করোনাভাইরাসে জনসমাগম: প্রশাসনিক মোকাবেলা বনাম নাগরিক অধিকার

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনশেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
Published : 31 March 2020, 12:03 PM
Updated : 31 March 2020, 12:03 PM

বাংলাদেশে বার কয়েক সেনা শাসন হয়েছে। রাজনীতিবিদ ও সিভিল প্রশাসনের 'ভয়ংকর দুর্নীতি'র অভিযোগে সেনা শাসন জারি করার পর সেনা কর্তৃত্ব বহাল ও জারি রাখার জন্য সারা দেশে নামিয়ে দেয়া হতো সৈন্যদের। দেখা যেত, সেনা সদস্যরা রাস্তাঘাটে লোকজনকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন, বড় চুলওয়ালা যুবক ছেলেদের ধরে এনে নাপিত দিয়ে 'আর্মি ছাট' করিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে সারা দেশে একটা 'প্যানিক' হত। সেনা শাসকরাও জনগণকে ভয় পাইয়ে দিয়ে খুশি থাকতেন; মাঠ পর্যায়ের সেনা সদস্যরা জনগণকে হেনস্থা করে 'স্যাডিস্টিক' বা ধর্ষকামজনিত আনন্দ লাভ করতেন। সম্প্রতি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ ও সেনাবাহিনির কেউ কেউ দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় এই ধরনের 'স্যাডিস্টিক' কাজ করছেন বলে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে। তারা কি জনগণকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছেন? নাকি ধর্ষকামজনিত মজা নিচ্ছেন, না অতি উৎসাহী হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন?

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সারাবিশ্ব এখন কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের আক্রমণে থর থর করে কাঁপছে। ৩১ মার্চ সকাল পর্যন্ত ১৭৭টি দেশে আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে ৭ লক্ষের বেশি এবং মৃতের সংখ্যা ৩৬ হাজারের বেশি। বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো নয়। করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে ঘোষণা করা হয়েছে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি। ছুটির মধ্যে ঢাকাসহ শহরগুলো থেকে কোটি মানুষ চলে গেছেন গ্রামে ও বাংলাদেশের আনাচে, কানাচে। অনেক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এটিকে আত্মঘাতী ও ভয়ংকর বলে মনে করছেন।

আগামী ১০/১৫ দিনের আগে প্রকৃত পরিস্থিতি জানা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এর মধ্যে 'হোম কোয়ারান্টিন', সন্দেহভাজনদের পৃথক করে রাখা ও সামাজিক সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মাঠে কাজ করছে জেলা, উপজেলা, বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় প্রশাসন। তাদের সহযোগিতা করছে আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনি ও সেনাবাহিনি। তারা দেশের অধিকাংশ জায়গায় সুষ্ঠুভাবে কাজ করলেও, কোনো কোনো কর্মকর্তা ও বাহিনি সদস্যদের ব্যত্যয়, বিচ্যুতি ও কোথাও কোথাও নাগরিক অধিকার লংঘনের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ছাপা কাগজ ও অনলাইন পত্রিকগুলোতে প্রকাশিত কয়েকটি খবর এরকম–

এক. ২৭ মার্চ বেলা সোয়া ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানার গণকপাড়া মোড়ে অটো রিকশায় ভ্রমণরত এক যুবককে থামায় পুলিশ। কি কাজে কোথায় যাচ্ছেন, এ প্রশ্নের সদুত্তর না পেয়ে পুলিশ তার পায়ের স্যান্ডেল খুলে রাস্তা কত গরম সেটি অুনভব করতে বলেন। এরপর তাকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। একইভাবে আরেক যাত্রীকে প্রথমে স্যান্ডেল খুলে রাস্তায় দাঁড় করানো হয়, পরে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৭ মার্চ, ২০২০)। এ বিষয়ে বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিবারণ চন্দ্র মন্ডল বলেছেন, কাউকে কান ধরে ওঠবস করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, মোটিভেশন দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার কথা।

দুই. ২৭ মার্চ বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে যশোরের মনিরামপুরের চিনেটোলা বাজারে অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন দুই বৃদ্ধ। এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। তাদের মুখে মাস্ক ছিল না। এই সময় পুলিশ ওই দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান শাস্তি হিসেবে তাদের কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয়, এ সময় নির্বাহী ম্যাজস্ট্রিট নিজেই তার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। শুক্রবার রাতেই সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইন, ২৮ মার্চ, ২০২০)।

তিন. ২৭ মার্চ সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ইউএনও সিফাত-ই-জাহান র্কতৃক ৫ জনকে কান ধরিয়ে ওঠবস করানোর ছবি স্থানীয়দের মাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেলে জনমনে চাপা ক্ষেভের সৃষ্টি হয় (যুগান্তর অনলাইন, ২৯ মার্চ, ২০২০)।

এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, করোনাভাইরাসের কারণে ইতালি, স্পেন, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনসহ অনেক দেশ পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরিতে। বাংলাদেশের অবস্থাও উদ্বেগজনক। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জনসমাগম ঠেকাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ, সেনাবাহিনি, ও ভ্রাম্যমাণ অদালত। কিন্তু এটাও সত্যি যে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সেনাবাহিনি, পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যদের কাজগুলো করতে হবে সাংবিধানিক ও আইনী কাঠামোর মধ্যে থেকে।

জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও জীবন বাঁচানোর জন্য দেশে দেশে লক ডাউন, কার্ফ্যু, কোয়ারান্টিন, আইসোলেশনসহ নানা চরম ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এতে নাগরিক অধিকার খর্ব এবং সংকুচিত হলেও; সবাই সামষ্টিক স্বার্থে সেটিকে মেনে নিচ্ছেন। এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে, এই মহাসংকটের সময়ে জনগণের তরফ থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের নামে সরকারি কর্মকর্তা ও বাহিনির সদস্যরা যা খুশি তাই করতে পারেন না।

আইনের একজন ছাত্র হিসেবে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, উল্লেখিত ঘটনাগুলোতে পুলিশ, ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সুস্পষ্টভাবে তাদের বিভাগীয় বিধি, প্রচলিত আইন ও সংবিধান লংঘন করেছেন। রাষ্ট্রের সবচেয়ে শিক্ষিত, সম্মানিত ও ক্ষমতায়িত বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমরা সুবিবেচনাপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করি। যশোরের মনিরামপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান ও সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ইউএনও সিফাত-ই-জাহান মানুষজনকে যে কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন, সেটি শুধু আইন ও সংবিধানেরই লংঘন নয়; প্রত্যেকটি মানুষের যে মানবিক মর্যাদা, সেটি তারও সুস্পষ্ট লংঘন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, "কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারো সহিত অনুরূপ (অর্থাৎ অমানবিক ও অবমাননাকর) ব্যবহার করা যাইবে না"। এ অনুচ্ছেদের মধ্যভাগে, যেখানে বলা হয়েছে যে, "কোন ব্যক্তিকে নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না" – এই অংশটি বিচারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কেননা, একটি ফৌজদারী মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বিচারকরা অপরাধীদের দণ্ড (বা শাস্তি) প্রদান করেন; এবং সেই শাস্তি প্রদান করতে গিয়ে কোন বিচারক যেন এমন দণ্ড প্রদান না করেন, যেটি নিষ্ঠুর ও অমানবিক; যেমন, চাবুক মারা, শূলে চড়িয়ে দেওয়া, ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা ও ধর্ষণের জন্য ধর্ষকের শিশ্ন কর্তন করা ইত্যাদি।

৩৫ (৫) অনুচ্ছেদের প্রথম ও শেষ অংশটি, অর্থাৎ "কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না … কিংবা কাহারো সহিত অমানবিক ও অবমাননাকর ব্যবহার করা যাইবে না" – প্রযোজ্য হবে পুলিশ, র‌্যাব, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সরকারি অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রতি; কেননা, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে তারা জনগণের সঙ্গে এমন কোনো ব্যবহার করতে পারবেন না, যেটি অমানবিক ও অবমাননাকর। এই কাজটিই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান ও ইউএনও সিফাত-ই-জাহান মানুষের সঙ্গে করেছেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা (বা তাদের পক্ষ থেকে কোন মানবাধিকার সংগঠন) এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ইউএনওর বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘন ও তার প্রতিকারের জন্য সংবিধানের ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট মামলা দায়ের করতে পারবেন।

ভুক্তভোগীরা যদি দায়ী প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি নিশ্চিত করতে চান, তাহলে মামলা করতে হবে ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে। এই আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থাসহ যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা কাউকে নির্যাতন করেন এবং এটি প্রমাণিত হলে দায়ী সরকারি কর্মকর্তাকে কমপক্ষে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। কোনো সরকারি কর্মকর্তার হেফাজতে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে, যদি প্রমাণ করা যায় যে নির্যাতনের ফলে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তাহলে সরকারি সংস্থার নির্যাতনকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।

তাহলে এ কথা বলা যায় যে, খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ ও সম্মানিত বয়স্ক নাগরিকদের কান ধরে ওঠবস করিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এবং পুলিশ বাহিনির সদস্যরা একদিকে তাদের সম্মানহানি করেছেন; অন্যদিকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে, সেটি লঘু হলেও বাংলাদেশের সংবিধান এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ লংঘন করেছেন। একই সঙ্গে তারা প্রশাসনিক আচরণবিধি ও শিষ্টাচার লংঘন করে সম্মানিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। অতি উৎসাহী, উদ্ধত, ও শিষ্টাচার বর্জিত সরকারি কর্মকর্তারা যেমন ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে (কুড়িগ্রামের ডিসির কাণ্ড আমরা দেখেছি) গণমাধ্যম কর্মী, চিকিৎসক, শ্রমজীবীসহ সাধারণ মানুষের মানবিক মর্যাদার হানি ঘটান তেমনি তাতে লংঘিত হয় সংবিধান ও প্রচলিত আইন। এ ধরণের সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নিলেই হবে না, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দিতে হবে আইন নির্দিষ্ট দণ্ড।