মহামারীর দিনপঞ্জি আর আয়েশা-রহিমদের কষ্ট পুরাণ

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
Published : 10 April 2020, 10:16 AM
Updated : 10 April 2020, 10:16 AM

এমন সময়ে সত্যিকার অর্থেই সকলের দিন-তারিখ-সময় ভুল হয়। আজ সকাল থেকেই বারবার তারিখ ভুলে যাচ্ছিলাম। আবার মনে মনে হেসে ভাবলাম কি হবে দিন-তারিখ-সময়ের এই হিসাব রেখে। পুরো দুনিয়াই যেখানে থমকে আছে। কোথাও ব্যস্ততা নেই, কোলাহল নেই, গাড়ি চলছে না, বাণিজ্য নেই, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা নেই। মানুষ বুকের মধ্যে এই দুঃস্বপ্ন ভোলার সময়ই কেবল গুনছে। কত কত মানুষ মরছে। কত কত যশ-খ্যাতির মানুষ। লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী মরে গেল, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী আইসিইউতে। আর আমাদের দেশে কেবল শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। আমি জানি না কোথায় গিয়ে থামব আমরা। কবে থামবে এই মহাপ্রলয়। কেউ কি জানে? কেউই জানে না।

আমাদের বাসাটা ছাদের একটা অংশ জুড়ে। অর্ধেকটা জুড়ে বাড়িওয়ালা বাগান করেছেন। খুবই সুন্দর বাগানটি। মালিক কখনই কাউকে সেখানে যেতে দেন না, আমরা যাই কদাচিৎ। আম গাছ, কামরাঙ্গা গাছ, লিচু গাছ, পেয়ারা, নানান ধরনের ফুল, লতা, গুল্ম আর সবজি প্রায় সারা বছরই হয়। তারা বাগানটার খুবই যত্ন করেন। আমরা নিতান্তই একটা মধ্যবিত্ত পরিবার, আমাদের রোজগার কমই কিন্তু এই বাসাটায় তুলনামূলক অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে থাকি। মাঝেমাঝেই ভাবি ছেড়ে দেব কিন্তু ছাড়া হয় না তার প্রধান কারণ বাসাটা অনেক খোলামেলা আর অদ্ভুত সুন্দর এই বাগান। প্রতিদিন ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে পাখির ডাকে। আর এটা খুব সৌভাগ্যের এই শহরে। আমরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী বলা যায়। তবে সম্প্রতি যা ঘটছে তা অবাক করা বললেও কম হবে। আমাদের এই বাগানে নাম না জানা অসংখ্য পাখি আসছে ভোরবেলা। নানান পাখির ডাকে ঘুম ভাঙছে আমাদের। দুপুরবেলা ঘুঘু ঢুকে যাচ্ছে জানলা দিয়ে আমাদের শোবার ঘরে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। হঠাৎ করেই পাখিরা কেমন আপন হতে চাইছে, যেন কাছে আসতে চাইছে। কি যেন বলতে চাইছে। কি বলতে চাইছে?

সারাদিন বাসায় থাকতে হচ্ছে। সকলেই এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখী। আমাদের নাগরিক জীবনে এক ভয়াবহতা নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। আমাদের মনোজগতেও নানান সংকট তৈরি হচ্ছে। পাশের বাসা থেকে প্রতিদিনই ভেসে আসছে ঝগড়া আর চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ। কদাচিৎ আমরাও ঝগড়া করছি। সেদিন ছোট্ট শিশুটাকেও নির্দয়ভাবে চড় বসিয়ে দিল তার বাবা। বাড়িওয়ালা এবার ভাড়া নিলেন খুবই ভয়ে ভয়ে যেন আমার হাত দিয়েই সে আক্রান্ত হতে পারে। হঠাৎ করেই একটা অবিশ্বাস আর আতঙ্ক আমাদের গ্রাস করছে প্রতিদিন। ভয় আর আতঙ্ক আমাদের তিলে তিলে ক্ষয় করে দিচ্ছে। কোথায় যেন কী হারিয়ে গেছে আমাদের। কোথাও সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজে পাওয়া যাবে কি?

একদিন ত্রাণের কাজ শেষ করে বাসায় ঢুকছি, এক বয়স্ক মানুষ তার শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াল খুব বিনয়ের সাথে। করুণ মুখে বলতে শুরু করল, বাড়ী দিনাজপুর আদাবরের শনিরবিল থাকেন ৬ জনের পরিবার নিয়ে। দুদিন হল খাবার নেই, রিকশাও চালাতে পারছেন না। আমি বললাম আচ্ছা আপনার মোবাইল নাম্বারটা দেন, পরে ফোন করে আপনাকে আমাদের এক প্যাকেট খাবার দেব (৫ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, হাফ কেজি করে ডাল, তেল ও পেয়াজ, একটা সাবান ও এক প্যাকেট লবণ)। সে মিনমিন করে বললো মোবাইলটা ৪ দিন আগে বেইচা দিছি। কত টাকায়? ৫০০ টাকায়। যাহোক তাকে আমরা আমাদের এক প্যাকেট খাবার দিতে পেরেছি। জানি না তাতে তার কবেলা আহার হয়েছে।

ছেলেটা ব্যানার লিখে সংসার চালায়। কিন্তু এই দুঃসময়ে তার আর অন্য কোনো কাজ নেই। তাই বাড়িতেই বসা। আর কারো কাছে যে হাত পাতবে, সে উপায়ও নেই। একজন ফোন করে জানানোতে তাকে আমরা কিছুটা সহযোগিতা করতে পেরেছি।

একজনের পেশা ছিল ফল বিক্রি করা। কিন্তু এই আকালে তার বিক্রি প্রায় বন্ধ। খোঁজ পেয়ে তার হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে দিলে সে কেঁদেই দিল।

ছেলেটা কলেজে পড়ে, নিম্ন আয়ের পরিবার তাদের। ঢাকায় এ সময়ে আটকা পড়ে আছে। প্রথম ১০ দিন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন খাবার নেই। মেস বন্ধ, প্রায় অভুক্ত অবস্থা। বাড়ি থেকেও টাকা পাঠাবে সে অবস্থা নেই।

ছোট একটা চায়ের দোকান ছিল কিন্তু এ সময়ে সব বন্ধ। এক সময় দিনে হাজার দুই হাজার আয় করলেও এই কিছুদিনের মধ্যে খুব সমস্যায় পড়ে গেছে সে। এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে তারা প্রায় না খেয়ে থাকার জোগাড়।

তারা এসেছিল ৪ জন একসাথে। পেশায় তারা ভাসমান যৌনকর্মী। বললেন তাদেরকে তো সমাজের লোকজন এমনিতেই জায়গা দেয় না আর এ সময়ে কোনো সহযোগিতাও তাদেরকে কেউ করছে না। তাদের ২০ জনকে খাবার দেয়া হল।

একজনের স্বামী সম্পতি বিদেশ গেছে। সে মেয়েকে নিয়ে বস্তিতে থাকে। স্বামী নতুন গেছে কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেনি এখনও। বাসার কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। এখন অনেকটা না খাওয়া দিন কাটছে তাদের। সামান্য খাবারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে হেঁসে, কেঁদে দিলেন।

এমন ঘটনা আর বর্ণনা আমাদের বিতরণ করা প্রায় ৩০০টি পরিবার থেকেই পাওয়া সম্ভব। ঢাকা শহরের নিম্ন আয়ের, ভাসমান মানুষ এমনকি মধ্যবিত্তের একটা অংশ আজ মহাসংকটে পতিত হয়েছে। এত বিশাল সংখ্যক মানুষের দায়িত্ব রাষ্ট ও সরকারকে নিতে হবে। এই মহামারীতে যেমন মানুষ মরবে, তেমনি অনেক মানুষ কিন্তু মরবে অনাহারে, অর্ধাহারে।

আমি আসলে এ সময়ের কয়েকটি কথা শেয়ার করার জন্য লিখতে বসেছিলাম। কিন্তু সবকিছুই অগোছাল হয়ে যাচ্ছে। হয়তো এই নতুন দেশ, নতুন পৃথিবী আর এই মহামারীর দিনে এটাই স্বাভাবিক। তবুও বলতে চাই আমরা আমাদের প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি খুব নির্দয়ভাবে। বন, নদী, সমুদ্র, বৈচিত্র্য সবকিছুকেই ধ্বংস করেছি। কৃষকের হাত থেকে নিয়ে কৃষিকে দিয়েছি কোম্পানির হাতে। নিজের স্বাস্থ্যকে নিজের হাতে না রেখে তা দিয়েছি চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের হাতে। মানুষের অধিকার ও প্রয়োজনকে মূল্য না দিয়ে সমাজকে করেছি ভোগবাদী। রাজনীতিকে করেছি ক্ষমতা দখলের সিড়ি। পৃথিবীর আন্তজার্তিকতাবাদকে ধ্বংস করে সৃষ্টি করেছি এককেন্দ্রীক ক্ষমতার চাষবাস। আজ সবকিছুর হিসেব দিতে হচ্ছে। আজ নতুন করে বুঝতে হচ্ছে মানুষকে প্রকৃতির কাছেই ফিরতে হবে। একজন রহিমের মোবাইল পুরো দুনিয়ার সাথে অন্তর্জালিক যোগাযোগ করতে পারলেও, তার মূল্য শেষ পর্যন্ত ১০ কেজি চালের থেকে বেশি না। খাদ্য, কৃষি আর আমাদের প্রকৃতিঘনিষ্ঠ জীবনের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। জানি না এই বিশ্ব মহামারীতে বাঁচব কিনা। তবে এটা জানি আসছে পৃথিবী হবে এক নতুন পৃথিবী। যে পৃথিবীতে মানুষ ক্ষমতার নয়, ভালবাসার চাষবাস করবে। সেই নতুন পৃথিবীর প্রতীক্ষায়।