মাতৃভাষাই হোক শেষ অনুপ্রেরণা

লাভা মাহমুদা
Published : 20 Feb 2020, 12:12 PM
Updated : 20 Feb 2020, 12:12 PM

জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো অল্পকিছু উপাদানের সর্বাগ্রেই আছে আমাদের ভাষা, প্রাণের ভাষা, বাংলা ভাষা।

পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা বিস্তৃত ও ব্যাপক। এ ভাষার কারণেই আমরা অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা এবং অনন্য। ভূমিষ্ট হওয়ার পর মানব শিশু কান্নার যে শব্দ দিয়ে তার আগমনী বার্তা পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়, সময়ের সাথে সাথে সেই শব্দই আধো আধো বুলিতে ভাষায় রূপ নেয়। এটাই তার মাতৃভাষা। এই ভাষার মাধ্যমেই ভাবের বিনিময় হয়, কথার আদান-প্রদান হয়, যা বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত।

সৃষ্টির শুরু থেকে মানব সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সেই সাথে জন্ম হয়েছে হরেক রকম ভাষার। সেখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে সময়, অবস্থান, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এ কারণেই, একটি দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে কতো বিচিত্র ভাষা রয়েছে—তার কূলকিনারা করা সহজ কাজ নয়। পৃথিবীতে মাতৃভাষার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। অনেক ভাষা বিলুপ্তপ্রায়, অনেক ভাষা বদলাতে বদলাতে অন্য রকম হয়ে গেছে, অনেক ভাষায় হয়তো কথা বলে মাত্র গুটিকয়েক মানুষ।

অষ্টম শতকে শুরু হয়ে সময়ের বিভিন্ন ধারা পথে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করে। বাংলার নব জাগরণে, বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে এক সূত্রে গাঁথতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে সর্বোপরি বাংলাদেশ গঠনে বাংলা ভাষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদার আন্দোলন ১৯৪৭ এ শুরু হয়ে ১৯৫২ তে পূর্ণতা পায়। ভাষার জন্য আর কোথাও জীবন দেয়নি কেউ, ভাষার দাবিতে মরণপণ সংগ্রাম-লড়াই-আন্দোলন হয়নি পৃথিবীর আর কোথাও। সর্বোপরি আমাদের ভাষার কারণেই ২০০০ সালে জাতিসংঘ কতৃক ঘোষিত হয় 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। ১৯০টি দেশের মানুষ এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে নিজের ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ব্যক্ত করে, যাতে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিটি ভাষা স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাই দুনিয়াজোড়া এত ভাষার মধ্যে আমাদের বাংলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অনন্য ভাষা । ভাষাভাষীর সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীতে বাংলার স্থান পঞ্চম। ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, অলংকরণ, সাহিত্য সব মানদণ্ডেই বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা। 'তুই-তুমি-আপনি'-র মতো এমন বৈচিত্র্যময় প্রকাশ আর সুললিত সুমধুর আবেগের কারণে প্রিয় বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমাদের ভালোবাসা আর গর্ব অনেক অনেক বেশি।

ভাষার সমৃদ্ধি নির্ভর করে এর যথাযোগ্য ব্যবহার, চর্চা, গ্রহণযোগ্যতা আর সার্বজনীনতার উপর। ভাষা দুর্বল হয়ে যাওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে আছে ভাষার বিকৃতিসাধন, রূপান্তর, ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার, ক্ষমতাসীন মহলের উদাসীনতা।

বিশ্বায়নের কালে আকাশ সংস্কৃতি আর অবাধ তথ্য প্রবাহের এ সময়ে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় অন্যান্য ভাষার সাথে আমাদের সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকেও নামতে হয়েছে কঠিন পরীক্ষায়। কিছু বিদেশি শব্দ সময়ের দাবিতেই বাংলায় ঢুকেছে। ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকায় আমাদের ভাষায় ইংরেজির অতিমাত্রায় প্রাধান্য লক্ষণীয়। আর কে না জানে বাঙালি নিজেদের কৌলিন্য প্রকাশ করতে ইংরেজিকেই যুৎসই বিবেচনা করে। ইংরেজি জানলে সমাজের উঁচু শ্রেণিতে স্থান পেতে আর কোন বাঁধা নেই এমন ধারণাও মজ্জাগত। একাধিক ভাষায় দক্ষতা থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির এ সময়ে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটোছুটির করতে ইংরেজির বিকল্প নেই। তবে ম্যান্ডারিন, স্পেনীয় বা পর্তুগিজ ভাষাও বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারে। কারণ অর্থনীতির সাথে ভাষার যোগসূত্র অনস্বীকার্য। তাই ভাষাগত দক্ষতা একজন মানুষের অর্জিত সাফল্য বলা যেতে পারে।

ভাষা প্রবহমান নদীর মতোই, যার হাজারো বাঁক। বাঁকে-বাঁকে পরিবর্তনের ছোঁয়া। কালের যাত্রাপথে তাই অন্য ভাষার ব্যবহার ব্যকরণগতভাবেই মেনে নেওয়া হয়েছে । বিদেশি শব্দ বাংলায় রূপান্তর করার পরীক্ষা নিরীক্ষায় কিছু শব্দের রূপান্তর বাংলায় স্থান পায় আবার কিছু রূপান্তর অনুত্তীর্ণ হয়। যেমন 'মোবাইল ফোন' এর বাংলা 'মুঠোফোন' শব্দটি বেশ ভালোই জায়গা করে নিয়েছে বাংলায়। কিন্তু 'ফেসবুক' শব্দের বাংলা 'বদনবই' বা 'ইন্টারনেট' শব্দের বাংলা 'অন্তর্জাল' শব্দটি খুব একটা কদর পায়নি বাংলায়। 'ফেসবুক' বা 'ইন্টারনেট' এর মতো শক্তিশালী শব্দের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এর বাংলা অর্থগুলো। তাই সময়ের দাবিতে সার্বজনীন শক্তিশালী বিদেশি শব্দ মেনে নেওয়ার বিকল্প নেই। তবে অতিমাত্রায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার ভাষাকে সংকটে ফেলে, ভাষার নিজস্বতা বাধাগ্রস্ত হয়।

তবে ভাষার বিকৃতি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা যেমন দূষণীয় তেমনি ভুল বা অশুদ্ধ বানানে বাংলা লেখা, পড়া ও বলাও অগ্রহণযোগ্য। খুব অসচেতনভাবে আমরা আমাদের প্রাণের ভাষাটিকে আবর্জনায় পরিণত করেছি। আবার আঞ্চলিক ও কথ্যভাষার সংমিশ্রণে অদ্ভুত উচ্চারণে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, যা বাংলাভাষাকে দুর্বল করছে, শক্তিমত্তা ক্ষুণ্ণ করছে। সৈয়দ শামসুল হকের মতো আঞ্চলিক ভাষায় 'নুরলদীনের সারাজীবন' লেখার সক্ষমতা কয়জনেরইবা আছে। ভেবে দেখার সময় এসেছে, যে ভাষার জন্য পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে জীবন দিয়েছি সেই ভাষাকেই কেন এত অবজ্ঞা করছি। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলতে পড়তে এবং লিখতে পারার মধ্যে যে পরমানন্দ আছে, যেদিন আমরা বুঝতে পারবো সেদিন থেকেই বাংলা আবারো ঘুরে দাঁড়াবে। রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানব বাংলাতেই সৃষ্টি করেছেন তাঁর অনবদ্য সব রচনা। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে, গান শুনে হৃদয়ে যে আবেগ উথলে ওঠে তা কি অন্য ভাষায় ধরা যেত? জীবনের পরতে পরতে বাস্তবতা এবং পরা বাস্তবতার বোধ যা হৃদয় মনকে আলোড়িত করে, চেতনাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে, তা শুধু নিজের ভাষাতেই ব্যক্ত করা যায়। হৃদয়ের গভীর আবেগকে স্বরে এবং সুরে প্রকাশে নিজের ভাষাই একমাত্র আশ্রয়। একজন গর্বিত বাঙালি হিসেবে, একজন বাংলাভাষী হিসেবে আমার ভাষাই আমার প্রথম এবং শেষ অনুপ্রেরণা।