বৈষম্য অনেকটাই ঘোচাতে সক্ষম। পত্রিকান্তরে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয়ের সমীক্ষাসূত্রে এমন তথ্যই দিয়েছেন যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উচ্চমান না পেয়েও অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থী ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষায় কৃতকার্যতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়। ফলে শুধুমাত্র পাবলিক পরীক্ষায় অর্জিত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ভর্তি করা হলে প্রতিযেগিতায় সক্ষম অন্তত ৫০ শতাংশ প্রার্থী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। এদের অনেকেই সুবিধাবঞ্চিত মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকার প্রার্থী বা মেধাগত ছাড়াও অনান্য সঙ্গত কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উপযুক্ত ফলাফল বঞ্চিত।

ভুলে গেলে চলবে না যে ৮টি সাধারণ বোর্ড ও মাদ্রাসা বোর্ডে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হওয়ায় ও উত্তরপত্র যাচাইয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষক নিয়োজিত থাকায়, সবাইকে প্রাপ্ত মার্কের ভিত্তিতে একই সাধারণ মেধার আওতায় আনা হলে তা-ও হবে ন্যায়বিচার বর্জিত। আমরা যদি বিগত দিনের ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের প্রাপ্ত জিপিএ'র ভিত্তিতে বিচার করি তাহলেও পরিষ্কার দেখা যাবে যে, উভয়ের মধ্যে সঙ্গতির অভাব রয়েছে। হাজার হাজার জিপিএ ৫ প্রাপ্ত প্রার্থী ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। অতএব যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অর্জিত ফলাফলকে মেধার নিরঙ্কুশ বা সর্বোত্তম প্রতিফলন বলে ভাবছেন তারাও সত্যের কাছাকাছি নন। তবে ২৯শে আগষ্ট ২০১২ মধ্যরাতের পর ৭১ টেলিভিশনের টক-শো'তে সম্মানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয় দাবি করেছেন যে মাত্র ০.২৫ শতাংশ প্রার্থী সরাসরি ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষার ফল ভোগ করে। বাকিরা মূলত তাদের পাবলিক পরীক্ষায় অর্জিত ফলাফলের ভিত্তিতেই ভর্তি লাভ করে। ফলে ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষার খুব বেশি ভূমিকা নেই।

এ পরিসংখ্যান ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণের প্রতিফল মনে হয়। কেননা গেল কয়েক বছরে এ বিষয়টিই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে প্রতি ভর্তিবছরে প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি প্রার্থী পূর্বের বছরে অকৃতকার্য হয়েও শুধুমাত্র নিবিড় ও কঠোর অনুশীলনের ফলে আলোচ্য বর্ষে ভর্তিলাভ করে। পাবলিক পরীক্ষায় অর্জিত ফলাফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব মূল্যায়ন এই যে, জিপিএ ৫ অর্জনের জন্য সমগ্র পাঠ্যসূচি চর্চ্চার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষার বিদ্যমান ধারা অনুসরণ করে পাঠ্যসূচির নির্বাচিত অংশবিশেষ আয়ত্ত করলেই সাধারণ মেধার শিক্ষার্থীরা তা অর্জন করতে পারে। তবে ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষায় উন্নত ফলাফল অর্জন করতে পুরো পাঠ্যসূচিই আয়ত্তে আনতে হয়। তাদের ব্যাপক সংখ্যার অভিজ্ঞতা যে, ভর্তি বা নির্বাচনী পরীক্ষার প্রস্তুতি তাদের জ্ঞানকান্ডকে পূর্ণতা দেয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের শিক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির দুর্বলতা খুঁজতে বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই।

শেষ করার আগে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই যে, বর্তমানে যে ভর্তিপরীক্ষার প্রচলন রয়েছে তা একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রচলিত পদ্ধতিতে যে ধরনের প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয় তা শিক্ষার্থীদের মুখস্থে উদ্বুদ্ধ করে। এমন এমন প্রশ্ন করা হয় যা উদ্ভট ও যার কোনও ব্যবহারিক মূল্য নেই। 'শুক্রকীটের গতিবেগ' বা 'জেলখানার দেওয়াল পত্রিকার নাম' জানাটা কি যোগ্যতার প্রমাণ বহন করে তা বুঝতে কষ্ট হয়। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের হতাশ করে; অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হন, মূল্যায়নকারীদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্মে। মূল্যায়নের মানোয়ন্নকল্পে ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতির যথার্থ সংস্কার করতে হবে।

পাশাপাশি প্রশ্নপত্রকে প্রাসঙ্গিক ও মূল্যায়নধর্মী করা দরকার; প্রশ্নগুলো বিশেষ নির্বাচনী গুণাবলী সম্বৃদ্ধ হতে হবে। তবেই না প্রকৃত যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করা যাবে। ব্যবস্থাপনাকে কঠোরভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা ও প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাও ভর্তিপরীক্ষার বৈধতা, গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরশীলতা বাড়াবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অর্জিত জিপিএ ফলাফলকে যারা সারা শিক্ষাজীবনের মূল্যায়ন বলে আখ্যা দিতে চান, যারা আশি ঘন্টার মূল্যায়নকে এক ঘন্টার মূল্যায়নের চেয়ে বেশি মূল্য দিতে চান- তাদের ভেবে দেখতে হবে যে মানহীন সব প্রক্রিয়াই মূল্যহীন ও পরিত্যাজ্য। মানসম্পন্ন এক ঘন্টার মূল্যায়নও হতে পারে অনেক কার্যকর। যা প্রয়োজন তা হল, অব্যহত মান অর্জনের মাধ্যমে মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে যথাযথ কার্যকর করা; অহেতুক অর্বাচীনের মতো বারবার পদ্ধতি বদল করা নয়।

শিক্ষা এথন একটি সম্বৃদ্ধ শাস্ত্র। এর প্রয়োগে যারা দক্ষ, প্রাজ্ঞ ও পারদর্শী তাদের সহযোগে একটি বিকশমান ও টেকসই পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করার এখনই সময়। চীন, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের সব উন্নত দেশ, ভারতসহ সব সার্ক দেশেই মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষায় প্রবেশমুখে ভর্তিপরীক্ষার প্রচলন রয়েছে। সব উন্নত দেশে ভর্তিপরীক্ষাকে কার্যকর করতে প্রক্রিয়াকে ব্যপক করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষাগত সক্ষমতার বাইরে পেশাসংক্রান্ত প্রবণতাকে যাচাই করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমাগত গবেষণা ও সম্বৃদ্ধ শিক্ষা-শাস্ত্রের প্রয়োগের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতাও ক্রমশ বাড়ছে। এই সম্বৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে যথাযথ শিক্ষার্থী নির্বাচন করে চিকিৎসাশিক্ষা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, চিকিৎসা পেশার মানও বেড়েছে। এই উৎকর্ষতা অর্জনের জন্য আমরা কি বড়ই অযোগ্য? দৃশ্যমান সোপান ছেড়ে আমরা কি বনজঙ্গল হাতড়ে বেড়াব? এটা কি আমাদের কুশিক্ষা-লব্ধ সংস্কৃতি না অহংকার?

এবার ২২টি সরকারি মেডিকেল কলেজে দুই হাজার ৮১১ আসন এবং বেসরকারি ৫৩টি মেডিকেল কলেজে চার হাজার ২৪৫ আসনে এমবিবিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। অন্যদিকে সরকারি একটি ডেন্টাল কলেজ ও আটটি ডেন্টাল ইউনিটে ৫৬৭ জন এবং বেসরকারি ১৪টি ডেন্টাল কলেজে ৮৯০ জন শিক্ষার্থী বিডিএস কোর্সে ভর্তির সুযোগ পাবে। ২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জন। ২০১১ সালে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ৩৯ হাজার ৭৬৯ জনের অনেকে এবারও মেডিকেলে ভর্তিপ্রার্থী।

বুঝতে কষ্ট হওয়ার নয় যে সরাসরি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অর্জিত জিপিএ ফলাফল ভিত্তিক মার্কের বিচারে ভর্তি করা হলে শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ প্রতিযোগিতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এর স্বপক্ষে ন্যায়বিচার বা যুক্তিসঙ্গত অবস্থান খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এতে এদের ন্যয্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হবে। আমাদের সন্তান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এর চেয়ে রূঢ় আচরন আর কী হতে পারে? তারা পড়তে চায়, প্রতিযোগিতা চায়, মেধার যথার্থ মূল্যয়ন চায়। আমরা আপত্তি করছি কেন?

পক্ষান্তরে, প্রচলিত ব্যবস্থায় ভর্তিপরীক্ষার মাধ্যমে ১০০ নম্বরের এমসিকিউ প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হত। আর ১০০ নম্বর ছিল এসএসসি (৪০) ও এইচএসসি (৬০) ফলাফলের ওপর। পরীক্ষা ও ফলাফলের নম্বরের সমন্বয় করে মেধা-তালিকা তৈরি করে ভর্তিপরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হত। এতে তালিকায় এগিয়ে থাকা মেধাবীরাই তাদের স্বপ্নের মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেত। এ পদ্ধতি নিয়ে ভর্তিচ্ছু ও অভিভাবকদের মধ্যে কোনও বিতর্ক ও প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন-ফাঁস, কোচিং-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের হয়রানির অজুহাতে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বাতিল করল সরকার।

বুঝতে আরও কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে প্রশ্ন-ফাঁস, কোচিং-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের হয়রানির বিষয়টি শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের সৃষ্ট নয়। অভিযোগগুলোর সবক'টিই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আওতায়। স্বীকার্য যে, যে ষ্টাইলে কোচিং চলছে তা উপযুক্ত শিক্ষার অনুকূলে নয়। কার্যকর শিক্ষা সংগঠন, ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ মানের অভাবই কোচিং ব্যবস্থাকে অধিকংশের অবশ্যম্ভাবী অবলম্বন করে তুলেছে। সরকার চাইলেই আইন করে কোচিং বন্ধ করতে পারে। নিশ্চিদ্র ব্যবস্থাপনার মাধম্যে প্রশ্ন-ফাঁস ও শিক্ষার্থী হয়রানির বিষয়টি সুরাহা করতে পারে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে আস্থা ও সুনাম কুড়াতে পারে।

তাই, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তথা জনসাধারণের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে একটি প্রজন্মের বড় অংশের জীবনকে দুর্যোগে আচ্ছন্ন করা কোন রাষ্ট্রীয় বা নাগরিক দায়িত্ব তা কি সংশ্লিষ্টরা বলতে পারেন? আসুন আমরা সম্বৃদ্ধ ও সম্ভ্রান্ত হই।