বঙ্গবন্ধু জন্ম না নিলে আজ আমরা পরাধীন রাজ্যের নাগরিক থাকতাম; আরো বড় কথা হলো- 'বাংলাদেশ' নামক রাষ্ট্রের নামটাই সৃষ্টি হত না। বাঙালির অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যত ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে অবদান ঠিক এখানেই।
ইতিহাসের তথ্য, বাঙালি জাতি ও এ জনপদের অস্তিত্ব হাজার বছর ধরে চলে আসলেও কখনোই স্বাধীন-সার্বভৌম একক রাষ্ট্র ছিল না। বঞ্চিত বাঙালিকে ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ করে বঙ্গবন্ধু সেটা করে দিয়েছেন। শুধু আমরা নয়, গোটা বিশ্ব যাকে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে চেনেন, ১৭ মার্চ সেই বিশ্ববন্ধুর ১০০তম জন্মদিন। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীকে ঘিরে আয়োজিত এ মুজিববর্ষ শুরুর শুভ মুহূর্তে তাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বাংলাদেশের সবকিছুতেই অনিবার্যভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা এমন যে, বঙ্গবন্ধুকে বাদ রেখে এক লাইন ইতিহাসও রচনা সম্ভব নয়। হয়ত এ কারণেই কবি-মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের আর এক নাম রেখেছেন 'মুজিবল্যান্ড'। বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি ও বাংলাদেশে চিরস্থায়ী নেতা আখ্যা দিয়ে তিনি এও লিখে গেছেন, "যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।"
সত্যিই তো! ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখানোর যে সূচনা তিনি করেছিলেন, তারই প্রতিফলন ঘটান প্রায় ১৯ বছর পর। ১৯৭১-এ, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তার কাছেই পাওয়া বাঙালির আত্মার সংযোগ, আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। তিনি অবিসংবাদিত নেতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
জন্মশতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুকে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ঘোষণার দিনটি আজ মনে পড়ছে। ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল, শুক্রবার ছিল। বাঙালি জাতির জন্য বিশাল আনন্দঘন পুরস্কারের দিন এটি। বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের ভোটে বঙ্গবন্ধু এদিনই 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' নির্বাচিত হন আমাদের জাতির জনক। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির তালিকায় প্রথম নামটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিতে (১ বৈশাখ, ১৪১১) ২০ জন বাঙালির মধ্যে এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে বিবিসি বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নাম প্রচারিত হয়।
শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে কেন মনোনীত করেছেন- বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে জাপানের নাগাসাকি শহরের শ্রোতা মনিকা রশিদের বক্তব্য এদিন সবার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেছিলেন, "আজ আমরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যে যেখানেই বসে যা কিছু করছি, যা বলছি এর কোনোটাই সম্ভব হতো না যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে না পেতাম। তিনিই বাঙালি জাতিকে প্রথম বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি- সর্বোপরি বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। মৃত্যুভয় বা ক্ষমতার লোভ কোন কিছুই তার দীর্ঘ সংগ্রামী মনোভাবকে দমিয়ে দিতে পারেনি।" এটাই শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর এক বাক্যের তাৎপর্যপূর্ণ পরিচয়।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ আসলেই তার সঙ্গে কাটানো কয়েকটি মুহূর্ত স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। আমি সৌভাগ্যবান এ কারণে যে, আমার রাজনীতির হাতেখড়ি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে। তার ডাকে সাড়া দিয়েই ১৯৬৬ সালে নিজেকে ছাত্রলীগের ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আবিষ্কার করেছিলাম।
৬ দফার প্রচারণা চালাতে (টাউন হলে জনসভার মাধ্যমে) এদিন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার বাসায় এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানেই প্রথম দেখা। ভাতিজা সুবাদে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মী আমাদের প্রিয় চাচা জনাব এম মনসুর আলী, এম এইচ কামারুজ্জামানসহ অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বগা চাচা। সেই পরিচয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বভাবসুলভ আদরের 'তুই' সম্বোধন। সবশেষ বলেছিলেন- 'মাঠে (সভাস্থল) আয়।'
সদ্য এসএসসি পাস করেছি, পরিচয়ে তখনও কলেজের তকমা পাইনি। রাজনীতির কতটুকুই বা বুঝি? কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি র্দীঘদেহী এই মানুষটির স্নেহমাখা 'মাঠে আয়' স্বরে কী যে লুকিয়ে ছিল! তা আজও ভুলতে পারি না।
কতোদিন পেরিয়েছে, তবু প্রথম শোনা সেই শব্দগুলো এখনো সজীব-সতেজ, কানে বাঁজে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম- কেউ না নিলেও একা একা জনসভায় যাব। কিন্তু সেটি আর করতে হল না। সবার সঙ্গেই টাউন হলে গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তৃতা শুনলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মনের অজান্তেই মুগ্ধ শ্রোতা থেকে গগণবিদারী স্লোগানদাতা হয়ে গেছি। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে আমি যেন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর 'মাঠে আয়' নির্দেশের মধ্য দিয়ে হয়েছে। এরপর আর পেছনে তাকাইনি।
কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে পিতা মুজিব যেভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, সেটাই যে আমাকে পরবর্তীতে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের জিএস, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালনে উৎসাহ যুগিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
১৯৬৬ এর পর আরও কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। তার প্রগাঢ় ভালবাসা, অকৃত্রিম দেশপ্রেম, অসীম দক্ষতা-যোগ্যতা, বিনয়, কৃতজ্ঞতাবোধ, তেজস্বী ব্যক্তিত্ব সর্বাপরি উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত করার আশ্চর্য ক্ষমতা সবসময়ই আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন ৪৪ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ে স্বৈরশাসন, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন এবং ওয়ান ইলেভেন এসেছে। রাজনৈতিক জীবনেও অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কত কিছু শিখেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থাকার সেই মুহূর্তগুলো আজও ভুলতে পারিনি।
স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্মুখ সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল আমার। যার একটি ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হই। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্যা কবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনায় 'মুজিববাঁধ' উদ্বোধন করতে এসেছিলেন জাতির জনক। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। বক্তৃতা দিলাম। ডায়াস থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু এঁকে বললেন- তুই তো ভালো বলিস।
বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির জনকের দিকে। পরে দুই-একটি কথা বলে স্টেজের পাশে গেলাম। পরে এই ভেবে উৎসাহী হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্ততৃায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন, সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়।
বঙ্গবন্ধুকে 'গার্ড অব অনার' দেওয়ার মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন, ঢাকা যাব কি-না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মত হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামলো পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও।
১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক পূর্বের ন্যায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল পঁচাত্তরে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে। জেলা বাকশালের সম্পাদক ও ৫ যুগ্ম-সম্পাদক মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। জাতির জনক সেদিন তার স্বভাব ড্রেসকোড 'হাফ-শার্ট' 'লুঙ্গি' পড়েছিলেন। এই সাক্ষাতের দুইমাস পরেই যে বঙ্গবন্ধু চলে যাবেন, কে জানত সেটা! ভবনে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম। বাকশাল কমিটিতে স্থান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের নানা দিক-নির্দেশনা দিলেন। চলে আসব, ঠিক এই মুহূর্তে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন- কীরে, আমার সাথে তো ছবি না তুলে কেউ যায় না; তোরা কেন যাস!
তাৎক্ষণিক ক্যামেরাম্যান ডাকলেন। ফটোবন্দি হলাম রাজনীতির কবির সাথে। বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে নেওয়া সেই ছবি আজও আমি আগলে রাখি। তার কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন যে এটাই!