মহামারীকে কি স্বাগত জানাচ্ছি আমরা?

অপূর্ব শর্মা
Published : 26 March 2020, 02:01 PM
Updated : 26 March 2020, 02:01 PM

মহামারীকে কি স্বাগত জানাচ্ছি আমরা? এই কথাটি বার বার মনে হচ্ছে আজ। করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বিলম্বের পর সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে এ প্রশ্নটি মনের মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে বার বার। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে 'হুজুগে বাঙালি' শব্দটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের উদ্রেক করছে? হুজুগের কারণে জীবনকে সংকটে ফেলতেও দ্বিধা করছিনা আমরা। কিন্তু কেন এমনটি করছি? কেন?

সব বিষয়ে হুজুগ থাকা কি ভালো? নিশ্চয়ই নয়। এইযে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দশ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। সেটি মানতেও আমাদের বড্ড অনীহা। এই সিদ্ধান্তটি মানুষ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে, জীবন বাচাঁনোর জন্য গ্রহণ করা হলেও সেটি আমলে নিচ্ছিনা আমরা। 'ছুটি' ভোগ করার জন্য রওয়ানা হয়েছি গ্রামের উদ্দেশ্যে। সে কারণে ট্রেন স্টেশনে, বাস স্ট্যান্ডে, ফেরিঘাটে করছি ভিড়। এ দৃশ্যটি হার মানাচ্ছে ঈদে বাড়ি ফেরার দৃশ্যকে। জীবন রক্ষার প্রক্রিয়ায় অংশ না নিয়ে নিজের প্রাণকে যেমন ফেলছি সংকটে, তেমনই অন্যের জীবনকে ঠেলে দিচ্ছি হুমকির মুখে। অথচ এটা সকলেই ইতোমধ্যে জেনেছি যে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে না পারলে মহামারি রোধ করা যাবে না। ভিড়ের ছবি দেখে, এটা বুঝতে কারো বিন্দুমাত্র অসুবিধে হবেনা এরা প্রত্যেকেই শিক্ষিত, চাকুরিজীবী। কিন্তু তারা যে, অশিক্ষা এবং কুসংস্কারের বৃত্তে আবদ্ধ তাদের আচরণই স্পষ্ট করছে সেটা। চাকরিজীবী সাধারণ মানুষের এমন অমানবিক আচরণ যখন বিক্ষত করছিলো মনকে তখনই টিভি পর্দায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির সরাসরি দৃশ্য দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠেছে। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছি, যা দেখছি, সেটা কি সত্যি? এত এত নেতা-কর্মী কোন বিবেকে ভিড় জমালো হাসপাতাল এলাকায়। গা ঘেঁষে দাঁড়ালো, শ্লোগান দিলো। হ্যান্ডমাইকে পুলিশের ধারাবাহিক অনুরোধকে একটিবারের জন্যও আমলে নিলওনা। স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে মনে, এই কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা কি তাদের নেত্রীর জীবনকে সংকটে ফেলল না? করোনা আক্রান্ত কারো দ্বারা যদি খালেদা আক্রান্ত হন, তাহলে এর দায় নেবে কে? এত কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করতে পারে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভাবতেই বিস্ময় জাগে। সত্যি বলতে কি, খালেদা জিয়াকে চেহারা দেখানোর জন্যই নেতা-কর্মীরা সমবেত হয়েছিল সেখানে। তিনি আক্রান্ত হয়ে সংকটে পরতে পারেন সেটা মুখ্য ছিল না তাদের কাছে। শো-ডাউন করতে হবে তাই তারা ভিড় জমিয়েছে হাসপাতাল চত্বরে, গুলশানে তাঁর বাসভবন এলাকায়। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীও কেন ভীড় ভাঙলো না সে প্রশ্নটিও স্বাভাবিকভাবে এসে যায়।
এই দৃশ্যপটগুলো আমাদের হেঁয়ালিপনাকেই সামনে নিয়ে আসে। সরকার এবং প্রশাসনের নির্দেশনা, সমাজসচেতন মানুষের ধারাবাহিক অনুরোধ সত্বেও মানুষ কেন তা মানছে না, সে প্রশ্নটি আমাদেরকে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে।

সত্যি বলতে কি, আগামী দিনগুলোতে ঠিক কী ধরনের পরিস্থিতিতে পরতে হতে পারে আমাদেরকে তা জানেনা কেউ। শুধু এটুকু সবাই জানে, মহামারী আকার ধারণ করতে পারে করোনা। তা মোকাবেলা করা আমাদের মতো ঘনবসতির দেশে খুবই কঠিন হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, ভয়বহ ঝুঁকিতে আছি আমরা। এ ঝুঁকি জীবনের, এ ঝুঁকি সর্বনাশের। কিন্তু এই সর্বনাশকে আমরাই আমন্ত্রণ জানিয়েছি। করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশ থেকে কয়েক লক্ষ মানুষকে ঢুকতে দিয়েছি দেশে এবং তাদেরকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে পারিনি। তারা নিজেরাও করেছেন হেঁয়ালিপনা। যার চরম মাশুল দিতে হতে পারে আমাদের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিদর্শক তেড্রোস আডানম গেব্রিয়ুসের সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস ছড়ানোর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ থেকে ১ লাখে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল ৬৭ দিন। দ্বিতীয় এক লাখ আক্রান্ত হয়েছিলেন ১১ দিনে। আর তৃতীয় এক লাখ আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে মাত্র ৪ দিন। পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে তাঁর বক্তব্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯৫ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছেন চার লাখের কাছাকাছি মানুষ। তাদের মধ্য থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন সোয়া এক লাখের কাছাকাছি। প্রাণ হারিয়েছেন ২২ হাজারের মতো। বর্তমানে এ ভাইরাসে আক্রান্ত সাড়ে তিন লাখ  মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে ১১ হাজার ৮৫৬ জনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন আর ২ লাখ ৩৯ হাজার ৭১৬ জনের অবস্থা স্থিতিশীল। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম সনাক্ত হয় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগি। এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪ জন। এরমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭ জন। পরিস্থিতি যখন এই পর্যায়ে, সামনে যখন মহাসংকট, তখন আমাদের নেতারা বরাবরের মতো লাগামহীন কথা বলে যাচ্ছেন। নেতাদের সুরে সুর মিলিয়েছেন এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ী। রাজনীতিকরা বিভ্রান্ত করছেন আর ধর্ম ব্যবসায়ীরা গোড়ামি ঢুকিয়ে দিচ্ছেন অস্থিমজ্জায়। পরিতাপের বিষয়, জনতার জন্য রাজনীতি করা কোনও মন্ত্রী এমপিকে ঠিক সেভাবে পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি মানুষের। শুধু মন্ত্রী এমপি নন, অন্য কোনও স্তরের রাজনীতিবিদদের কল্যানমুখী কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ছাত্র ইউনিয়নের মতো সংগঠন যেখানে বিনামূল্যে শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেখানে শক্তিশালী অন্যান্য ছাত্র সংগঠন রেখেছে হাত গুটিয়ে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী, সাংস্কৃতিক সংগঠন যেখানে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল সচেতনতামূলক প্রচারপত্র আর মাস্ক বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে নিজেদেরকে। যেনও তাদের কোনও দায় নেই। তারা সবাই তাকিয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রীর দিকে। আমাদের মানবিক প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো এবারও উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে অনেক আশার কথা শুনিয়েছেন। অভয় দিয়েছেন। আহ্বান জানিয়েছেন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ধৈর্য্য ধরার জন্য। বিপর্যয়ে পড়া গরিব মানুষের জন্য সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে এক্ষেত্রে ধনীদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের 'ঘরে-ফেরা' কর্মসূচির আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা প্রদান, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ৬ মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ প্রদান এবং বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভিড় এড়িয়ে চলতে বলেছেন। সেইসাথে গুজব না ছড়ানোরও অনুরোধ করেছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, 'অতীতে আমরা সম্মিলিতভাবে অনেক প্রতিকূলতা জয় করেছি। এবারও জয়ী হব আমরা।' অবশ্যই অতীতের অন্যান্য দূর্যোগের মতো করোনা যুদ্ধেও আমরা জয়ী হতে চাই। এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে অবশ্যই, অবশ্যই আমাদেরকে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে আমাদের। সেইসাথে পাশে দাঁড়াতে হবে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের। গরীব এবং দরিদ্ররা যেন অনাহারি না থাকে সেই বিষয়টিও দেখতে হবে আমাদের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় করোনা মুক্ত হবে প্রিয় জন্মভূমি, স্বাভাবিক হবে জীবনযাত্রা- এটাই প্রত্যাশা।