শত্রুমিত্র চিনতে ভুল করেছেন বঙ্গবন্ধু

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 15 August 2012, 12:48 PM
Updated : 15 August 2012, 12:48 PM

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিজ বাড়িতে সপরিবারে খুন হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটির গঠনের পেছনে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন এই নেতা। তাঁর সেই ভূমিকাটি বুঝতে হলে কিছু ঐতিহাসিক বাস্তবতাও আলোচনায় চলে আসে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালির মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ হতে শুরু করে। তারপর চব্বিশ বছরে, মানে প্রায় দুই যুগ ধরে বাঙালি নানা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে চেনাতে শুরু করে। এরই পথ ধরে উনিশশ' একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাঙালির স্বাধিকার-চেতনা গড়ে ওঠা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ– পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধান জননেতা। দু'যুগের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি বড় ভূমিকা রেখেছেন।

একদিনে তো কোনও নেতা তৈরি হন না। হঠাৎ করে জনতার মনে জায়গা করে নেয়া যায় না। জননেতা তৈরি হন ধীরে ধীরেই। সময়ের গতিতে নিজের কাজের মাধ্যমেই নেতা সাধারণের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুও সেভাবেই জননেতা হয়েছেন। একটি জাতির বিকাশের পেছনে অবদান রেখে জাতির জনক হিসেবে জনগণের ভালোবাসা পেয়েছেন।

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল। বাংলার মুসলমানেরাও তাই তখন পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৪৬ সালে এসে দেখা গেল, মুসলিম লীগের নেতারা একটিমাত্র রাষ্ট্রের কথা বলছেন। বাংলার মুসলমানরা এই প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারলেও, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির বিষয়টিকে স্বাগতই জানিয়েছিলেন। কারণ, একটি রাষ্ট্র গঠনের পরপরই সে রাষ্ট্র ভেঙ্গে দেওয়া যায় না। দুই যুগে জাতি হিসেবে নানা বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হওয়ার পরই তো জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হয়েছে।

এই পথে আসতে প্রতিটি আন্দোলনেই বঙ্গবন্ধু অন্যতম সংগঠক। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন ১৯৪৭ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পরপরই পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মাধ্যমে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ হতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মন্ত্রীত্ব পেয়েছিলেন। ষাটের দশকে কিন্তু প্রতিটি আন্দোলনের প্রধান সংগঠক বঙ্গবন্ধু। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টিতে ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন, '৬৮-'৬৯ এর গণআন্দোলন– সব জায়গাতেই এই ক্যারিশমাটিক নেতার বিপুল উপস্থিতি।

আসলে বঙ্গবন্ধুর আলটিমেট লক্ষ্যই ছিল, বাঙালির জন্য আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন। এ জন্যই তিনি চল্লিশ-পঞ্চালের দশকে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারণ তিনি কখনও জনবিচ্ছিন্ন হতে চাননি। জনতার কাছাকাছি থেকে তাদের মনের কথা বুঝতে চেয়েছেন। তাদের বোধের জগতেও নাড়া দিয়েছেন সে ভাবেই।

আবার এই একই চিন্তা থেকেই তিনি সমসাময়িক অন্য নেতাদের চেয়ে এগিয়ে গেছেন কয়েক ধাপ। মনে আছে, ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে সোহরাওয়ার্দীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন, 'এখন থেকে আমাদের দেশের নাম আর পূর্ব পাকিস্তান নয়, হবে বাংলাদেশ।' এই ঘোষণা দেওয়ার মতো সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা একমাত্র তাঁরই ছিল। তিনি জানতেন জনগণের ভালোবাসা তাঁর সঙ্গে আছে। আমাদের স্বাধিকার-আন্দোলন কিন্তু বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সমর্থন পায়নি শুরু থেকেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো– বিপক্ষে ছিল সবাই। মধ্যপ্রাচ্যে শুধু সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ছিল আমাদের পক্ষে। তাই আমাদের স্বাধীনতা-অর্জন এক অসম্ভব পাহাড় ডিঙানোরও গল্প। ওই সাহসী লোকটির সাহসী উচ্চারণগুলোর মূল্য আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারব না। বুঝতে হলে ফিরতে হবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে।

বঙ্গবন্ধু নিজে স্পষ্ট ছিলেন, তারপরও বাঙালির স্বাধিকার-অর্জনের জন্য সরাসরি বিদ্রোহের দিকে এগুতে চাননি। এগিয়েছেন ধীরে ধীরে। স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি, স্বায়ত্তশাসন, অধিকতর স্বায়ত্তশাসন– এভাবে আন্দোলনকে বেগবান করেছেন।

এক হিসেবে তিনি ছিলেন বাঙালির পুঞ্জীভূত আবেগের একটি সমন্বিত রূপ। যে চেতনা মানুষের গভীরে যুক্ত ছিল- তাকে আকার দিয়ে, ভাষা দিয়ে নির্মাণ করেছেন তিনি।

পেছন ফিরে তাকালে এখনও বঙ্গবন্ধুর মধ্যেকার মহত্তম গুণগুলোর দেখা পাই তার প্রতিটি কাজে। সাহসী, ক্যারিশমাটিক, দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক এক নেতা ছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যে ছিল মানুষের জন্য অপরিসীম মমতা। বড় নেতাদের বেশিরভাগই সাধারণের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু ব্যতিক্রম। তাঁর বাসায় যেভাবে সাধারণের যাতায়াত ছিল, আর কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের বাসায় কি এ ভাবে যাতায়াত সম্ভব? সদ্যপ্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের 'দেয়াল' উপন্যাসের কিছু অংশ পড়েছি। সেখানে দেখলাম, হুমায়ূন খুব সুন্দরভাবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের এই দিকগুলো তুলে ধরেছেন। বাস্তবেও তিনি ছিলেন এমনই।

তাই বলে তাঁর কি কোনও দোষ ছিল না? ছিল। আত্মতুষ্টি আর অতি-আত্মবিশ্বাস তাঁর ক্ষতি করেছে। এ দুটি সমস্যা না থাকলে তিনি শত্রুমিত্র চিনতে পারতেন। শেষদিকে তাঁর খুব কাছের লোক হয়ে উঠেছিলেন খন্দকার মুশতাক। তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুর কাছে তাজউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে বলতেন। একই কাজ করতেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ মনি। বঙ্গবন্ধু বুঝতে ভুল করেছিলেন। আর সে জন্যই তো একসময় তাজউদ্দিন আহমেদকে দূরে সরিয়ে দিলেন। খন্দকার মুশতাকের মতো নেতারা, যারা বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন, তারা তাঁর দুর্বলতার সুযোগটাই নিয়েছেন। অতি-আত্মবিশ্বাস থেকে বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারেও ছিলেন উদাসীন। তাই তাঁর বাড়িটিতে কোনও রকম প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেননি তিনি। আর ছিলেন অদূরদর্শী। তাই সম্ভাব্য বিদ্রোহের ব্যাপারেও ছিলেন উদাসীন।

উনিশশ' পঁচাত্তরের ১৫ ই আগস্ট এক মহান রাষ্ট্রনায়ককে হারালাম আমরা। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার মাধ্যমে এ দেশে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তবুদ্ধির চেতনার বিপক্ষের শক্তি সংগঠিত হতে চেষ্টা করেছিল। সুখের বিষয়, সেই শক্তিকে আমরা পরাজিত করেছি। বঙ্গবন্ধু এখন আবার অপন আলোয় ভাস্বর।