নিরাপদ দূরত্বে থাকুন ও একা থাকুন, গরিবদের কথাও মাথায় রাখুন

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 March 2020, 12:11 PM
Updated : 22 March 2020, 12:11 PM

এক মারণ ভাইরাসের ভয়ঙ্কর সংক্রমণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধের একদিকে করোনাভাইরাস আর অন্যদিকে গোটা মানবজাতির অস্তিত্ব। কোনও একটা রোগ নিয়ে মানবজাতি এতটা আতঙ্কিত হয়েছে বলে মনে হয় না। মানবজাতির অস্তিত্বকেই যেন অকস্মাৎ চ্যালেঞ্জর মুখে ফেলে দিয়েছে আপাতনিরীহ এই ফ্লু। ঠিক সিনেমার মতো।

আজ থেকে ৯ বছর আগে নির্মিত `কন্টেজন' (Contagion, 2011) নামে একটি হলিউডি সিনেমার কাহিনির সঙ্গে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির অবিশ্বাস্য মিল আছে। ওই সিনেমায় পরিচালক স্টিভেন সোডারবার্গ দেখান, এক কল্পিত সংক্রামক ভাইরাসের আক্রমণে আমেরিকা এবং পৃথিবী তছনছ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সেখানে হংকং থেকে ফিরে মিনিয়াপোলিসের উপকণ্ঠে অজানা অসুখে মারা যায় গিনেথ প্যালট্রো অভিনীত চরিত্রটি। অজানা এক ভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে গোটা আমেরিকায়। সে দেশের হোম সিকিউরিটির কর্তাব্যক্তিরা ভাবতে শুরু করেন অসুখটি জৈব মারণাস্ত্র কি না, যা হয়তো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়লে গোটা শিকাগো শহরটাকেই কোয়ারেন্টিন বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।

'কন্টেজন' ছবির ভাইরাসটির 'বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার' (বিআরএন, অর্থাৎ এক জন আক্রান্ত গড়ে সংক্রমিত করে কত জনকে-তার নির্দেশক) ছিল ৪ (করোনার বিআরএনও এর কাছাকাছি ২.২-৩.৯)। পৃথিবীর প্রায় সওয়া দুই শতাংশ মানুষের মৃত্যু সম্ভব ছিল গল্পের ওই অজানা অসুখে। আজকের পৃথিবীর মতোই সেখানে বাড়তে থাকে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর পরিধি। কমে আসে সামাজিক সংযোগের পরিমাণ। শেষে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয় চীনে একটি গাছ ভেঙে পড়লে উড়ে যায় কিছু বাদুড়, যাদের একটির মুখ থেকে পড়া এক টুকরো কলা খেয়ে ফেলে একটি শূকর। এই শূকরটিকে রান্না করে যে শেফ, তার সঙ্গে করমর্দনের ফলে অসুখটি প্রথম হয় গিনেথ প্যালট্রো অভিনীত চরিত্রটির। কল্পিত এমইভি-১ নামের ভাইরাসটি আসলে শূকর এবং বাদুড়ের জিনের সংমিশ্রণ। খুব সম্ভবত নিপা ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে এ গল্পটি লেখা হয়েছিল।

'কন্টেজন' সিনেমায় অসুখের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছিল তাড়াতাড়ি। আমেরিকার 'সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন' জন্মতারিখের ভিত্তিতে লটারি করে দেওয়া শুরু করে এই প্রতিষেধক। যদিও পৃথিবী জুড়ে ওই অজানা অসুখে ততদিনে মারা গিয়েছে ২ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ, যার মধ্যে আমেরিকাতেই ২৫ লক্ষ।

'কন্টেজন' সিনেমায় দেখানো ভাইরাসের সঙ্গে করোনাভাইরাস কবলিত আজকের পৃথিবীর অবস্থা পুরোটাই মিলে যায়। যদিও করোনার প্রতিষেধক চটজলদি আবিষ্কারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আর এটাই এই ভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ। রোগটি দ্রুত ছড়াচ্ছে, অথচ এর কোনো ওষুধ নেই!

রোগের প্রকোপ যত বাড়ছে, তত ভয় বাড়ছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই ছোঁয়াচে রোগের আক্রমণে কলকারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস সবই বিপদে পড়েছে। আক্রান্ত কর্মীরা অফিস যাচ্ছেন না। আবার অফিসে গিয়ে বিপদে পড়ার ভয়ে সুস্থ কর্মীরাও অফিসে যাওয়া বন্ধ করেছে। এতে করে অর্থনীতি অনিবার্যভাবে অচল হতে শুরু করেছে। উৎপাদন নেই, পণ্যের চাহিদা নেই, সরবরাহ নেই, বাজার মুখ থুবড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই হচ্ছে। আর এই মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও দিশা নেই।

ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। পর্যটন খাতও একেবারে অচল হয়ে গেছে। গোটা বিশ্বেই পর্যটন বন্ধ রয়েছে। পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত বিমান, পরিবহন, হোটেল-মোটেল ব্যবসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটখাট দোকাপাটও বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

কার্যত একটা বিশ্বব্যাপী মহামন্দা নেমে আসতে শুরু করেছে। অর্থনীতির উল্টোসূত্রে এই মন্দা আসছে। বাজারে চাহিদার অভাবে এই মন্দার সৃষ্টি হচ্ছে না। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মন্দা, যেখানে চাহিদা থাকলেও জোগান থাকছে না!

যে বিশ্বায়নের কারণে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, মন্দাপরিস্থিতিটা বিশ্বায়নের ঠিক উলটো ছবি। যদি প্রতিষেধক আবিষ্কার না হয়, তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমরা এক ভয়ানক সংকটের মুখোমুখি হব। তখন আমরা কীরকম পৃথিবীতে বাস করব? ভাবলে শিউরে উঠতে হয়! একটা অন্যরকম পৃথিবী হয়তো আমরা দেখব। যেখানে বাজার বলতে প্রায় কিছুই থাকবে না। সিনেমা হল উঠে যাবে। হোটেল থাকবে না। সমুদ্রতীর থাকবে ফাঁকা। খেলার মাঠে কেউ যাবে না। ঘরে ঘরে কিছু আতঙ্কিত মানুষ হয়তো বসে থাকবে। আর পৃথিবীতে যে দিন-রাত্রি হচ্ছে, সেটাও কেউ জানবে না, যদি করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করা না যায়! তবে আমরা যেদিকে হাঁটছি, সেই রকম অবস্থা বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও আসেনি। আমরা মধ্যযুগের প্লেগের গল্প শুনেছি। সেই প্লেগও এমন ভয়াবহ ছিল না, কারণ পৃথিবীতে তখন বিশ্বায়ন ছিল না। এক দেশের মানুষের সঙ্গে আরেক দেশের মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতা এত বেশি ছিল না। তাই প্লেগ খুব বেশি ছড়ায়নি। যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখে আমরা এসে দাঁড়িয়ে, তাতে রক্ষা নেই কারও। আর্তনাদ করছে সমগ্র পৃথিবীই। বেশিদিন না। দুই কি তিনমাসের মধ্যেই আমরা জানতে পারব ঠিক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি।

তাই বলে ভয় পেলেও চলবে না। সঙ্কটকে কখনও আতঙ্ক দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না। আপাতত সচেতন সাহস ও স্বাস্থ্যপরিষেবাই শেষ কথা। সুরক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা জরুরি। কারো মাধ্যমে এই রোগ যেন না ছড়ায়-সেটাই এখন প্রধান ভাবনা হওয়া দরকার। এখন মানুষের একটাই স্লোগান হওয়া উচিত: নিরাপদ দূরত্বে থাকুন ও একা থাকুন।

তবে এই দুর্যাগে দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা মানুষগুলোর কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাদের নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। যে মানুষটা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি বা ফুচকা বিক্রি করেন, যে মানুষটা ফুটপাত, পার্ক বা সিনেমা হলের সামনে বাদাম ভাজা বা আইসক্রিম বিক্রি করেন, যে রিকশাচালক রোজ কচিকাঁচাদের বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে আয়ের উৎস খুঁজে পান, যে নারী সাতসকালে বাসাবাড়ির গৃহিণীদের ঘুম ভাঙার আগেই পরিচারিকার কাজ করতে পৌঁছে যান, যে মানুষটা গাড়ি চালিয়ে আমাদের কর্মস্থলে নিয়ে যান, যে মানুষগুলো ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে তিলতিল করে আমাদের স্বপ্নের মহল গড়ে তোলেন, যে মানুষেরা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করেন, রাস্তঘাট ঝাড় দেন, ফুটপাতে দোকান সাজিয়ে কমদামে জিনিস বিক্রি করেন, যে মানুষগুলো মন্দির-মসজিদ-গির্জার সামনে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বসে থাকেন, তাদের প্রত্যেকের গলায় এখন একটাই আকূতি—কী ভাবে জুটবে খাবার! তাদের নিয়ে ভাবনাটাও জরুরি। এখানেই আমাদের দায়িত্বশীল ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করার প্রশ্ন। আপনি সব সঙ্গ এড়িয়ে চুপচাপ বাসায় আছেন। আপনার এই পৃথক থাকার কারণে আপনার বাড়ির পরিচারক বা পরিচারিকা, গাড়ির চালক, বাগানের মালি কিংবা দোকানের কর্মচারী, অর্থাৎ আপনার উপর নির্ভরশীল কারও বেতনে যেন কোপ না পড়ে। এ ছাড়াও অসংগঠিত শ্রমিক, ভিক্ষাজীবী এবং দারিদ্রসীমার নীচে যারা রয়েছেন, তাদের জন্য সরকার যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তবেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৃথক থেকে এই মারণ ভাইরাসকে আমরা পরাস্ত করতে পারব।