রোগ, ওষুধ ও বৈশ্বিক ওষুধকেন্দ্রিক পুঁজি বাজার: করোনাকালের ভাবনা

জাভেদ কায়সারজাভেদ কায়সার
Published : 2 April 2020, 04:10 PM
Updated : 2 April 2020, 04:10 PM

নভেল করোনা ভাইরাস আজ সমগ্র পৃথিবীকে গ্রাস করে নিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর এই মহামারী রোগ পৃথিবীর প্রায় ১৯৯ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ছুঁইছুঁই এবং মৃত্যর মিছিলে ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মহামারী পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়, তবে বর্তমান সময়ে বিশ্বায়নের কারণে সারা দুনিয়া এখন একে অপরের সাথে খুবই কানেক্টেড। এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তা মানব সভ্যতার অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বেশি ও নিবিড়। তাই এই রোগের বিস্তার খুবই দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে, এবং আক্রান্ত হবার প্রবণতাও বেশি। নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতি সমগ্র বিশ্বকে যেভাবে একত্রিত করেছে, একইভাবে এই রোগের ক্ষেত্রেও তার ভিন্নতা দেখা যাচ্ছেনা। আমেরিকা থেকে আফ্রিকা কিংবা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল, কোন জায়গাই আজ এই বিশ্বায়নের বাইরে নয়, যে কারণে এই রোগ নিয়ে আশংকা এবং ভয় দুটিই অনেক বেশি। এই লেখার কেন্দ্রীয় জায়গা হচ্ছে রোগ ও রোগের ওষুধ নিয়ে বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির যে রাজনীতি বিদ্যমান, তাকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বোঝার চেষ্টা করা।

কিছুদিন আগে তথা মহামারির শুরুর দিকে ওষুধকেন্দ্রিক যে রাজনীতি আছে, তার আলোকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ওষুধ উৎপাদনের গবেষণা ক্ষেত্র হিসাবে কিভাবে ব্যবহৃত হয় তা নিয়ে শাবিপ্রবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের  'সংস্কৃতি, পরিসর ও বিশ্বায়ন' কোর্সের একটি ক্লাসে আলোচনা করছিলাম, যেখানে কিছু শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। আজ সকালে একটি দৈনিকের শিরোনামে একটি সংবাদ দেখে শঙ্কাটা আরও ঘনীভূত হয়।  সংবাদটা হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের শনাক্তকরণ পরীক্ষার দায়িত্ব একটি বৈশ্বিক অন্যতম বৃহৎ রোগ গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে, যার মূল বাড়ি আমেরিকায়। বাংলাদেশে এর দায়িত্ব অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিতে চাইলেও সরকার তাতে রাজি হয়নি, কারণ এখানে 'মান' নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদিও আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মান ভাল, কিন্তু তার পরেও তাদের দেয়া হয় নি। না দেয়াটা অনেকের কাছে স্বাভাবিক, আমার কাছেও স্বাভাবিক, কারণ তারা 'বিদেশি' প্রতিষ্ঠান নয়, এবং বৈশ্বিক জ্ঞানের যে চর্চা সেখানে আমাদেরমত 'অনুন্নত' রাষ্ট্রগুলোর গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর 'আস্থা' রাখা যায় না। কারণ, এখানে শুধু আস্থার বিষয় না, বরং এর সাথে বৈষয়িক রাজনীতির বিষয়টিও জড়িত। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ওষুধকেন্দ্রিক যে রাজনীতি বিরাজমান, সেখানে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান এখনো বিশ্ব বাজারে কোনভাবেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে জায়গা করে নিতে পারে নি, কিংবা নেয়ার চেষ্টাও করেনি। অন্যদিকে দেশিও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকার বা রাষ্ট্র নানাভাবে/কোনভাবে দায়গ্রস্ত না, যেমনটা করে এই সকল বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। কারণ, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সাথে পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত। তাই আমার দেখার জায়গাটা এই বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ওষুধ কোম্পানিগুলোর গবেষণা এবং ঔষধ উৎপাদন কেন্দ্রিক যে রাজনীতি, তাকে একটু স্পষ্ট করার চেষ্টা করা।

রোগকে চিকিৎসা বিজ্ঞান একভাবে ব্যাখ্যা করে, এবং এর সাথে আমাদেরমত যারা সমাজ গবেষক আছেন, তাদেরকেও সেই সকল রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ধার করে, বা নিয়োগ দেয়, রোগের সমাজতত্ব বোঝার জন্য। রোগের দুইটি দিক থাকে, একটি সম্পূর্ণ জৈবিক দিক, আরেকটি সামাজিক দিক। যে কোন রোগকে সমাজ না বুঝে তার ওষুধ বানানো সম্ভব না, বা বানালেও তা পরিপূর্ণভাবে কাজ করেনা। অন্যদিকে, রোগকে ধর্মীয়, বিশ্বাস, অবিশ্বাস বিভিন্ন ব্যাখ্যাতেও আপনি ব্যাখ্যা করতে পারেন, সেটা অন্য আলাপ। বর্তমান সময়ে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাঝে আমরা বসবাস করছি, তার প্রেক্ষেতি রোগকে না বুঝলে আসলে পাপ হয়ে যাবে। রোগ, শুধু মাত্র রোগ নয়, বরং এটি তার চেয়েও অনেক বড় বাজার-অর্থনীতির বিষয়, এবং এর সাথে বৈশ্বিক পুঁজি ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফার বিষয় সরাসরি জড়িত।

রোগ নিয়ে কী কী ধরনের রাজনীতি হয়, এবং কী কী ধরনের ব্যবসায়িক বিষয় আছে তা নিয়ে খোদ একাডেমিয়াতেই অনেক অনেক আলাপ আছে। কোন একটি রোগ কিভাবে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গিয়ে ছড়ায়, এবং এই সংক্রমণের সাথে সবসময় বর্তমান করোনাভাইরাস আক্রান্ত পরিস্থিতির মতো দেখা যায় না, অনেক সময় এটা ইচ্ছাকৃতভাবেও ছড়ানো হয়। খুব সম্প্রতি এইডস নিয়ে খুব বেশি আলাপ শোনা যায় না। কিন্তু, আজ থেকে ২০ বছর আগেও দুনিয়াতে এইডস ছাড়া ভয়ংকর আর কোন রোগ ছিল কিনা সেটা ভাবতেও ভয় হতো। এই এইডস এর বিশ্বায়নের সাথে কী কী ধরণের রাজনীতি আছে, সেটা বোঝা জরুরি। এই এইডস কেন এখন আর মহামারী আকারে আফ্রিকাতে ছড়ায় না? কেন এইডস এখন আর ভয়ংকর রোগের আলাপে নেই? সবাই সচেতন হয়ে গেছে, কনডম ব্যবহার করে, তাই? অবশ্যই না। বরং এর সাথে যে বাজার অর্থনীতি আছে, এর সাথে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর লগ্নিকৃত অর্থ আছে, তার প্রেক্ষিতে বোঝা দরকার।

রোগ বোঝার জন্য রোগকেন্দ্রিক যে ডিস্কোর্সগুলো তৈরি হয়, বা করা হয় সেগুলো বোঝা দরকার। বিভিন্ন রোগ ও স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমে জ্ঞান উৎপাদন করে। যেমন কোন একটি 'অবস্থা'কে রোগ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮০'র দশকের আগে স্ট্রেসকে অসুস্থতা হিসেবে বিচেচনা করা হয়নি, প্রথমে এইরকম এইটি দশা থাকতে পারে বা আছে, তাকে নির্ধারণ করা হয়েছে, এবং তা সম্পর্কে জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। পরবর্তিতে এই অবস্থা বা অসুস্থতা বা রোগ সম্পর্কে জনগণের কাছে জ্ঞান বিতরণ করা হয়। এর জন্য বিভিন্ন রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, ডাক্তাররা সেই জ্ঞান জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করে। যেহেতু এগুলো আমাদের কাছে 'বিজ্ঞানসম্মত', তাই আমরা এগুলো (তাদের বক্তব্যগুলো) আমাদের কাছে 'সত্য' হিসেবে ধরা দেয়, এবং সেগুলোকে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি, এভাবেই ডিস্কোর্স উৎপাদিত হয়।এই ডিস্কোর্সগুলো আগের যে ধারণাগুলো আছে, সেগুলোকে সরিয়ে দিয়ে নতুন ধারনাকে প্রতিষ্ঠিত করে। তারপর, এরকম দশা থেকে সেখান থেকে রক্ষা পাবার জন্য নানা ধরনের উপায় বাতলে দিতে শুরু করা হয়, যেগুলো আমরা চিকিৎসা বা ওষুধ নামে চিনে থাকি। অর্থাৎ, প্রথমে রোগ সম্পর্কে জানানো হয়, এবং রোগ এর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়, এবং সেখানে নানান ধরণের ওষুধ দেয়া হয়।

বড় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো রোগের এই ধরনের গবেষণা এবং 'বাজার' সৃষ্টির জন্য কোটি কোটি টাকা প্রতিদিন খরচ করছে। এর খুব ছোট্ট উদাহরণ হচ্ছে, আপনি এই দেশের যে কোন বড় ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে ডাক্তার দেখিয়ে বের হবার সময় আপনার প্রেসক্রিপশনের উপর অনেক 'টাই-পড়া' লোকের হামলে পড়তে হয়তো দেখেছেন। তারা কী কী ওষুধ দেয়া হচ্ছে তা জানার চেষ্টা করেন। এরা সবাই আলাদা আলাদা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। তার মাঠ পর্যায়ে কাজ করে, সেই তথ্যগুলো প্রতিষ্ঠানের উপরের কর্মকর্তাদের জানান এবং বাজার বিস্তৃত করার জন্য কাজ করে যান। আবার আপনি যদি ভাল ডাক্তার হন, বা তাদের সাথে পরিচয় থাকে, তবে জানবেন, বিভিন্ন ওষুধ লেখার জন্য ডাক্তারদের কী কী ধরনের 'গিফট' ওষুধ কোম্পানিগুলো দিয়ে থাকে, কেউ কেউ ঢাকায় ফ্ল্যাট পেয়েছেন বলে শোনা যায়। আমার কাছের বন্ধু বড় টেলিভিশন আর ফ্রিজ পেয়েছে বলে আমি জানি। এই গিফটের টাকা কি কোম্পানির মালিকের বাড়ির জমি বিক্রয় করে আসে, অবশ্যই না, সেটা আপনার কেনা ওষুধের দাম থেকেই যায়। এরকম, প্রতিদিন, প্রতি দেশে ছোটবড় অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো অসংখ্য কর্মী নিয়োগ করে রেখেছে, যারা ওষুধের বাজারজাতকরণের কাজ করছেন, কমিশনের বিনিময়ে। কিন্তু, এখানেই আসলে গল্প শেষ না, এর পেছনে আরও ভয়ংকর কিছু গল্প আছে, যেখানে আমি, আপনি গিনিপিগের ভূমিকা পালন করি।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার অনুমতিপ্রাপ্ত সেই বিশাল রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কলেরা রোগের ওষুধ আবিষ্কারের জন্য দুনিয়া জুড়ে সমাদৃত। এছাড়া, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া নিয়েও তাদের অনেক অনেক কাজ আছে, যেখানে তারা অনেক অনেক সাফল্য দেখাচ্ছে। কিন্তু, কথিত আছে, ১৯৬৮ সালের দিকে যখন তারা পূর্ব পাকিস্থানে কাজ শুরু করে, তখন কলেরার মহামারী দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে, চাঁদপুরের মতলব এলাকায়। অনেকেই বলে থাকেন, অনেক পুকুরে কলেরার জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, শুধু মাত্র আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মারা গিয়েছে, অসংখ্য 'স্যাম্পল' পাওয়া গিয়েছে। বিভিন্ন ওষুধ তৈরি করা হয়েছে, এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য, এবং সেগুলো আক্রান্তদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়েছে বিনামূল্যে। তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন ধাপে ওষুধের একটা সহনীয় মাত্রা সম্পর্কে জানা গেছে, যা করতে অনেক বছর লেগেছে, এবং সেটা একটা ভাল ওষুধ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সেজন্য এখানে তারা ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে থাকে, এমন কি যক্ষ্মার জন্যও দিয়ে থাকে। এই 'ফ্রি' চিকিৎসা আসলে ফ্রি নয়, বরং গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবন্ত উপাদান হিসাবে আপনি ব্যবহৃত হচ্ছেন। মিশেল ফুকোর বায়ো-পাওয়ারের তত্ত্ব ব্যবহার করে অনেক সমাজ গবেষক অনেক গবেষণা প্রতিবেদন দেখিয়েছেন এসকল বিষয়ে, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে কেউ সরাসরি কাজ করেছেন বলে আমার জানা নেই বা এটা বলার মত কোন দালিলিক প্রমাণ নেই, তবে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর The Politics of Essential Drugs (1995) গ্রন্থে এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও Merrill Singer ও Nancy Scheper-Hughes সহ আরও অনেক গবেষকের কাজে এধরনের উদাহরণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে, সেই চাঁদপুর এলাকাতে তারা যখন শুরুর দিকে কাজ করে, তখন জনরোষে পড়লেও পরবর্তিতে গ্রামের মানুষদের বিভিন্ন কাজে তারা যুক্ত করে। এর ফলে গ্রামের মানুষেরা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হতে শুরু করে, তখন তাদের বিদ্বেষও কমতে থাকে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অনেক সমস্যাকে আর সমস্যা হিসাবে দেখায় না অথবা ভাল পয়সা দিলে আমরা অনেক সময়ই অনেক সমস্যা আর দেখতে চাই না, বা দেখিও না। কারণ, আমাদের অন্যতম সংকট পয়সার।

আমি প্রথম দিকে যে শঙ্কায় ছিলাম করোনাভাইরাস নিয়ে, সেটা গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে যাচ্ছে, তবে, আমি ভাবতে চাই আমার ভাবনা ও শঙ্কাগুলো ভুল হবে। কিছুদিন আগে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ লোক মারা যেতে পারে এই করোনাভাইরাস আক্রমণের কারণে। অন্যদিকে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন এধরনের গবেষণার দায়িত্ব পায়, তখন মনে কিঞ্চিত শঙ্কা জন্ম নেয়, অতীত ইতিহাসের প্রেক্ষিতে। করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা দুনিয়া মারাত্মকভাবে আক্রান্ত, এবং প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। বিভিন্ন রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য দিন রাত কাজ করছে। এটা মানব সভ্যতার জন্য রীতিমত হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দরকার ওষুধ, যত দ্রুত সম্ভব এবং ভাল, ও কার্যকরি ওষুধ। এই ভাল ও কার্যকরী ওষুধ শুধু ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন করলেই কাজ হয় না, সেটা মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা করতে হয়। এই পরীক্ষাগুলোতে শরীরের বিভিন্ন রেসপন্স এর উপর নির্ভর করে ওষুধকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকরি করে তোলা হয়, এটা বেশ লম্বা সময়ের বিষয়। ১/২ মাসে, বছরে সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়স, লিঙ্গ, পরিবেশ ইত্যাদিও বিবেচনায় আনতে হয়। তারমানে, ওষুধ বানানো এতো সহজ কাজ না। কিন্তু এই এক্সপেরিমেন্ট কোথায় করা হবে সেটা হচ্ছে বিষয়।

সাধারণত দেখা যায়, এই ধরনের এক্সপেরিমেন্টগুলো দুনিয়ার তুলনামূলক গরিব রাষ্ট্রে পরিচালনা করা হয়, যেখানে আসলে জনগণের জীবনের মূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম, এবং অতীতে বাংলাদেশে এরকম অনেক রোগের ওষুধের এক্সপেরিমেন্টাল গ্রাউন্ড হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ৯০ দশকের শুরুতে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের পশ্চিমা জন্মনিরোধক গ্রামাঞ্চলের নারীদের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে।  তাই ইতিহাস বলে, এখানে এমন এক্সপেরিমেন্টের শঙ্কা অমূলক না। অন্যদিকে, আমাদের যে দারিদ্রের চিত্র, এবং প্রতিদিনের জীবনে যেভাবে ল্যাপ্টালেপ্টি করে বসবাস করি, তাতে এই ধরণের সংক্রামক রোগ খুব দ্রুত সংক্রামিত হতে সময় নিবেনা। অর্থাৎ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শঙ্কা সত্যও হয়ে যেতে পারে। তখন এখানে প্রচুর পরিমাণে রোগী পাওয়া যেতে পারে, যাদের স্যাম্পলগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রথমে করোনা আছে কি নেই, তা নির্ধারণ করা হবে। পরবর্তীতে হয়তো 'ফ্রি' চিকিৎসার ব্যবস্থাও হতে পারে। এই ফ্রি চিকিৎসা যদি দেয়া হয়, তবে বুঝে নিতে হবে, বিভিন্ন ধরনের ওষুধগুলোর মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলক কাজ বিদ্যমান রয়েছে। অন্যভাবে বললে, আমাদের শরীরের স্যাম্পলগুলো বৈষয়িক করোনা মহামারী রক্ষার ওষুধ আবিষ্কারে সহায়ক হতেই পারে। তাই আমাদের উচিত নিজেদের যাবতীয়ভাবে এই রোগ থেকে মুক্ত রাখার জন্য যা যা করা দরকার, তাই করা। আমার সম্মতিতে অন্যের কাছে এক্সপেরিমেন্টের উপাদান হতে সমস্যা নেই, কিন্তু না জেনে এক্সপেরিমেন্টের বিষয় হলে নিজেকে গিনিপিগ ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না।

অন্যদিকে, যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ রোগী তৈরি না হয়, রোগ গবেষণার পেছনে যে বিশাল পরিমাণ অর্থ লগ্নী করা হয়েছে, সেটা উঠে আসবে না। এটাকে উঠিয়ে আনতে হলে প্রচুর পরিমাণে রোগী দরকার হবে, কারণ, ওষুধের ব্যবসা করতেই হবে, যা বিভিন্ন রোগের জন্য করা হচ্ছে। সরল করে বললে, ওষুধের বাণিজ্যের জন্য প্রথমে দরকার রোগের বাজারজাতকরণ, এবং পরে নিরাময়ের ব্যবস্থা। রোগ শুধু রোগ না, বর্তমান নব্য-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক বাজারে রোগকে একটি বাজারের পণ্যর মত করেই বুঝতে হবে। মানবতার জন্য এই সময়ে বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো বা হাসপাতালগুলো কাজ করেনা, দিন শেষে তারা ব্যবসায়ী, যে কারণে, বাঁচার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত 'সেবা' ক্রয় করি। রাষ্ট্র আমাদের এখানে অনেক সেবা বিনামূল্যে দেয়ার চেষ্টা করে, কারণ এই রাষ্ট্র এখনো পুরোপুরি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি, তবে চেষ্টা করছে। করোনাভাইরাসকে আমরা এভাবেও দেখতে পারি, তবে, এটাকে এখনো বাজারের পণ্য হিসেবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে কিনা জানিনা, তবে, কিউবায়, চিনে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাক্তাররা এবং নার্স এবং সরকারগুলো যেভাবে কাজ করছে, তাতে একে এখনো পণ্য হিসেবে দেখেননি তারা, বোঝাই যায়। তবে সবাই নয়, অনেকে এই জায়গায় স্বার্থপরতার নিদর্শনও রেখে যাচ্ছেন।  অনেক জায়গাতেই ডাক্তাররা মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে, যে যেভাবে পারছেন। অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার আবার হাসপাতালে আসছেন, মানুষের সেবা করার জন্য। ওই সব সমাজে মানুষের জন্য মানুষের মানবতা বিদ্যমান। আমাদের এখানে কি হবে আমরা এখনো জানিনা। আমাদের সমাজে মানবতা কতখানি আছে বা নেই সেই বিচার আপনাদের কাছে, এটা নিয়ে স্পষ্ট মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে করোনা ভাইরাস আমাদের সমাজের অনেক ব্যবস্থাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, অনেক চর্চাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। আমরা যে অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কতখানি মানবিক, বা মানবিকতা বলতে আসলে কী বোঝায়, সেগুলোকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। এই করোনা, কিভাবে নতুন সমাজ ব্যবস্থার নানা দিক সূচনা করতে পারে, বা ইতোমধ্যে করেছে, সেটা নিয়ে অন্য আরেকটা আলাপে আলাপ করা যাবে। আমাদের বর্তমান চর্চাগুলো থেকে বের হতে হবে, এবং এই অবস্থা, ১/২ মাসে শেষ হবে না, এটি অনেক দীর্ঘ সময় ধরে থাকবে, তাই মানসিক প্রস্তুতি খুব জরুরি। হেরে যাওয়ার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।