‘করোনাভাইরাস আক্রান্ত সাংবাদিকতা’র লকডাউন চেহারা

রাজীব নন্দী, তাসনুভা তাহসিন এবং জাওয়াদ হোসাইন
Published : 30 March 2020, 12:52 PM
Updated : 30 March 2020, 12:52 PM

নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সারা বিশ্ব। যাকে বলছি- করোনাক্রন্তিকাল। সমাজ লকডাউন। করোনা মহামারী রুখতে নানা ধরনের বিধিনিষেধে জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে গেলে। এয়ারপোর্টের রানওয়েতে নামছে না উড়ান, হাইওয়েতে নেই গতির দেবতা, কলকারখানায় নেই হাতুড়ির শব্দ, নেই গণজমায়েত, নেই যেদিকে দু'চোখ যায় চলে যাওয়ার মতো ভ্রমণযাত্রীর পথচলা। নেই সংবাদপত্রের হকারের ব্যস্ততা। করোনার প্রভাব পড়েছে সংবাদপত্র প্রকাশনাতেও। আমাদের এই আলোচনা সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে। কারণ আমরা জানি, সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা একটি সংবাদপত্রের প্রাণ। সকল পাঠক প্রথমেই নজর দেয় পত্রিকার প্রথম পাতায়। সারা দুনিয়াজুড়ে খবরের কাগজের প্রথম পাতার কদর বেশি, কেননা দিনের খবরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় সংবাদগুলো প্রথম পৃষ্ঠায় থাকে।  তাই সংবাদ জগতের প্রবেশদ্বারই হল পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা। সেই প্রথম পৃষ্ঠা তৈরিতে সংবাদ কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় বাড়তি মনোযোগ। 

সভ্যতাঘাতি দুটো বিশ্বযুদ্ধ সাংবাদিকতার জগতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। যুদ্ধের ফলাফল দ্রুত পৌঁছে দিতে সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতিতে এসেছিল পরিবর্তন। মানুষের কাছে কত আগে যুদ্ধের সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবরটি পৌঁছে দেওয়া যায় সেজন্য ইউরোপ-আমেরিকার কাগজে দেখা দিয়েছিল পৃষ্ঠাসজ্জার নানান রূপরেখা। 

লন্ডনভিত্তিক ট্যাবলয়েড পত্রিকা 'দ্য সান'। সাধারণ পত্রিকার অর্ধেক বা তার একটু বড় সাইজের পত্রিকাকে ট্যাবলয়েড বলা হয়। জানুয়ারি ২৩ তারিখে ছাপানো এই পত্রিকার প্রথম পেইজের পৃষ্ঠাসজ্জায় করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ফ্ল্যাশ লেফট হেডলাইন করেন দ্বিতীয় লিডে। খবরটিকে গুরুত্বারোপ করতে এটিকে বক্স স্টোরি করা হয়েছে। বিস্তারিত সংবাদ প্রথম পৃষ্ঠায় জায়গা কম পেলেও মূলত এখানে হেডলাইনে জোর দিয়েছে তারা। সাথে একজন মাস্ক পরা নারীর লাগেজ হাতের ছবি দেয়াতে বার্তাটি জোরালো হয়েছে।

স্কটল্যান্ডের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র 'দ্য সানডে মেইল'। ১৫ মার্চ পত্রিকাটি করোনাভাইরাসের সময়ে বিশ্বব্যাপী যে সংকটের সৃষ্টি তা নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা সাজিয়েছে। ব্যানার শিরোনামের সাথে উপরে আইব্রোও ব্যবহার করে তারা। ডানপাশে সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য বুলেট ফরমেটে দেওয়া হয়েছে। একজন ডাক্তার থার্মাল স্ক্যানার হাতে এবং আরেকজন মাক্স মুখে ফোনে কথা বলার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে করোনার আবহ বোঝাতে। সেখানে তাদের উভয়ের বাক-ভঙ্গিমায় চলমান সময়ের অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। অপরদিকে স্কটিশ আরো একটি পত্রিকা 'দ্য স্কটিশ সান' একই দিনে তাদেরও পৃষ্ঠাসজ্জা করেছে ভাইরাসের কারণে রাণীর 'মহল ত্যাগ' নিয়ে। যেহেতু যুক্তরাজ্যসহ তার সকল উপনিবেশের জন্য রাণীর এই সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ তাই গাড়িতে যাওয়া রানীর ছবিসহ  বোল্ড অক্ষরে ফ্লাস লেফট শিরোনাম করেন। তারা উপর লাল কালিতে একটি হেডিংও দিয়েছে ওরা। 

'স্কটল্যান্ড অন সানডে' পত্রিকার প্রথম পেইজেও করোনাভাইরাস দেখতে যেমন তার প্রতিকৃতি তুলে ধরা হয়েছে অনন্য এক গ্রাফিক্সে। ভাইরাসের গায়ে যে স্পাইকগুলো আছে সেগুলোর একেকটিতে স্কটল্যান্ড'র উপর পড়া প্রভাবগুলো তথ্যাকারে পরিবেশন করা হয়েছে। যেটি অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও সৃজনশীল মানের। 'দ্য ন্যাশনাল' পত্রিকার রোববারের সংস্করণ 'সানডে ন্যাশনাল'। তারা ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে পৃষ্ঠাসজ্জায়। পৃথিবী পুরোটাই যেহেতু করোনায় আক্রান্ত সেহেতু তারা গ্রাফিক্স এর মাধ্যমে পৃথিবীর ছবিতে ভাইরাসের স্পাইক দিয়ে সাজিয়েছে। সেইসাথে কালো রংয়ের ব্যবহার করে একটি বিষাদগ্রস্ত ছাপ তৈরি করেছে পত্রিকার মেজাজে। এবং নতুন বিশ্ব আর ভাইরাসের কথা উল্লেখ করে টাইটেল শিরোনাম দেয়। 'সানডে এক্সপ্রেস' সবকয়টি কলাম জুড়ে ব্যানার হেডলাইন বিস্তৃত। পুরো শিরোনাম রিভার্স প্লেটে লিখা। ডেকে লাল কালিতে লিখা শিরোনাম সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করছে। এছাড়া সাবহেডলাইনের ব্যবহারও হয়েছে। মেকাপটি একেবারেই আলাদা ধরনের, কেননা মাস্ট হেডের উপরে স্ব পত্রিকার বিজ্ঞাপন, বৈচিত্র্যময় শিরোনাম ব্যবহার, মুদ্রাক্ষর বিন্যাস মেকাপটিকে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করেছে। করোনাক্রান্তিতে যা সময় উপযোগিতা নির্দেশ করে। সার্বিকভাবে এই পেইজের ক্রিয়েটিভিটি চমৎকার। ডেক লাল কালিতে ও মূল শিরোনাম রিভার্স প্লেটে লিখে সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পাঠককে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পৃষ্ঠাসজ্জায় বৈচিত্র্য আনা হয়েছে৷ সবমিলিয়ে পেজের ক্রিয়েটিভিটি পাঠককে পত্রিকাটি পড়তে উৎসাহিত করছে।

যেহেতু একটি সংবাদ শিরোনামের প্রধান কাজ খুব সংক্ষেপে ও তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদের মূল কথাটি পাঠককে জানিয়ে দেয়া, সেহেতু আনন্দবাজার পত্রিকার মূল সংবাদ শিরোনাম একটি আদর্শ সংবাদ শিরোনাম  বলা যায়। একটি মাত্র শব্দ 'সাবধান' দ্বারা সামগ্রিক অবস্থায় সতর্ক থাকার যে কোন বিকল্প নেই তাতে জোর দেওয়া হয়েছে। পেইজ মেকাপটি আদর্শ একারণে যে তা পাঠককে খুব আকৃষ্ট করে। 'দ্য মেইল' পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে শিরোনাম কিছুটা গুরুগম্ভীর। পত্রিকার সবকয়টি কলাম জুড়ে ব্যানার হেডলাইনে দিনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম বিস্তৃত। পুরো পৃষ্ঠায় শিরোনামের আধিক্য, স্বল্প সংবাদের জন্য মেকাপটি আলাদা। সমসাময়িক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংবাদ শিরোনামগুলো সাজানো, তাই সময়োপযোগী। এই পৃষ্ঠাসজ্জার মূল বক্তব্য হলো 'সচেতনতা'। শিরোনামের ব্যবহার, মাস্ট হেডের দুই পাশ জুড়ে সংবাদ সংযোজন, বক্স হেড, জাম্প হেডের ব্যবহার ও পৃষ্ঠাসজ্জার ব্যবহার সব মিলিয়ে  পেজের ক্রিয়েটিভিটি অন্যরকম।

বাংলাদেশের 'দৈনিক আমাদের সময়' পত্রিকা একটি অভিনব কাণ্ড ঘটিয়েছে। ব্যবহৃত মূল শিরোনাম লাল কালিতে লেখা হয়েছে, যা দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম হিসেবে চিহ্নিত। বাকি শিরোনামের সবকয়টি সমসাময়িক ইস্যুতে লিখিত যা পাঠককে পড়তে উৎসাহিত করছে। এদের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা হলো, ওরা মাস্টহেডের মধ্যে কয়েকটি শব্দ জুড়ে দিয়ে পত্রিকাটির নামকরণের যথার্থতা প্রমাণ করেছে। যেমন: পত্রিকাটির মাস্টহেডে লেখা হয়েছে- আমাদের (দূরত্ব মানা উচিত ঘরে) সময় (দেয়া ভালো)! সেই সাথে পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে অসংখ্য সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে।  সবকয়টি কলামেই সংবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। সমসাময়িক ইস্যুতে মাস্টহেড পরিবর্তন করা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে নবতর সংযোজন। তবে আমাদের সময়ের এমন প্রচারণার আগের দিন এই কাজটি করেছে 'দৈনিক সমকাল'। এখানে 'স ম কা ল' চারটি বর্ণকে পৃথক করেছে তিনটি বার্তা। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনমনে তৈরী হওয়া সচেতনতাকে ইঙ্গিত দেয়। দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ যেন বলে দেয়া হলো মাস্টহেডেই। যেখানে সমকাল এর প্রতিটি অক্ষরের পরপর লেখা হয়েছে 'সঠিক তথ্য জানুন', দূরত্ব বজায় রাখুন', ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন'। 

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় 'সংবাদ প্রতিদিন' এর বর্ণনা দিয়ে আমাদের আলোচনার ইতি টানছি। সংবাদ প্রতিদিন সবকয়টি কলাম জুড়ে লিখা ব্যানার শিরোনামের চাইতেও দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রাধান্য পেয়েছে মাস্টহেডেই। যা মেকাপটিকে প্রথাগত সাংবাদিকতা থেকে আলাদা করেছে। মাস্টহেডের বৈচিত্র্য একইসাথে সচেতনতামূলক বার্তা ও সৃজনশীলতাকে নির্দেশ করে। মাস্টহেডে বৈচিত্র্য, শিরোনামের যথাযথ ব্যবহার, পৃষ্ঠাসজ্জা, সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সংবাদ, মুদ্রাক্ষর ও ছবির বিন্যাস সব মিলিয়ে দৃষ্টিনন্দনীয় এবং পেইজটিকে ক্রিয়েটিভ বলা যায়। প্রখ্যাত লেখক সৌরিণ ব্যানার্জী বলেছেন, "অঙ্গসজ্জার রীতিনীতি কাগজের সমস্ত পৃষ্ঠার জন্যই। তবু প্রথম পৃষ্ঠার গুরুত্ব সর্বাধিক। যেন সুয়োরানি। যত মাথাব্যথা তারই অঙ্গসজ্জা নিয়ে। প্রথম পৃষ্ঠাই তো পাঠকবর্গ প্রথম দেখে। দেখেই যদি না 'মজিল মন' অন্য পৃষ্ঠার পসরা তো অপঠিতই থেকে যাবে। প্রথম পৃষ্ঠার অঙ্গশোভা এমনই হওয়া উচিত যাতে পাঠককে বলা যায়, একটু দাঁড়াও, দেখো, পড়ো। আহ্বান যেন পৌঁছে যায় তড়িৎগতিতে"। 

সারা পৃথিবীতেই করোনাক্রান্তি চলছে। পৃথিবীর জ্বর এখন। এই জ্বরে আক্রান্ত পৃথিবীর সংবাদপত্রগুলোও। এই ক্রান্তিকাল বড় অদ্ভুত। অদৃশ্য শত্রু নিজের অজান্তে জড়িয়ে ধরবে আপনাকে। আবার এর সমাধান আরো অদ্ভুত! কেবল হাত ধুয়ে ঘরে বসে থাকো। হাত ধুয়ে বসে থাকাটা যেন 'কখন খাবার আসবে পাতে' তারই অপেক্ষা! সারা দুনিয়ায় এখন এটাই যুদ্ধ। অবাক হলেও সত্যি সভ্যতার ইতিহাসে এটাই প্রথম কোন যুদ্ধ, প্রত্যেকটা দেশ যার যার মিত্রপক্ষ! কিন্তু প্রত্যেক মানুষ প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বি। যদিও আসল শত্রুকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, অথচ তার ভয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করে গুটিসুটি মেরে নিজেকে সঙ্গরোধ করে রেখেছি। রোগতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, যোগাযোগবিদ্যা আর চিকিৎসাশাস্ত্রের সকল সমীকরণ উল্টে দিয়ে নয়া রোগের বিশ্বায়ন জারি হয়েছে পৃথিবীতে। এই অভিনব যুদ্ধের আঁচ পড়েছে সমাজের সবকিছুতেই। বাদ পড়েনি সাংবাদিকতা, নিউজপেপারের ফ্রন্ট পেইজেও রেখে গেছে কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের প্রভাব।