এমবিবিএস ও বিডিএস-এ ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে

মুশতাক হোসেন
Published : 7 June 2014, 08:54 AM
Updated : 16 August 2012, 08:57 AM

গত ঈদে আমরা ছিলাম মিশুক-তারেকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকাহত এবং ঈদে বাড়ী ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা আমাদের 'নাড়ীর টানে বাড়ী ফেরা'কে বিপদসংকুল করে তুলেছিল। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এবার ঈদে বিমর্ষ ও বিক্ষুব্ধ এইচএসসি উত্তীর্ণ বিজ্ঞান বিভাগের দু' ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। তারা কি এবার নিরুদ্বিগ্ন মনে ঈদ করতে পারছেন? এ বছর ঈদে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

গত ১২ আগস্ট ২০১২ রোববার মাননীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষনা দেন যে, এখন থেকে এমবিবিএস ও বিডিএস-এ পড়তে হলে আলাদা করে আর ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে না। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই এ বছর থেকে তারা ভর্তি হবেন।

মাননীয় মন্ত্রীর এ ঘোষণার পর থেকেই ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীগণ এ নিয়ম বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে নেমেছেন। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক অভিভাবক ও শিক্ষাবিদ ।

এ ঘোষণার পর পরই আমি ভর্তি প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের মত জানার জন্য। তাদের অনেকেই এ ধরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় বিব্রত ও উদ্বিগ্ন বোধ করেন। কারণ সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি ঘোষণা করতে হলে এক বছর আগে থেকে জনমত গঠন করে তা করা উচিত বলে তারা মন্তব্য করেন। আমি ভর্তিচ্ছু বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী ও সদ্য ভর্তি হওয়া মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা কথা বলেছি। আমি একজনও পাইনি যিনি মাননীয় মন্ত্রীর এ প্রস্তাবের পক্ষে কথা বলেছেন।

ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেক দিন যাবত কাজ করেছেন ও করছেন এমন কয়েকজন প্রশ্ন তুলেছেন একই গ্রেড সম্পন্ন (এসএসসি, এইচএসসি, জীববিজ্ঞান প্রভৃতি মিলিয়ে) একাধিক প্রার্থী (যার সংখ্যা কয়েক হাজার হতে পারে) থাকলে কোন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তাদের মধ্যে ক্রমিক নম্বর নির্ধারণ করা হবে? 'আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে', অথবা স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির মত লটারীর ভিত্তিতে?- যেমনটা আমাকে কেউ কেউ বলেছেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে কি সমস্যার সমাধান করা যাবে? আগে কোন প্রার্থী এসেছেন তা নির্ধারণ করা হবে কিভাবে? এটা কি মেধা যাচাইয়ের পদ্ধতি? এটা নিয়ে কি স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে না? তা কি কোচিং সেন্টারের দুর্নীতির অভিযোগের চেয়ে কম মারাত্মক হবে? ট্রেনের টিকেটের কালোবাজারীর মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না তো? শুধু মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ব্যাপার নয়, কোন্ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া যাবে সেটিও নির্ধারিত হবে ক্রমমানের ভিত্তিতে। এ ধরণের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে প্রায় সবাই উপস্থিত থাকবে, অনুপস্থিতির সংখ্যা খুবই সামান্য হবে। আর লটারীর ভিত্তিতে মেধা যাচাইয়ের তো প্রশ্নই ওঠে না, শিশু শ্রেণীতে ভর্তির ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে। কাজেই এটা সমস্যার সমাধান না করে বরঞ্চ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করবে। রবীন্দ্রনাথের 'জুতা আবিষ্কার'-এর ভাষায় 'করিতে ধূলা দূর, জগৎ হল ধূলায় ভরপুর'।

কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য ও অন্যায় ব্যবসা বন্ধ করার জন্য ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করাটা কোন ভাল যুক্তি হল না। এ যেন চোরের সাথে রাগ করে ভাতের থালায় ভাত না খেয়ে মাটিতে ভাত রেখে খাওয়া কিংবা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মত।অবশ্যই কোচিং বানিজ্য বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কতকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে, আরো কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কিন্তু কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে তার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা কেন খেসারত দেবে?

এসএসসি উত্তীর্ণ হবার পরে কলেজে ভর্তি হবার জন্য গ্রেডের ভিত্তিতে তা হতে পারে (যদিও তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ নটরডেম কলেজে এ নিয়ম কার্যকরী করা যায় নি), কিন্তু একই প্রেসক্রিপশন মেডিক্যাল, প্রকৌশল, কৃষি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রযোজ্য হতে পারে না। মেডিক্যাল ও ডেন্টাল শিক্ষায় যে সব দেশকে আমরা অনুসরণ করি সে সব দেশে (বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি) মেডিক্যাল-ডেন্টাল শিক্ষায় ভর্তি হতে হলে শুধু একটি পরীক্ষা নয়, অনেক পরীক্ষার কাঠ-খড় পুড়িয়ে তবেই ভর্তি হওয়ায় 'সোনার হরিণ' মেলে।

ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীরা যথার্থই বলেছেন যে, সারা দেশের সাতটি বোর্ড ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্রে যে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে থাকে সেখানে ফলাফলকে সমতার ভিত্তি বলে ধরে নেয়া যায় না। তাছাড়া, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ থাকে রচনামূলক প্রশ্ন। তার উত্তরপত্র মূল্যায়নে এক পরীক্ষক থেকে আরেক পরীক্ষকের ভিন্নতা হতে বাধ্য। কিন্তু বহুনির্বাচনিক প্রশ্নে (এমসিকিউ) বা অংকের সঠিক উত্তর একটিই থাকে। তাই নম্বর দেবার মানদন্ডটাও একই থাকে। তাই মেডিক্যাল, প্রকৌশল, কৃষি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গৃহীত এমসিকিউ ও অংক প্রশ্ন ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ক্রমমান নির্ণয়ে এ যাবত কোন প্রশ্ন ওঠে নি।

কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য যদি মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করতে হয়, তবে প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করতে হলে তো স্কুল কলেজের সকল বার্ষীক, অর্ধ-বার্ষীক, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা বাতিল করতে হয়! সেটা কি কেউ সমর্থন করবেন? নাকি তাকে পাগলামি বলে উড়িয়ে দেবেন? একই যুক্তিতে সরকার কি প্রকৌশল, কৃষি ও সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে পারবেন? মনে হয়, তা সম্ভব হবে না। তাহলে শুধু মেডিক্যাল-ডেন্টাল ভর্তির জন্য এ সিদ্ধান্ত তার যৌক্তিকতা হারাবে।

মেডিক্যাল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষাতে এইচএসসি'র দুটো ব্যাচ অংশ নিতে পারে। কাজেই নতুন যে কোন সিদ্ধান্ত অন্ততঃ এক বছর আগে নেয়া উচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেভাবে ধাপে ধাপে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছে- তা একটি ভাল উদাহরণ।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশা করি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন এবং যদি আরো আধুনিক নতুন কোন পদ্ধতি চালু করতে হয় তবে সকল পক্ষের সাথে এখনই আলোচনা শুরু করে আগামী বছর থেকে তা কার্যকরী করবেন।

মুশতাক হোসেন: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চিকিৎসক সংসদ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু।