সে ছিল মিষ্টি রোদ্দুর আমাদের

Published : 5 Dec 2019, 06:00 PM
Updated : 5 Dec 2019, 06:00 PM

সে ছিল এক মিষ্টি রোদ্দুর, যেমনটি ভোরের সূর্যোদয়ের পর আমরা কাঙ্ক্ষা করি।

আমরা এখন জাতিগতভাবেই চৈত্রের খরতাপে পুড়ছি। আমাদের সবকিছু ফেটে চৌচির হয়ে আছে। কাব্যি না করে সোজাসাপটা বললে, আমাদের রাজনীতি এখন রুক্ষ, অর্থনীতি লুটের মাল, সংস্কৃতি বন্ধ্যা ও ক্লেদাক্ত, শিক্ষা ছিন্নভিন্ন। এভাবে সবকিছু এত তাপদগ্ধ যে কেমন যেন কাটা-কাটা, ফাটা-ফাটা। যেন দরকার একটানা তুমুল-আঁধারকরা ঝড় কিংবা তীব্র বানের স্রোত, যাতে সবকিছু একাকার হয়ে সজল-সতেজ হয়ে ওঠে; তারপর আসুক এমন ভোরের স্নিগ্ধ রোদ্দুর, যেন জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়, ভেতরের পঙ্কিলতা সরিয়ে স্নিগ্ধতাগুলোকে রৌদ্র স্নান করানো যায়।

এত বেশি কৃত্রিম আলো আমাদের ভেতরে-বাইরে, শহরে-বন্দরে; এত কৃত্রিম প্রাচুর্য অন্তরে-ভূগোলে— সবকিছু বড় বেশি ঝলসানো মনে হয়। তাই আমাদের অন্তরে, নিসর্গে, বচনে, আচরণে সর্বত্রই বড় বেশি রুক্ষতা। আমাদের সবুজ ভূগোলকে যেমন করে ধ্বংস করতে করতে ন্যাড়া আর ধূলিময় করে তুলেছি, নিজেরাও বড় বেশি ন্যাড়া-নগ্ন হয়ে পড়েছি। লোভ-ক্ষোভ-ভোগ-ভাঁড়ামো-বন্যতায় আমরা শূকরছানাদের মতো ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আর গুঁতোগুঁতি করে মরছি। যেন জীবনের কোনো অর্থ নেই ভোগ-রমণ-বমন ছাড়া; যেন মানুষের জীবনের গূঢ় কোনো দর্শন নেই নগদানগদী ছাড়া।

অথচ এই ভূগোল শত-শতাব্দীজুড়ে আত্মিক-আর্থিক-রাজনৈতিক মুক্তির জন্য এত রক্ত দিয়েছে, তাতে হয়তো বঙ্গোপসাগর পূর্ণ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আজও আমাদের স্বদেশ লুটেরা-বণিকদের স্বর্ণভূমি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সুবিধাধারীদের অবাধ দখল-লুণ্ঠন। ফলে আমাদের ক্ষমতার হিমালয়-আরোহণকারীদের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত অনেকেই এক-একটি বিত্তের হিমালয় গড়ে তুলছে; বিদেশি ব্যাংকের পেট ভারী করছে। তাদের কাছে সততা-সংস্কৃতি-নীতি-ধর্ম সবই পণ্য ও মুনাফাঅস্ত্র।

কিন্তু এত যে নেতি, তার ভিতর কি ইতি কিছু নেই! আছে। আছে বলেই তো আমাদের স্বপ্ন আছে, সংগ্রাম আছে, বিপরীত স্রোতেও ঘুরে দাঁড়াবার সাহস ও সততা আছে; ধ্বংসের ভিতরও সৃষ্টির বীজ আছে।

কথাগুলো মনে পড়ছে অকালপ্রয়াত রাজনীতিক ও কবি মাহবুবুল হক শাকিলকে স্মরণ করে। আহা, সে ছিল সত্যিই একটি মিষ্টি রোদ্দুর আমাদের বাস্তবে।

যে সমাজ বা রাষ্ট্রে সকলেই ক্ষমতার লেজ ধরে শুধু নয়, লেজের লোম ধরে ঝুলে থাকার জন্যও নিজেকে বিক্রি করার জন্য সদাপ্রস্তুত, সেখানে তিনি ছিলেন ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের সঙ্গে ওতপ্রোত। অথচ এখনকার ক্ষমতা-রাজনীতির তস্য নেতা-কর্মীদেরও যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য— যে কোনো উপায়ে নিজের স্বার্থ-সুবিধার সর্বোচ্চ হাসিল— তিনি ছিলেন এর পুরোপুরি বিপরীত। ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, পরকল্যাণকামী, শিল্প- সংস্কৃতির জন্য সর্বোচ্চ নিবেদন, নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য, নিজের ও পরিবারের সুখ-সুবিধার প্রতি সজ্ঞান নির্লিপ্তি, কখনো কখনো আত্মবিনাশী— এ যুগে যেন রূপকথার গল্প। কিন্তু শাকিল আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন তাই। আর বঙ্গবন্ধুও বোধহয় তাঁর এই ধরনের সন্তানদের স্বপ্ন থেকেই স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ করেছিলেন। মানুষের মহৎ স্বপ্নগুলো কবিতার মতোই সুন্দর। কিন্তু স্বপ্ন অধিকাংশ সময়ই অধরা, কিংবা বাস্তবের হাতে পড়ে তাতে নানা বিকৃতি ঘটে। তবু কোথাও কোথাও হয়তো তার প্রকৃত বিচ্ছুরণ টের পাওয়া যায়, তাতেই স্বপ্নটির সার্থকতা। অনেক দিন থেকেই আমাদের উন্নতি-উন্নয়ন বিস্ময়কর, আবার আমাদের বহু ধরনের পতনও কম বিস্ময়কর নয়। বিশেষত রাজনীতি ও রাজনীতিকদের নৈতিক-মানবিক-আত্মিক পতন সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এটা আমাদের আরেক জাতীয় ট্র্যাজেডি যে, বণিকরা ক্রমাগত হয়ে উঠছে রাজনীতিক আর রাজনীতিকরা পরিণত হচ্ছে বণিকে। ফলে সমাজের সর্বত্র বণিকায়ন ছড়িয়ে পড়েছে। এই যখন সাধারণ প্রবণতা, তখন একবারেই বিপরীত মেরুতে তার যে আত্মিক অবস্থান, এ যেন ক্ল্যাসিকেল রাজনীতিকেরই পুনর্জন্ম। একদা জাতীয় প্রয়োজনে কবি-লেখক-শিল্পীরা রাজনীতিতে এসেছিলেন, এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের ইতিহাসে জীবন্ত। সেটি ছিল জাতীয় উত্থানের প্রয়োজনে। এখনো এ শ্রেণির অনেকেই রাজনীতিতে আসছেন, যদিও অনেকাংশে এটি তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতালোভ আর আত্মিক পতনের ইঙ্গিত করে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মমতা-নেতৃত্বাধীন তৃণমূলে। কিন্তু শাকিল এক্ষেত্রেও বিপরীত মেরুর। বরং বলা ভালো, তিনি রাজনৈতিক-চরিত্রের হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে কবির উচ্চতায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন; রাজনৈতিক আদর্শ-বিশ্বাসে অবিচল থেকেও অনেকটাই বিপরীতমুখী কবি-সত্তাধারী হয়ে উঠছিলেন। এ তার মানবিক-আত্মিক উচ্চতাকেই নির্দেশ করে। এদিক থেকে তিনি দুর্লভদের মধ্যেও দুর্লভতম। তাই তাঁর শূন্যতা বুকে বড় বাজে।

২.
তিনি নেই, কিন্তু আজও কী জীবন্ত! তাকে যেন খোলা চোখেই দেখছি বইমেলার মাঠে হেঁটে যেতে, কোনো সংস্কৃতি-অনুষ্ঠানে স্নিগ্ধতা নিয়ে অবস্থান করতে। তার একটি আনত ও মাটিবর্তী দৃষ্টি ছিল, রাজনৈতিক বলদর্পীদের মধ্যে সচরাচর যার বড় অভাব। বরং ইচ্ছে করেই এরা যেন নেতৃসুলভ শারীরভাষা সৃষ্টি করেন, যাতে লোকজন তাদের মোড়ল ভাবেন! কিন্তু তিনি আত্মায় বড় ছিলেন বলেই হয়তো তার এই প্রদর্শনকামিতার প্রয়োজন ছিল না, বরং প্রকৃতিগতভাবেও তিনি ছিলেন উচ্চতার অধিকারী। কিন্তু তার মানসিক উচ্চতা ছিল আরো দীর্ঘ। আমাদের রাজনীতিতে এ ধরনের মানুষের বড় অভাব। আর এটা যে সত্যিই বড় অভাব, তিনি চলে যাবার পর যেন বেশি অনুভব করছি।

সে-অর্থে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। দু-চারবার সামান্য শুভেচ্ছা বা ন্যূনতম কথা বিনিময় হয়েছে। তার আড্ডা-আসর-পানসানিড়বধ্যে যাওয়ারও সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু বন্ধুবর মিলন পাঠানের কল্যাণে একটি দূর-সংযোগ তৈরি হয়েছিল তার তিনটি কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি  -সম্পাদনা সূত্রে। আর এভাবেই কবিতার মধ্য দিয়ে এক ধরনের অদৃশ্য-আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। তখনই অনুভব করি, এ কোনো রাজনীতিকের কবিযশোপ্রার্থিতা নয়, বরং রাজনীতিকের ভিতর থেকেই একজন কবির জন্ম হচ্ছিল। কেননা, তার আবেগ-চিন্তা-দর্শন কবিসত্তা থেকেই উদ্ভূত, সেখানে এমনকি রাজনৈতিক বিষয়ও কাব্যশর্তে সমর্পিত। বিষয়টিতে মুগ্ধ হচ্ছিলাম এবং প্রথম থেকে শেষ কাব্যগ্রন্থে তার ক্রম-উন্নতির চেহারাটিও দেখতে পাচ্ছিলাম। যদিও কবিতার ভিতর দিয়েই তার মধ্যে একটি বেদনার্ত-নিঃসঙ্গ সত্তার দেখা পেয়ে আশ্চর্য হয়েছি, কোথাও কোথাও আত্মবিনাশের বীজ দেখে ত্রস্ত হয়েছি। ভেবেছি, কী এত শূন্যতা তার! এ কি বেদনাবিলাস না বাস্তব? কিন্তু মৃত্যুর রাতে লেখা শেষ কবিতা 'এলা, তোমার জন্য' পড়ার পর মনে হলো তিনি আজন্ম আবেগ ও দুঃখতাড়িত মানুষ। সেই কবিতার মধ্যেই তিনি বলেছেন, মৃতদের কোনো কান্না থাকে না। তবে কি বেদনাজারিত কান্না থেকে মুক্তির জন্য 'মরিবার হ'ল তার সাধ!' এ কি সচেতন মরণ-প্রয়াস? একটি জিজ্ঞাসাচিহ্ন রয়ে গেল।

আমাদের কবিতায় অনেক রাজনীতি পেয়েছি, রাজনীতিতে কবি তেমন পাইনি। যাকে পেয়েছিলাম, তাকেও দ্রুতই হারিয়ে ফেলেছি। অর্জন-হারানো যেমন আমাদের জাতীয় নিয়তি।