দৈনিক সংগ্রাম অফিসে ভাংচুর: যৌক্তিক ক্ষোভ, নাকি অগণতান্ত্রিক আচরণ?

নির্ঝর মজুমদার
Published : 14 Dec 2019, 01:13 PM
Updated : 14 Dec 2019, 01:13 PM

কোন একটি পত্রিকায় যখন কোন সংবাদ, তথ্য বা মত প্রকাশিত হয়, এবং তার বিরুদ্ধে কোন দ্বিমত থেকে থাকে, তাহলে সেই দ্বিমতের সমাধান করা যায় কেবল চারটি উপায়ে-

১. সেই পত্রিকায় বা সমজনপ্রিয়তার অন্য একটি পত্রিকায় প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে।

২. সেই পত্রিকা, বা লেখকের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করে।

৩. শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিয়ে।

৪. অশান্তিপূর্ণ বা অনগণতান্ত্রিক উপায়ে, বলপ্রয়োগ বা শক্তি প্রয়োগ করে।

এর বাইরে অন্য কোন উপায়ে প্রকাশিত লেখার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানানোর কোন উপায় আছে বলে জানা নেই।

এই লেখার প্রথম লাইনে আমি তিনটি টার্মের অবতারণা করেছি। কাদের মোল্লা শহীদ এই শব্দটি সংবাদ নয়। সংবাদের কোন সংজ্ঞাতেই এটি পড়েনা। কাদের মোল্লা শহীদ, এটিকে আমরা একটি তথ্য হিসেবে ধরতে পারি, একজন জামায়াতের সমর্থকের ক্ষেত্রে এটি নিতান্তই মতামত হিসেবে গণ্য করতে হবে। এবং আমরা যারা গণতন্ত্র, ও বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, তারা জানি এটি একটি নির্জলা মিথ্যা, একটি চরম বদমায়েশী, এবং ধৃষ্টতা। এবং এই একই চাতুর্যপূর্ণ ধৃষ্টতা জামায়াত সমর্থিত আমার দেশ, ইনকিলাব, নয়া দিগন্ত ও সংগ্রাম পত্রিকা দিনের পর দিন ধরে করে চলেছে।

জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম সমর্থক এবং মুখপত্র পত্রিকা সংগ্রামে, কাদের মোল্লাকে "শহীদ" হিসেবে সম্বোধন করে একটি প্রতিবেদন করেছে, এবং কিছু যুবক এই ঘটনার একটি আবেগিক প্রতিবাদ দেখিয়েছে, যাতে কেউ আহত হয়নি, নিহত হয়নি এমন কি হওয়ার দাবি করেছে বলেও জানা নেই। এই ঘটনার পরে নানান মাধ্যমে অনেককে দেখলাম, সংগ্রাম অফিসে কতিপয় যুবকের হামলা কে "ফ্যাসিবাদী কাজ", "বাক স্বাধীনতার বিপক্ষে হামলা", "জঘন্য শয়তানি" বলে উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশের থেকে ব্যাতিক্রম একটি প্রতিবাদ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা  মাহমুদুল হক মুনশি বাঁধন। তার অবস্থান হলো, তিনি আইনি উপায়ে এই ধরনের কার্যক্রমের প্রতিবাদ করতে চান। অর্থাৎ মামলা বা আদালতের দ্বারস্থ হতে চান। এদের অনেকেই মনে করেন সাধারণ মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী জনগণের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ হিসেবে এই ঘটনাটি – ফ্যাসিবাদী এবং অগণতান্ত্রিক।

এই পুরো প্রক্রিয়া বা উপরে উল্লেখিত চারটি প্রক্রিয়ার তিনটি অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবার সুযোগ সীমিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই চারটি প্রক্রিয়াই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে সুবিধা এনে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করে না। তাহলে সংগ্রাম অফিসে কিছু ছেলের হামলাটি কী?

প্রথমেই বলেছি, জনগণের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ- এর বাইরে এই ধরনের ঘটনাকে অন্য কোন ভাবে দেখার সুযোগ নাই।

তবুও তর্কের খাতিরে ধরা যাক, এই ক্ষোভের বহির্প্রকাশ অন্যায় এবং অনুচিত। তাহলে কী করা যেত? প্রথম তিনটি উপায় অনুসরণ করা যেতো।

ধরি এই অভিমানী ছেলেগুলো প্রথম উপায়টিই অনুসরণ করেছে। শাহবাগের সামনে, অথবা শহীদ মিনারের সামনে একটা ঢোঁড়াসাপ ধরনের মানববন্ধন করেছে।

এই ধরনের কত সহস্র মানব বন্ধন আমার দেশ, ইনকিলাব পত্রিকার বিরুদ্ধে হয়েছে, সেটি নিশ্চয়ই আমাদের জানা আছে। সংগ্রাম, আমার দেশ, মাহমুদুর রহমানের মত চরম উগ্রবাদী, জঙ্গি, অগণতান্ত্রিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরা গণতন্ত্রের এই ভাষাগুলো শ্রদ্ধা করে বলে কেউ বিশ্বাস করলে সেই ব্যক্তি হয় অসম্ভব নির্বোধ অথবা চরম ছলচাতুরিপূর্ণ। যদি  প্রথাগত গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদের ভাষাতেই কাজ হত, এই দানবদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তাহলে শাহবাগ আন্দোলনের সময়ে, এত তীব্র প্রতিবাদের পরেও ৭১ এর বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে, মৌলবাদীদের পক্ষে মাহমুদুর রহমান সংবাদ প্রকাশ অব্যাহত রাখতনা।

আমার ধারণা, প্রতিবাদের প্রথম এবং দ্বিতীয় উপায় যে চরম অসাড় এবং এই অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে ব্যর্থ একটি উপায়, বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সেটিতে সবাই একমত হবেন। রাস্তায় বসে, আর মানববন্ধনের ভাষা বোঝবার মত বোধশক্তি কারও থাকলে সে সংগ্রাম বা আমার দেশ পত্রিকা চালাতো না।

এই ঘটনার পরে বাঁধন ভাই এর সাথে আমার ইনবক্সে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। এবং আমি তাঁর বক্তব্যের ও অবস্থানের সাথে চরম দ্বিমত পোষণ করি। উনি বলেছেন ভাংচুর না করে আইনি উপায়ে প্রতিবাদের কথা, সোজা কথায় আইনের আশ্রয় নেওয়া। আমি কেন এই ধারণা সমর্থন করি না সেটিতে একটু পরে আসছি।

বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা শুরু হওয়ার পরে সরকারসহ অনেকের একটি অতিসাধারণ, এবং পপুলিস্ট বক্তব্য ছিল এমন, "হত্যা সমর্থন করিনা, তবে যারা ধর্মের অবমাননা করে, তাদের হত্যা না করে আইনের আশ্রয় নেওয়া উচিত এবং আইনি উপায়ে আদালতের মাধ্যমে বিচার করা উচিত।"

সংগ্রাম পত্রিকার ক্ষেত্রেও "আদালতের মাধ্যমে" বিচার করবার কথা একই রকমের বক্তব্য। "ভাংচুর সমর্থন করিনা", আইনের আওতায় বিচার করতে হবে', এই ধরনের যুক্তি সেই মৌলবাদীরাই দিত, যারা ব্লগার হত্যার ব্যপারটাকে একটু হাল্কা মোড়ক দেয়ার চেষ্টা করত, এবং যারা মনে করত ব্লগাররা যা লিখেছে, সেটার জন্য তাদের আসলেই শাস্তি প্রাপ্য।

এইখানে আরেকটি বিষয় আছে। বাংলাদেশে কোন পত্রিকা বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য  ৫৭ ধারার মত কালো আইন আছে। এই ধরনের প্রতিটা আইনই, অপব্যবহারের মাধ্যমে চরম কালো আইনে পরিণত হয়েছে। এই ছাড়াও, আরও একটি বিষয় এখানে আছে, যেটি একটি শুভঙ্করের ফাঁকি হিসেবে ইদানিং জামায়াত এবং মৌলবাদী শক্তি ব্যবহার করে। বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি কখনওই এই ধরনের আইনের সমর্থন চাইতে পারেন না।

এর উদাহরণ হচ্ছে- আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এই মনুষ্যস্বরূপি বিষধর সাংবাদিকটিকে তার অসাংবাদিক, অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য যখনই আইনের আওতায় আনা হয়েছে বা চেষ্টা করা হয়েছে, তখনি সেটিকে সমালোচনা করা হয়েছে সংবাদপত্রের এবং বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ হিসেবে। দুঃখজনকভাবে প্রতিবারই মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে নেওয়া প্রতিটা আইনি পদক্ষেপই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে চিহ্নিত হয়েছে "মানবাধিকার লঙ্ঘন" হিসেবে। এবং এত আইনি পদক্ষেপের পরেও মিথ্যাচারের ক্ষেত্রে মাহমুদুর রহমান বা তার পত্রিকাকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি। কি নিশ্চয়তা আছে সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক বা পত্রিকাটি আইনি আওতায় আসার পরে এধরনের মিথ্যাচার থেকে নিবৃত্ত হবে?

এই ধরনের আইনি উপায়, বা শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ শুধুমাত্র সেই সমস্ত প্রতিপক্ষই সম্মান করেন, যারা গণতন্ত্রে এবং বাংলাদেশে বিশ্বাস করেন। বাকিদের ক্ষেত্রে এগুলো নিজস্ব পাপ এবং অন্যায় ঢাকবার জন্য কিছু অতিরিক্ত পোশাকমাত্র। যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের মত "বাকস্বাধীনতার ধ্বজাধারী" দেশেও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বা এডওয়ার্ড স্নোডেনের বিপক্ষে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক আচরণ করতে সমর্থ হয়েছে কিনা সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে।

চতুর্থত আসছি, অগণতান্ত্রিক উপায়ে বা শক্তিপ্রয়োগ করে প্রতিকার এর ক্ষেত্রে। এটি সর্বজনসম্মতভাবে নিন্দিত এবং অগ্রহণযোগ্য। এরপরেও সারা বিশ্বে পতাকা পোড়ানো বা কুশপুত্তলিকা দাহ করবার মত প্রতিবাদের ভাষা আপত্তির ঊর্ধ্বে উঠেছে। গণজমায়েতের ক্ষেত্রে প্রায় সবখানেই প্রতিবাদকারীরা শেষপর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আচরণ করতে ব্যর্থ হয়। এগুলো ব্যক্তিগত মতামতের প্রেক্ষিতে অনেকের কাছেই হয়ত আপত্তিকর, তবে অগণতান্ত্রিক কিনা, সেই ক্ষেত্রে সন্দেহ আছে। তবে যেটিতে সন্দেহ নেই, সেটি হল তাদের প্রতিবাদ বা দাবির যৌক্তিকতার বিষয়ে, এবং সেই ভিত্তিতেই আন্দোলন বা প্রতিবাদকারীদের আচরণ বিচার করা উচিত।

সর্বোপরি,দুঃখজনকভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত দৈনিকে সংবাদের নামে মিথ্যাচার এবং ইতিহাস বিকৃতি চলমান থাকলে, এবং আইনি উপায়গুলো নিয়ে বিতর্ক তৈরির উদাহরণ করে দিলে, মানুষের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ এর আচরণ নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে চলেনা, চলবে না। সেই আচরণ কতটুকু নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করা যেত, সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে, তবে সেটির যৌক্তিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার মানে হচ্ছে, প্রকাশিত মিথ্যাচারটিকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি অতিরিক্ত সুযোগ করে দেওয়া। এবং বাংলাদেশের মত ক্ষেত্রে, জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের দোসরদের ব্যপারে তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক আচরণ তাদের শুধরাতে কখনওই সমর্থ হয়নি। আইনি প্রক্রিয়া তাদের ঢাল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় সব ক্ষেত্রে।

সংবাদ পত্রগুলোর এবং ব্যক্তিগতভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যতদিন যৌক্তিক উপায়ে আইনি প্রক্রিয়াগুলো ব্যবহৃত হবেনা, এবং সেগুলো ব্যবহৃত হলে অপরাধীদের তথাকথিত "ব্যক্তিগত স্বাধীনতা" বিপর্যস্ত হওয়ার অজুহাত সৃষ্টির মাধ্যমে মিথ্যাচার বন্ধের প্রক্রিয়াতে বাধার সৃষ্টি করা হবে, ততদিন পর্যন্ত কোনটি যৌক্তিক এবং কোনটি অযৌক্তিক প্রতিবাদ, সেই প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভব নয়।

সর্বোপরি, একজন ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড তখনি সাংবাদিকতার জন্য তৈরিকৃত সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার হন, যখন তিনি সত্যের আশ্রয় নেন, সততার আশ্রয় নেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। যখন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিথ্যাচার বা ইতিহাস বিকৃতির লক্ষ নিয়ে একি ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি করেন, তখন তারা সাংবাদিকতার সেই সুরক্ষার দাবিদার আর থাকেন না। প্রতিবাদের এই ঘটনাগুলোকে "ফ্যাসিবাদী" বা "অগণতান্ত্রিক" আচরণ বলবার অনেকগুলো অসুবিধা আছে। প্রথমত জামায়াত এবং সমমনা ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রায় প্রতিটি ভাষাই যৌক্তিক। এবং দ্বিতীয়ত, যেটি ফ্যাসিবাদী আচরণ নয়, সেটিকে ফ্যাসিবাদী আচরণের তকমা দেওয়া মানে হলও যৌক্তিক প্রতিবাদের পথ রুদ্ধ করে অধিকতর বিপদজনক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদান। মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি অথবা বাক স্বাধীনতার নামে প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিরোধিতা এবং একটি জাতির ইতিহাসের সাথে ধৃষ্টতার প্রচেষ্টা মতামত, তথ্য বা সংবাদ পরিবেশন কোনভাবেই হতে পারে না। এই ধরনের বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করতে না পারার কারণেই পৃথিবীতে অনেকগুলো গণহত্যা সঙ্ঘটিত হয়ে গেছে, এবং সংগ্রাম পত্রিকাও ইতিপূর্বে ৭১ সালের গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ র বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধই মূলত সর্বোৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক আচরণ।

বিজয়ের মাসে জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের প্রচারণার মেশিনগুলোর এই ধরনের  ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের উপযুক্ত সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য আরও উপযুক্ত কোন উপায় বাঙ্গালি জাতি খুঁজে পাবে বলেই আশা রাখি।