দেশের কোনো ভালো বা মন্দ ক্যাটাগরি নেই

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 14 Nov 2019, 12:11 PM
Updated : 14 Nov 2019, 12:11 PM

এমন একটা সময় ছিল যখন একটি দেশের আয়তন মাপা হতো কোন রাজার আওতায় কতটুকু এলাকা বা রাজত্ব আছে তা দিয়ে। রাজা আরও রাজ্য জয় করলে দেশের আয়তন বাড়তো, হেরে গেলে কমতো। জাতি রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভবের পর নির্দিষ্ট পতাকা, মানচিত্র, জাতীয় সংগীত ইত্যাদির ধারণা এলো। পৃথিবীকে কেটেকুটে এর বিভিন্ন অংশকে নানা নাম দিয়ে গণ্ডিবদ্ধ করা হলো। এই ভূখণ্ডগুলো হয়ে উঠলো জাতি রাষ্ট্রের নামে বর্ণ-গোত্র-সম্প্রদায় ভেদে মানুষকে একত্রিত, সংহতিবদ্ধ করে রাখার মাধ্যম। পতাকা, মানচিত্র বা জাতীয় সংগীত সবই মানুষের তৈরি, এগুলোর কোনটিই প্রকৃতিগত নয়।

দেশ মূলত একটি বিমূর্ত ধারণা। মানুষ যখন দেশকে ভালোবাসে, তখন দেশ বলতে প্রথমেই তার মনে পড়ে প্রকৃতিকে। একটা সুন্দর দেশের কথা কল্পনা করলে সবুজ গাছপালা দিয়ে সাজানো পরিষ্কার শহর ও গ্রাম, কুলকুল করে বয়ে চলা নদী, পাখপাখালি, বনজ আর প্রাণিজ সম্পদ – এগুলোই আগে মনে আসে। তারপর মনে আসে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আর সুশাসনের প্রসঙ্গ। আর যখন একটা দেশের কোন বিষয়গুলো খারাপ তা নিয়ে চিন্তা করি, তখন প্রথমেই মনে আসে, দূর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, দারিদ্র্য, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি। একটু চিন্তা করে দেখুন, আসলে কি দেশকে নানা মাপকাঠিতে ফেলে সেই দেশ ভালো নাকি খারাপ তা বিচার করা যায়? নাকি দেশ আসলে একটা ভূখণ্ড মাত্র। সেই ভূখণ্ড আর সেখানকার বহমান জীবনধারা কালের পরিক্রমায় ভালো নাকি মন্দের দিকে যাবে তা আসলে নির্ধারণ করে সেখানকার বাসিন্দা বা নাগরিকরা। এক্ষেত্রে ভূখণ্ডটির আসলে কোন ভূমিকা নেই।

যে স্থানে মানুষ জন্ম নেয়, যেখানকার আলো-বাতাসে বড় হয় সেই জায়গার প্রতি তার সহজাত ভালোবাসা কাজ করে। আফগানিস্তান হোক অথবা আমেরিকা, সব দেশের জন্যই এটা সত্যি। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে পাশের দেশে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন যে নারী তাঁর মন কাঁদে ফেলে আসা আপেল গাছটির জন্য। কবি মধুসূদন দত্ত ইংল্যান্ডে প্রবাস জীবনে তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের জন্য লাইনের পর লাইন কবিতা লিখেছেন। আমার একজন শিক্ষক বলতেন বিদেশে পিএইচডি করার সময় তাঁর নাকি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের নীলক্ষেত মোড়ের কথা মনে পরতো। তিনি নিজেও জানেন না বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এত সুন্দর সুন্দর স্থাপত্য আর স্মৃতি বিজড়িত স্থান থাকার পরও নীলক্ষত মোড় কেন সারাক্ষণ তাঁর চোখের সামনে ভাসতো।

তাই দেশ শুধু নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নয়, এটা একটা অনুভূতিও বটে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে পার্থক্য তা আসলে রচনা করে মানুষ। নাগরিকরাই একদিকে দুর্নীতি করে, পরিবেশ দূষণ করে, অন্যায়-অবিচারে ডুবে থাকে আবার অন্যদিকে অন্য দেশের সঙ্গে নিজের দেশের তুলনা করে নিজ দেশকে খারাপ বলে চিহ্নিত করে। অথচ দেশটি নানান সমস্যায় জর্জরিত হওয়ার পেছনে তার নিজের অবদানটুকুর কথা তাঁরা ভাবেন না। তাঁরা নাগরিক হিসেবে নিজের কর্তব্যগুলোকে ভুলে গিয়ে শুধু দেশের কাছে আরাম-আয়েস-স্বাচ্ছন্দ্য দাবি করতে থাকেন।

সরকার আর দেশকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে আমরা মনে করি দেশ শুধু আমাকে দিতেই থাকবে। সরকার একাই সব উন্নয়নের কাজ করবে। কিন্তু ঢাকা শহরকে একটা কংক্রিট আর আবর্জনার জঞ্জালে পরিণত করায় আমার নিজের ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে আমদের কোন মাথাব্যাথা নেই। গ্রামে গিয়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলো আর আগের মতো নেই বলতে বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, কিন্তু একবার শহরবাসী হওয়ার পর নিজ গ্রামের উন্নয়ন করতে কেউ উদ্যোগী হয় না । আমরা নিজেরা ট্রাফিক নিয়ম মানি না, কিন্তু দেশে আইন-শৃঙ্খলা কিছু নাই বলে হতাশা প্রকাশ করি।

আজকে ব্রাজিলে আমাজন জঙ্গল পুড়ে যাচ্ছে, মানব সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন সমৃদ্ধ ইরাক যুদ্ধ হানাহানিতে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে, ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর। এই পরিস্থিতিগুলো জন্য কেবল এই দেশেগুলো সরকার দায়ী নয়, দায়ী আমি-আপনি-আমরা, মানে সে সব দেশের বাসিন্দারাও। তাই নিজের দেশকে আরেকটি দেশের সঙ্গে তুলনা করে তাকে ভালো বা মন্দ ক্যাটাগরিতে না ফেলে আমাদের উচিত নিজেদেরকে ভালো বা মন্দ মানুষের ক্যাটাগরিতে ফেলা। একটি দেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে যখন সেখানকার নাগরিকরা দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। এখানে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ তবে মূখ্য নয়। দেশ সবার, তাই দায়িত্বও সবাইকেই নিতে হবে।

দেশের অবস্থা ভালো না, বাংলাদেশ থাকার অযোগ্য হয়ে গেছে ইত্যাদি বলার আগে একটু খোঁজ নেন আপনার ঘরের ময়লা রান্নাঘরের জানালা দিয়ে নিচে ফেলা হচ্ছে কিনা। একবার ভালো করে ভেবে দেখুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার লেখাপড়ার পেছনে সরকার যে বিপুল অংকের টাকা ভর্তুকি দেয় তার বিনিময়ে আপনি দেশের প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন। আমার মাঝেমাঝে মনে হয় একটা দেশ কতটুকু উন্নত বা অনুন্নত, কতটা বাস যোগ্য বা অযোগ্য এগুলোকে কম ফোকাসে রেখে, একটা দেশের মানুষ কতটা সৎ আর কতটা অসৎ তা নির্ণয় করে এগুলো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা কতটুকু তা পরিমাপ করার চেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি দেশের কত শতাংশ নাগরিক কী কী প্রক্রিয়ায় বায়ু দূষণ করছে তার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা। একটা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষনার মূল প্রতিপাদ্যই হওয়া উচিত সেই দেশের কত শতাংশ মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে আইন মেনে চলেন।

এই দেশের কোন ভবিষ্যৎ নেই, দেশের সব কিছু নষ্টদের দখলে চলে গেছে – এই কথাগুলো শুনলে মনে হয়, দেশ যেন নিজেই একজন চলমান ব্যক্তি। তার দায়িত্ব হলো আমার জন্য সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। প্রকৃত সত্য হলো, আমরা শুধু নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চলেছি বলেই দেশের সকল মানুষের সামষ্টিক ভবিষ্যৎ আজ হুমকির মুখে। যে নষ্টদের দখলে দেশ চলে গেছে তাদের মধ্যে আমিও একজন। দুর্নীতিতে শীর্ষ হওয়ার পেছনে আমার নিজের একটু হলেও অবদান আছে। তাই এখন থেকে দেশকে বকাবকি করার সময় নিজেকে আর আপনার আশেপাশের মানুষদেরকেই বকাটা দিন, দেশ নামক বিমূর্ত ধারণাটির উপর সব দোষ চাপিয়ে দয়া করে নিজের দায় এড়াবেন না। এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'দুর্নীতি থাকলেই সব কিছু অকেজো হয়ে যাবে তা নয়। মানে দুর্নীতির ভেতরেও অনেক কিছু হয়, পরিবর্তন হয়। যে দেশে দুর্নীতি আছে সে দেশে পরিবর্তন আটকে থাকে না' (তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা)। আসুন না, বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা ভুলে গিয়ে যার যার অবস্থান থেকে একটু চেষ্টা করে দেখি নিজেদের গণ্ডির মধ্যে থেকেই পরিবর্তন আনয়নে কোনো অবদান রাখতে পারি কিনা।

'আমি বলি যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো। – মাশরাফি বিন মুর্তাজা