সোনালী চাল: বিশ্বকে পথ দেখাবে বাংলাদেশ?

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 22 Nov 2019, 11:58 AM
Updated : 22 Nov 2019, 11:58 AM
কয়েকদিন আগে আমাদের ল্যাবে আমার এক সহপাঠী সেমিনারে জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম (জিএমও) নিয়ে আলোচনা করছিল। জিএমও খাদ্যের আদ্যেপান্ত বলতে গিয়ে হঠাৎ করে একটি স্লাইডে বাংলাদেশের নাম চলে আসলো। যেখানে লেখা ছিল 'গোল্ডেন রাইস ইন বাংলাদেশ'।
সোনালী বা স্বর্ণচাল' নিয়ে এই আলোচনার পর দৈবক্রমে ওইদিন (২০ নভেম্বর) বিজ্ঞান সাময়িকী 'সায়েন্স' একটি প্রতিবেদন করেছে। যার শিরোনাম ছিল- 'Bangladesh could be the first to cultivate golden rice, genetically altered to fight blindness'
শিরোনাম দেখে মনের মধ্যে এক ধরনের শিহরণ বয়ে গেল। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ 'স্বর্ণচাল' চাষে যাচ্ছে বলে গবেষকদের কাছে এমন খবর কিছুটা স্বস্তিরও বটে।
প্লান্টবায়োলজিস্ট বা বায়োটেকনোলোজিস্টের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল কিছুটা হলেও আলোর মুখ দেখাতে যাওয়া বাংলাদেশের প্রশংসা উঠে এলেও সমালোচনাও কম ছিল না। জিনগত পরিবর্তনে ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফসলের উৎপাদন হার যে বেড়ে চলছে, সেটার সুফল মানুষ পেলেও বির্তক পিছু ছাড়ছে না।
তবে সরকার হয়তো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলছে যে খুব শিগগির বাণিজ্যিকভাবে এই সোনালী ধান চাষ করার সুযোগ পাবে কৃষকরা। কৃষি গবেষকদের কাছে বিষয়টি তাই আনন্দের।
প্রায় কুঁড়ি বছর আগে সুইজারল্যান্ডের 'সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ইগো পোট্রাইকুস' এবং জার্মানির ফ্রাবার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পেটার বেইয়ার নেতৃত্বে একদল গবেষক সর্ব প্রথম এই স্বর্ণধানের সাথে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করে দেন।
বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে ২০০০ সালের ১৪ জানুয়ারি 'Engineering the Provitamin A (β-Carotene) Biosynthetic Pathway into (Carotenoid-Free) Rice Endosperm' শিরোনামে যে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন, সেখানে তারা ধানে ভিটামিন এ সংশ্লেষণের জন্য যে পথপরিক্রমা অনুসরণ করা হয় সেই বিটা-ক্যারোটিন তৈরির পরিক্রমা জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে ধানের এন্ডোস্পার্মে প্রবেশ করানো হয়। আর এই বিটা ক্যারোটিন থেকে পাওয়া যায় ভিটামিন এ।
প্রথম দিকে এই দুই গবেষক ড্যাফোডিল ফুল থেকে নেয়া 'ফাইটোন সিনথেজ' জিন এবং মাটির এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে নেয়া 'ক্যারোটিন ডিস্যাচুরেজ' জিন ধানের জিনোমে প্রবেশ করানোর পর দেখতে পান যে এর চালের রং সোনালী হয়ে গিয়েছে। যদিও প্রচলিত আছে বিটা ক্যারোটিনযুক্ত শস্য বা ফলমূলের রং কিছুটা হলুদ হয়।
ক্যারোটিন মূলত গাজর, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, টমেটোসহ বিভিন্ন রঙিন সবজি ও ফলমূলে পাওয়া গেলেও ভাত প্রধান দেশে মানুষে ভিটামিন এ পুষ্টিহীনতার হার কিছুটা হলেও বেশি।
যদিও বাংলাদেশের শতকরা ২১ ভাগ শিশু ভিটামিন এ অভাবজনিত কারণে অন্ধত্বের শিকার হলেও সারা বিশ্বে এই হার নেহাত কম নয়। প্রায় আড়াইশো মিলিয়ন মানুষ ভিটামিন 'এ'-র অভাবে ভুগছেন।
ভিটামিন 'এ' মূলত এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ যাকে রেটিনল বলা হয়। এই রেটিনল থেকে পাওয়া যৌগ আমাদের চোখের রেটিনায় থাকা  কোন ও রড কোষের কার্যকারিতায় ব্যবহৃত অন্যতম আলোক পদার্থ
রোডপসিনে সহায়তা করে। আর এই যৌগটি যদি কোন কারণে আমাদের শরীরে অভাব হয় তখন আমরা দৃষ্টিহীনতায়  ভুগি।
এরপরই ২০০১ সালে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান সুইস এগ্রিকালকালচার বায়োটেক সিনজেন্টার বিজ্ঞানী আড্রিয়ান ডুবক (যিনি বর্তমানে গোল্ডেন রাইস হিউমানটেরিয়ান বোর্ডের সচিবের দায়িত্বপালন করছেন) ওই সময় ২৩ টি চুক্তি এবং ১৬ টি লাইসেন্সের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন যে এই স্বর্ণচালের বীজ উন্নয়নশীল দেশের কৃষকদের কাছে বিনামূল্যে সরবরাহ করবেন।
যদিও সিনজেন্টা এই ধানের চালে ভিটামিন এই পুষ্টিগুণ প্রতি গ্রামে ৩৭ মাইক্রোগ্রামে নিয়ে যায় যেটি শুরুতে ছিল প্রায় ৪ মাইক্রোগ্রামের মত।
সিনজেন্টার গবেষকরা হাল ছাড়েনি। এর মধ্যে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট যাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন রকফেলার ফাউন্ডেশন ও বিল-মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
আর এই গবেষণা প্রকল্পের একটি বিশেষ সহায়তা দেয়া হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই)।
কয়েক বছর আগে শুরু হওয়া এই গবেষণায় বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা ধান২৯ এ সফলভাবে এই জৈবপ্রযুক্তিটি প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে সায়েন্স তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
গত মাসের শুরুতে ঢাকায় স্যার রিচার্ড জন রবার্ট এক আলোচনায় অংশ নিলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মত স্বর্ণচাল প্রযুক্তি বাণিজ্যিকরণের ইঙ্গিত দেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
আর এরপর বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। যে প্রেক্ষিতে সায়েন্সও তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এই সাহসী উদ্যোগ নিয়ে বিস্তর প্রশংসা করে।
তবে এর আগে দীর্ঘদিন বিচার-বিশ্লেষণ শেষে ২০১৮ সালের ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড আন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এক চিঠিতে গোল্ডেন রাইস খাওয়ার পক্ষে মত দেয়। (সূত্র: নেচার বায়োটেকনোলজি, ৬ জুলাই ২০১৮)
যেখানে বলা হয়, যেসব শিশুর ভিটামিন এ পুষ্টিহীনতা ভুগছে তাদের জন্য এই চাল হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আর এরপরই অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা গোল্ডেন রাইস খাওয়াকে নিরাপদ বলে রায় দেয়।
আর এর মধ্যে দিয়ে ফিলিপাইন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইআরআরআই) গোল্ডেন রাইস বা স্বর্ণধান নিয়ে আর কোন ধরনের প্রশ্ন নেই ঘোষণা দেয়।
যদিও এইসব দেশ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়া গেলেও কেউ তা উৎপাদন করার সাহস দেখায়নি। ফলে গোল্ডেন রাইসের আলোর মুখ দেখা নিয়ে কিছুটা হলেও শঙ্কা তৈরি হয়।
বছর দুয়েক আগে ২০১৭ সালে বিআরআরআই বা ব্রি কৃষি মন্ত্রণালয়ে গোল্ডেন রাইস চাষের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে নানা কারণে বিষয়টি থেমে ছিল। সর্বশেষ সরকারের বিভিন্ন মহল মনে করছে, এই জিএমও স্বর্ণচাল হয়তো ২০২১ সালের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর মধ্যে বিতরণ করা হতে পারে।
গত শতকের শেষ দশকে বিভিন্ন দেশে জেনিটিক্যালি মডিফাইড শস্য চাষবাদ শুরু হয়েছে। শুরুতে কিছু দেশ সহজে জিএমওকে স্বাগত জানালেও বেশ কিছু দেশ এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেই চলছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো জাপান।
দেশটির গবেষকরা পরিবেশের অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর ক্ষতিকর প্রভাবের শঙ্কায় এর ব্যবহার থেকে পিছিয়ে।
বাংলাদেশ সরকার জিএমও-কে সাদরে গ্রহণ করার পর আমাদের খাদ্য চাহিদায় কিছুটা হলেও পূরণ হচ্ছে। তবে এই স্বর্ণচাল নিয়ে বিভিন্ন দেশের ন্যায় আমাদের দেশের কিছু মানুষ ও উন্নয়নকর্মীদের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন করছে, মিষ্টি আলু, গাজর দিয়ে সহজেই আমরা যদি ভিটামিন-এ চাহিদা পূরণ করতে পারি, তাহলে এই নব্য ধানের চালে যুক্ত হওয়া ভিটামিন এ প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
এই ধানের চাষে আমাদের পরিবেশে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে কী না তা নিয়ে প্রশ্ন করা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
তবে ট্রান্সজেনিক প্লান্টের মাধ্যমে এক উদ্ভিদের জিন অন্য উদ্ভিদে ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে জিএমও বিরোধী প্রচারণা প্রবলতর হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে এর মধ্যে রাখা হচ্ছে। আর এই এজন্য ইউরোপের অনেক দেশ জিএমও শস্য বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
স্বর্ণচাল বা সোনালী চালের ভাতে যে পরিমাণ ভিটামিন-এ পাওয়া যাবে সেটি যদি আমরা নিয়মিত খাই, এর প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভিটামিন-এ যে প্রিকারসার আমাদের শরীরে যাচ্ছে, তার মোড অব অ্যাকশন সঠিকভাবে হচ্ছে কী না, তা দেখবার দায়িত্ব আমাদের গবেষকদের। এইগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা তারা করেছেন কী না জানি না, তবে আমাদের দেশের মত বিজ্ঞান-বিমুখতার মানুষরা এটিকে সহজভাবে কতটুকু নিবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
আমরা চাই না, বিটি বেগুনের মত এই প্রকল্পটি নিয়ে সমালোচনা হোক। তার আগে পরিষ্কার ধারণা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। বিটি বেগুনে পোকার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে পরিবেশবাদীদের বক্তব্য ফেলে দেয়ার মত ছিল না। এই বির্তক কাটিয়ে সোনালী চাল/ধান কৃষকদের কাছে আনতে হবে।  ধানের পরগায়নে অন্য প্রাণী কিংবা উদ্ভিদের সহায়তা তেমন না থাকায় 'স্বর্ণচাল' কিছুটা হলেও ঝুঁকির বাইরে। দেশে জিএমও খাদ্যের তেমন তথ্যভিত্তিক ক্ষতিকর প্রভাবের গবেষণা নেই বললেই চলে। যদিও  এই নিয়ে গবেষণা চলছে।
আমাদের দেশে বছরে বেশ কয়েকবার শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। বায়োটেকনোলজির এই বিকাশে পাওয়া সোনালী চালের ভাত যদি আমরা শিশুদের খাওয়াতে পারি, তাহলে আমাদের এই ক্যাপসুল খাওয়ানোর প্রয়োজনীয়তা হয়তো আর থাকবে না।
রাতকানা কিংবা দৃষ্টিহীনতা যে শিশু থেকে বৃদ্ধদের গ্রাস করছে, তা থেকে আমরা কিছুটা হলেও মুক্তির দিশারা খুঁজতে পারবো। এফডিএ কিংবা ডব্লিওএইচও গোল্ডেন রাইসের প্রতি সবুজ সংকেত বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণাও বটে।
শুধু বাংলাদেশই নয়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া,ভারত, ভিয়েতনাম কিংবা ফিলিপাইনে সফলতার হাতছানি দেখছে এই সোনালী চাল। আর এটি যদি সফলভাবে আমাদের স্বাস্থ্যগত উন্নয়নে কাজে লাগানো যায় তাহলে হয়তো গত পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞানে বিশেষ করে বায়োটেকনোলিজি কিংবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বড় ধরনের অর্জন হবে।
আর এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে পাবে নতুন পরিচিতি। বাঘা বাঘা দেশের পিছুটানে কিছুটা হলেও সামনের দিকে পথ দেখাবে সোনালী চালে বাংলাদেশ। সব তর্ক-বির্তক এড়িয়ে হয়তো আমরা একদিন ভিটামিন-এ পুষ্টিহীনতা দূর করতে সক্ষম হব। এই প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাক আমাদের কৃষি, আমাদের লাল-সবুজের বাংলাদেশ।