Published : 13 Dec 2019, 06:55 PM
অধ্যাপক অজয় রায়ের সঙ্গে আমার ঠিক তিনবার দেখা হয়েছিল। প্রতিবারই কোনো এক ক্রান্তিলগ্নে। প্রথমবার ২০০১ সনের নভেম্বর মাসে। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট সবে জয়ী হয়েছে, অক্টোবর ও নভেম্বর মাস জুড়ে বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চলেছে ব্যাপক তাণ্ডব, বহু ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে, ওই সময়েই গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। খেয়াল আছে ঘরে ঢোকা মাত্র ওনার চড়া গলার শব্দ শুনেছিলাম, ফোনে কাউকে ধমকাচ্ছেন, একটি ধর্ষিতা মেয়েকে একজন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বাড়িতে এনে রেখেছেন, তাঁকে বলছেন কাজটা ঠিক হয় নি। বাড়িতে এনে রাখার জন্য ধমকাচ্ছেন না, কাজটা প্রোটোকল অনুযায়ী সবার সঙ্গে আলোচনা না করে করা হয়েছে বলে তিরস্কার করছেন। ওনার মেরুদণ্ড কতখানি শক্ত এবং ন্যায় ও নীতির প্রতি কতখানি অনুগত সেদিনই বুঝেছিলাম। ওই নিপীড়ন নিয়েই ওনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম, প্রাপ্তবয়স্ক সংখ্যালঘু নারীদের শহরে জীবিকা ও নিরাপত্তা নিয়ে। সেদিন শুনেছিলাম তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে অভিজিৎ রায় সিঙ্গাপুরে আছে। সেই দুর্দিনে অধ্যাপক অজয় রায় 'নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি' নিয়ে কাজ করছিলেন। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধে যে বৃহত্তর সমাজের দায়বদ্ধতা আছে সেটা বুঝে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে সামগ্রিকভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। মনেপ্রাণে সেকুলার এই মানুষটি বুঝেছিলেন ধর্মীয় বা জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু অংশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠদের বোঝাতে হবে যে এই অধিকার রক্ষার সংগ্রাম থেকে তারাও বিযুক্ত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যে কোনো নাগরিকের অধিকার হরণ সামগ্রিকভাবে সমস্ত নাগরিকের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতির নেতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরা থেকে বিরত হন নি।
ওনার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয় ২০০৪ সনে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায়। আমার পিতা বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য দেহত্যাগ করেছেন, তাঁর স্মরণসভায় বসেছিলাম শহীদ মিনারের সিঁড়িতে অধ্যাপক অজয় রায়ের পাশে। উনি এসেছিলেন আমার বাবার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। পিতৃবিয়োগের সেই ক্ষণে তাঁর উপস্থিতি আমাকে ভরসা দিয়েছিল, তাঁর নাগরিক দায়িত্ববোধের আর একটি প্রমাণ সেদিন পেয়েছিলাম। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে শহীদ মিনারের সেই স্মৃতি আমার মনে সততই জাগরুক।
মনে পড়ে সেদিন তাঁর হাতে ধরা ছিল পদার্থবিদ্যার একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, ওই দিন সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ ছিল না। কী বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছিল সেটা আমি ভাল করে না দেখতে পেলেও ওটি যে সলিড স্টেট পদার্থবিদ্যার সেটা মনে আছে। ১৯৫৯ থেকেই অধ্যাপক অজয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করছিলেন। ১৯৬৬ সনে বিলেতের লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভৌত রসায়নে সফলতার সাথে পিএইচডি অর্জন করেন। অভিজিৎ রায় ২০০৯ সনে 'তিনি বৃদ্ধ হলেন' নামের একটি মনোমুগ্ধকর প্রবন্ধে তাঁর পিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, তাঁর বিদেশে থেকে যাবার অনেক সুযোগ ছিল, কিন্তু অজয় রায় 'দেশের টানে চলে এসেছিলেন।' ১৯৭১ এ সেই টান তাঁকে পরিণত করেছিল মুক্তিযোদ্ধায়। যুদ্ধফ্রন্টে যেমন ছিলেন আবার অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা সেলে সঙ্গে যুক্ত থেকে নীতি নির্ধারণের ব্যাপারেও সহায়তা দিয়েছিলেন। অভিজিৎ রায়ের জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযোদ্ধা পিতা জন্মের সময় তাঁর মা শেফালী রায়ের পাশে থাকতে পারেন নি।
এরপর বহু বছর কেটে গেল। ২০১০ সনে পেলেন বিজ্ঞানে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার, ২০১২ সনে শিক্ষায় একুশে পদক। ২০১৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেলেন ইলেকট্রন-স্পিন অনুনাদের ওপর কাজ করার জন্য সম্মাননা। যুক্তিবাদী চেতনার প্রসার না ঘটালে সমাজ যে পিছিয়ে পড়বে তা ভালভাবে বুঝেছিলেন, তাই এর মধ্যে নিরলসভাবে বিজ্ঞান চিন্তার প্রসারে কাজ করে গেছেন। যুক্তি নামে একটি পত্রিকায় মুক্তচিন্তক আরজ আলী মাতুব্বর সম্পর্কে লিখলেন:
"ভারতবর্ষেও রক্ষণশীল সমাজ চার্বাক ও লোকায়ত দর্শনকে গলা টিপে হত্যা করেছে আর তাদের রচনাবলিকে চিরকালের জন্য ধ্বংস করে দিয়েছে। এই দর্শনের ছাত্র ও অনুসারীদের যুগযুগ ধরে নিপীড়ন করা হয়েছে। আর্যভট্ট, বরাহমিহির ও ব্রহ্মগুপ্তের মত জ্ঞানসাধকদের ধর্মের সাথে আপস করে তাদের বিজ্ঞানসাধনাকে এগিয়ে নিতে হয়েছে। পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণনশীল আর্যভট্টের এই মতে বিশ্বাসী হয়েও বরাহমিহিরকে প্রকাশ্যে বলতে হয়েছে 'পৃথিবীর ঘূর্ণন তত্ত্বটি' একটি বিকল্প পথ মাত্র, আসল তত্ত্ব হল সূর্যই ঘুরছে, পৃথিবী নয়- যা প্রাচীনেরা বলে থাকেন।' কিন্তু শেষপর্যন্ত বিজ্ঞানেরই জয় হয়েছে- সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা যায় নি। রক্ষণশীল বনাম প্রগতিশীল – এই দ্বন্দ্বে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, বিজ্ঞানীদের জ্ঞান সাধনা থেমে থাকেনি শত প্রতিকূলতার মাঝেও। চার্বাক ও লোকায়ত দর্শনকে হত্যা করা হলেও ভারতে পুনর্বার বস্তুবাদী সাংখ্য দর্শনের জন্ম হয়েছে, জন্ম নিয়েছে নাস্তিক্যবাদ, অজ্ঞেয়বাদ (agnosticism) ও বুদ্ধের অস্তি–নাস্তি দর্শন। বিজ্ঞান এভাবেই অগ্রসর হয় সত্যকে আবিষ্কারের আগ্রহ নিয়ে, নতুন সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে। কিন্তু বিজ্ঞানের পথ হল যুক্তির পথ, যৌক্তিকতার পথ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ। গণিত আর জ্যামিতির তীক্ষ্ণ যুক্তি তার ভিত, তার ভাষা, পর্যবেক্ষণ তার উপলব্ধি – সম্ভাব্য জ্ঞানের আকর, সংশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা তার অস্ত্র । তাই যুক্তিভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে, সমাজ-প্রগতির পথে অগ্রসর হতে হলে, উদারনৈতিক বহুমাত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়তে হলে, বিজ্ঞান পড়তে হবে, বিজ্ঞানের চর্চা করতে হবে, বিজ্ঞানী না হয়েও বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মর্মবাণীগুলোকে ধাতস্থ করতে হবে, অনুধাবন করতে হবে, তবেই না আমরা লোকায়তবাদী আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন দর্শন, তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা,সর্বোপরি এই মানবতাবাদী মানুষটির অন্তর্নিহিত বাণীকে বুঝতে পারব।" (যুক্তি, ১ম সংখ্যা ২০০৭)
যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও সংশেষণ – বৈজ্ঞানিক দর্শনের তিনটি দিককে উপস্থাপনা করে আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের যুক্তিচর্চা ওই ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে আজ অতীতের দিকে রওনা দিয়েছে। অধ্যাপক অজয় রায়ের মত মানুষ ছাড়া সেই পশ্চাদমুখী যাত্রা থেকে আমাদের বিরত করা কি সম্ভব হবে?
ততদিনে আন্তর্জালের বদৌলতে তখন অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, কিন্তু সাক্ষাৎ দেখা হয় নি কখনও। ২০১৫ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি ঢাকায়। বই মেলা চলছে, মেলা থেকে অভিজিতের 'ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে' বইটা কিনলাম, আন্তর্জালে বইটার ছবি দিলাম। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিজিৎ উচ্ছসিত হয়ে লিখল, 'দীপেনদা, বইটা কিনে ফেললেন!' যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের আগে কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার মনে হয়েছিল অধ্যাপক রায়ের সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ওনার ওখানে গিয়েছিলাম। গিয়ে শুনলাম অভিজিৎ ও বন্যা দেশের পথে রওনা দিয়েছে। আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেছিল। বলেছিলাম, 'ওরা বুদ্ধিমান মানুষ, আশা করি সাবধানতা অবলম্বন করবে।' উনি হেসেছিলেন। ফিরে আসার দশ দিনের মধ্যে অভিজিৎ নিহত হল, বন্যা আহত হল মারাত্মকভাবে। এরপর ওনার সঙ্গে আর দেখা হয় নি, ফোনে যদিও কথা হয়েছিল কয়েক বার। সেই ফোনালাপেও উনি শত দু:খের মধ্যেও ছিলেন স্থিত জলধী।
পারিবারিক সূত্রে আমি আর একজন অজয় রায়কে চিনতাম, তিনি হলেন নিবেদিত প্রাণ কমিউনিস্ট কর্মী অজয় রায়। তাঁকে অজয়দা বলতাম। ১৯৭১ সনের আগে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল, ওনার ওপর পরোয়ানা ছিল, লুকিয়ে বাবার সঙ্গে আইনি পরামর্শের জন্য আসতেন। বাংলাদেশের অনেকেই এই দুই অজয় রায়কে মিশ্রিত করে ফেলেন। ২০০১ সনে এই অজয়দার স্ত্রী জয়ন্তী দিদি আমাকে প্রথম অধ্যাপক অজয় রায়ের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কেন আর এক অজয় রায়ের প্রসঙ্গ উপস্থাপনা করছি সেটা বলছি। ১৯৪৭-র দেশভাগের পরে হিন্দু সমাজ থেকে আগত বহু কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি কর্মী এবং সাধারণ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে, তাদের স্বদেশে, থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তর জন্য তাঁদের মূল্য দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা অজয় রায়কে ১৫ বছরের বেশি কারাভোগ করতে হয়েছে, আমার বাবা দেবেশ ভট্টাচার্যও দেশভাগের পরপরই দুবছর জেলে ছিলেন। অথচ এরকম প্রতিটি মানুষই একটি পূর্ণাঙ্গ সেকুলার সমাজে বিশ্বাস করতেন – অধ্যাপক অজয় রায়ের মত তাঁরা সবাই একটি উদারনৈতিক বহুমাত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার প্রয়াসে নিযুক্ত ছিলেন। একই সাথে যে সমাজ থেকে তাঁরা এসেছিলেন সেই সমাজের ধর্মীয় আচারকে সমালোচনা বা সংস্কারের উদ্যোগ থেকে তাঁরা পিছ-পা হন নি। বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য যেমন তাঁর রক্ষী বাহিনীর ওপর রায়ের জন্য তৎকালীন সরকারের অসন্তোষের কারণ হয়েছিলেন, তেমনই হিন্দু মেয়েদের বিবাহ বিচ্ছেদ ও সম্পত্তির অধিকার নিয়ে তাঁর প্রস্তাবনা দিয়ে রক্ষণশীল হিন্দু মহলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সেরকমই অধ্যাপক অজয় রায় এমন একটি ধারার বার্তাবাহক ছিলেন যে ধারাটি একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজের স্বপ্ন দেখত – যে সমাজে নানান মত প্রকাশের অধিকার থাকত, যে সমাজ সেই সমস্ত মতামতকে সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করে একটি উন্নত অবস্থায় যেতে চাইত, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হত। সেই বার্তা বহনের জন্য সাহসের প্রয়োজন ছিল, যে সাহস নিজের স্বার্থ ও গোত্র থেকে উঁচুতে উঠে সমাজকে দেখতে সাহায্য করত। কিন্তু আজ যত দিন যাচ্ছে আমরা সেরকম মানুষগুলি হারাচ্ছি, সেই সাহস থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি। আমার ভয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এঁদের মনে রাখবে না।
অধ্যাপক অজয় রায়ের একটি মূল পরিচয় শিক্ষা নিয়ে তাঁর ভাবনা। এই নিয়ে তিনি অনেক লিখেছেন এবং বলেছেন। সেই বলা ও লেখার বলিষ্ঠতা আমাদের বিস্মিত করে। তাঁকে এইজন্য একুশে পদক দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই বলা ও লেখা কে কতখানি শুনেছে তা বলা মুশকিল। এখানে আমি তাঁর একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করছি, তাঁর বক্তব্য যে অতি প্রাসঙ্গিক পাঠক তা বুঝতে পারবেন।
"বস্তুত ১৯১৯ সালে গঠিত 'কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকমিশন', যা সাধারণভাবে 'স্যাডলার কমিশন' নামে পরিচিত, ব্রিটিশ ভারতে বিশেষকরে তৎকালীন বাংলাদেশে (বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি) পশ্চিমা লিবারেল ডেমোক্রেসির দর্শনকে ভিত্তি করে একটি পরিমার্জিত আধুনিক সেক্যুলার এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছিল। কমিশনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার নীতি ছিল 'সরকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত নিরঙ্কুশ স্বায়ত্বশাসন', যেখানে নীতি-নির্ধারণ ও পরিচালনায় শিক্ষকদের থাকবে সিংহভূমিকা। বর্তমানে ইউনেস্কোর সুপারিশেও সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এমনকি শিক্ষা দানের জন্য প্রয়োজনীয় টেক্সটবুক রচনায়, সিলেবাস প্রণয়নে, শিক্ষাদান পদ্ধতি উদ্ভাবনে ও শিক্ষা-উপকরণ নির্বাচনে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ ও তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য নির্দেশ দান করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের সরকার শিক্ষালয়ের অতি প্রয়োজনীয় স্বাধিকারের নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উচ্চতম বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতেও সরকার তার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বেসরকারি স্কুলগুলো এখন পরিচালিত হচ্ছে স্থানিক সরকারি দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে, যাদের পেছনে রয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও নানা চাতুরিতে সরকার তার প্রতিভূদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বহিরাগত রাজনৈতিক মাস্তানদের হাতে শিক্ষালয়গুলো বন্দী। অথচ জ্ঞান সৃষ্টির জন্য, উদ্ভাবনী মেধা বিকাশের জন্য, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাই 'মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ' এবং নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা, যার নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো এ নীতিতে বিশ্বাস করে না, এরা বিশ্বাস করে শিক্ষালয়সহ সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর 'টোটাল কন্ট্রোল' করার নীতিতে।" (যুক্তি, ২য় সংখ্যা ২০০৮)
শিক্ষাক্ষেত্রের এই সমস্যার কথা আমাদের কারুর অজানা নয়, ২০০৮ এর এই লেখার পরে ১১ বছর পার হয়ে গেছে, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষায় কর্তৃপক্ষের বশ্যতা স্বীকার করার ব্যাপারে হতাশা অধ্যাপক অজয় বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্ত করেছেন, সেই আলোচনায় না যেয়ে শিক্ষা দর্শনের ব্যাপারে তাঁর একটু উক্তি তুলে দিচ্ছি, 'আমার কাছে শিক্ষা দর্শনের মূলে থাকবে সমাজবন্দী বা রাষ্ট্রীয় নিয়মে সতত আবদ্ধ ব্যক্তি মানুষের অনন্ত সম্ভাবনাময় সৃষ্টিশীলতাকে সঞ্জীবিত করা, তাকে জাগরিত করা। মানুষের এই সৃষ্টিশীলতা বিজ্ঞানে, শিল্পে, সুকুমার বৃত্তিতে এবং উৎপাদন ব্যবস্থায়—এক কথায় আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতিকে উচ্চমার্গে নিয়ে যাবে—যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে করবে উন্নত আধুনিকতার দৃষ্টিতে, প্রগতিশীলতার দৃষ্টিতে।' অধ্যাপক অজয়ের এই দর্শনের মূলমন্ত্র হচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতিতে প্রোথিত হয়ে আন্তর্জাতিকতাকে গ্রহণ করা। দেশীয় শিক্ষার যে শূন্যতা বর্তমানে আছে যা একদিকে অত্যধিক, অনাবশ্যক ও মনকে বিকলিত করার সরকারি ক্যারিকুলামে এবং অন্যদিকে এ-লেভেল বা মাদ্রাসা শিক্ষা দিয়ে পূর্ণ করা হয় তাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে স্বায়ত্বশাসিত, কিন্তু রাজনৈতিক মাস্তানি থেকে মুক্ত, বিকেন্দ্রীত ব্যবস্থার কথাই তিনি বলে গেছেন।
৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, অধ্যাপক অজয় রায় মৃত্যুবরণ করলেন। অনেকেই সরকার থেকে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেবার আগেই তাঁর তিরোধানে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমার মনে হয় নিজের অজান্তেই এই দুঃখে তাঁরা অধাপক রায়ের জীবনকে এক অসম্পূর্ণতা প্রদান করছেন। কিন্তু অভিজিতের হত্যার বিচার যথাযথ না হবার কোনো দুঃখে যদি থাকে সেটা হবে আমাদের, এই দুঃখের দায়িত্ব অজয় রায়ের নয়। অজয় রায় এক সম্পূর্ণ জীবন যাপন করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে থেকে বিদায় নেবার সিদ্ধান্ত নেন নি, বিদেশে সফলভাবে পিএইচডি করে সেখানে থেকে যাবার সুযোগ গ্রহন করেন নি, বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য ছাত্রকে শিক্ষিত করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, এসিয়াটিক সোসাইটিসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, সংখ্যালঘু নিপীড়ণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, মুক্তচিন্তার লড়াইয়ে প্রথম সারিতে সব সময় অবস্থান করেছেন, নিজের পুত্রদের– অভিজিৎ ও অনুজিৎকে – গড়ে তুলেছেন, সেই লড়াইয়ে পুত্র অভিজিৎকে হারিয়েছেন (আহত পুত্রবধু বন্যা আহমেদ এখনো বৈশ্বিক পরিবেশে উদার সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন), পরিশেষে পুত্রের মতন, তাঁর স্ত্রীর মতন নিজের শরীর দেশের সেবায় দান করেছেন। মানুষ বহু আত্মত্যাগ করে, কিন্তু মৃত্যুর পরে নিজের দেহটিকে ছাড়তে চায় না, এই দানের জন্য যে সাহস যে মন থাকতে হয় তা সহজলভ্য নয়। এই যদি পরিপূর্ণ জীবন না হয় তবে আর কার জীবন পরিপূর্ণ?
'আগুনের পরশমণি' গানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
'নয়নের দৃষ্টি হয়ে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে।'
এখানে 'ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে' বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বোঝাতে চেয়েছিলেন আমি জানি না, তবে আমি ভাবতে চাই পরশমণির দানে সব ব্যথা জ্বলে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। অধ্যাপক অজয়ের স্পর্শে আমাদের সব ব্যথা জ্বলে উঠুক, আমাদের ভাবনা উচ্চতর হোক।