কিছু কলমের কালি কখনো শেষ হয় না

হাসান ইমাম
Published : 14 Nov 2019, 10:29 AM
Updated : 14 Nov 2019, 10:29 AM

কালির পোঁচে অক্ষর হারিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু কালো রঙে ঢাকা সংবাদপত্রের বলার কথাটি সবার কাছে আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এটাই সংবাদমাধ্যমের শক্তি; একেবারে স্বতন্ত্র, নিজস্ব। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রগুলো তাদের প্রথম পাতার প্রতিটি শব্দ-বাক্য কালো রঙে ঢেকে সেই অপ্রতিরোধ্য শক্তিই কথা আরেক দফায় বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিল।

স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমের এই শক্তিবলে ফুটে ওঠে দেশটির শাসকদের চেহারা-চরিত্রের এক ঝলক; এ এমন ঝলক যাতে সংবাদমাধ্যম ঝলসে যাওয়ার যোগাড়। নানা ছুতোনাতায়, হরেক ফন্দিফিকিরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে রাষ্ট্রযন্ত্র যে আজও সক্রিয়— সেই কথাটিই কালো রঙে ঢেকে 'প্রকাশ' করা হলো। কালি দিয়ে 'কালো' চেনাতে অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্রগুলোর ব্যতিক্রমী এই পদক্ষেপের জেরে স্বাভাবিকভাবেই দেশটির সরকারের মুখে কালি লেগেছে। কিন্তু এমন কালি-লাগা মুখের সরকার কি আর দুটি নেই? নাকি এভাবে আরও অনেক সরকারের তথাকথিত উজ্জ্বল মুখ কালিতে লেপ্টে দেওয়ার জরুরত নেই?

অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পার্লামেন্টে একের পর এক আইন পাস করছে সরকার। বলাই বাহুল্য, এ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা সরকারি সিদ্ধান্ত থাকে সংবাদের বাইরে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হচ্ছে হয়রানিমূলক মানহানির মামলা। সম্প্রতি নামকরা এক নারী সাংবাদিকের বাড়িতে গিয়ে সব তছনছ করেছে পুলিশ— যদি 'জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত' তথ্য কিছু পাওয়া যায়। একটি টিভি স্টেশনেও চালানো হয়েছে পুলিশি অভিযান। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, জবানে (পড়ুন: কলমে) লাগাম টানার অপচেষ্টা; এসবই ভয়ভীতি দেখানোর কূটকৌশল।

অস্ট্রেলিয়ার মতো একই ধরনের ঘটনাপ্রবাহ কি অন্য অনেক দেশেও বয়ে যাচ্ছে না? সংবাদমাধ্যমের মুখ চেপে ধরার পাঁয়তারা কেবল অস্ট্রেলিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার মতো কয়েকটি দেশের গণ্ডিতে সীমায়িত নয়। গণতন্ত্রকে 'ব্র্যান্ড' হিসেবে জাহির করায় সচেষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রসাশনকে গণমাধ্যমের 'সতীন' বললেও জোরালো আপত্তি ওঠার সম্ভাবনা কম। স্বয়ং ট্রাম্প তো সুযোগ পেলেই সংবাদমাধ্যমের মুণ্ডুপাত করতে এতটুকু কসুর করেন না। যদিও সংবাদমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা দেশটির সংবিধান প্রদত্ত।

প্রতীচ্যের দিক থেকে ফিরিয়ে প্রাচ্যে নজর দিন; প্রায় একই ছবি দেখা যাবে। এই উপমহাদেশের প্রায় সব কটি দেশের সংবাদমাধ্যমেরই কমবেশি হাসফাঁস অবস্থা। ভৌগলিকভাবে প্রতিবেশী দেশগুলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নেও একে অপরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এ যেন মিলের ওপর সোয়া মিল!

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্র ও ঘর-লাগোয়া প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান গত কয়েক বছর ধরেই নিম্নমুখী। সংবাদমাধ্যমের অফিসে আয়কর বিভাগ থেকে পুলিশের তল্লাশি, সাংবাদিক হত্যা থেকে মামলা— কিছুই বাদ যাচ্ছে না। দিন কয়েক আগেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক আতিশ তাসিরের নাগরিকত্ব বাতিল করা হলো। নিশ্চিতভাবেই গণমাধ্যমের ওপর বিজেপি সরকারের অসহিষ্ণু আচরণের সর্বশেষ নজির এ ঘটনা। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে দেশটির বর্তমান অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪০তম। গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করার স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে এই সূচক নির্ধারণী সংস্থা রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) হিসাবে, গত বছর ভারতে নিজেদের কাজের বদৌলতে প্রাণ হারিয়েছেন ছয়জন সাংবাদিক। পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মিয়ানমারের মতো দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা সাংবাদিকের সুরক্ষা যে কতটা বিপন্ন, তা আজ আর কারো অজানা নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বিচারে গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১ দেশের মধ্যে ১২৩তম। আর ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৫০তম স্থানে বসিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার।

অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে পেশাদারিসহ বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা কিছু কম আছে, এ কথা বলার উপায় নেই। রাজনৈতিক সমর্থনের দিক থেকেও তাদের কারো কারো অবস্থান ১৮০ ডিগ্রিতে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে সবগুলো সংবাদপত্র কিন্তু এক ছাতার তলে দাঁড়াল; একাট্টা হলো অধিকারের প্রশ্নে। এই দৃষ্টান্তের নির্যাস অন্য অনেক দেশের সংবাদমাধ্যম কতটা আত্মস্থ করল, সেটাই এখন দেখার।

সংবাদমাধ্যমকে জব্দ করতে জবরদস্ত আইন করা বা পুরনোটাকে সংশোধন করে ধারালো করার পথে হাঁটা সরকারগুলোর পুরনো খাসলত। এর সঙ্গে দেশপ্রেমের ধোঁয়া তুলে বা চেতনাবিরোধী ট্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েও সংবাদমাধ্যমকে কুপোকাত করার চেষ্টা দৃশ্যমান। এই পটভূমিতে কিছু ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে রীতিমতো 'স্তুতিমাধ্যম' হয়ে ওঠার নিলাজ ‍উদাহরণও কিন্তু কিছু কম নেই।

সমালোচনার পথ সংকুচিত হয়ে পড়লে 'চুপ' থাকাটাও কখনো কখনো সশব্দ প্রতিবাদের মতো সমান অর্থবহ। কিছু না লিখেও কীভাবে সহস্র কথা বলা যায়, তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ তো অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্রগুলো। সুতরাং 'হ্যাঁ'য়ে 'হ্যাঁ', 'না'য়ে 'না' মেলানোর সরল অঙ্কে গলদ আছে। এরপরও শাসকদের স্বরে ‍সুর মেলানো সংবাদমাধ্যমের কাণ্ডারিরা জেগে না উঠলে তাদের ঘুম আর ভাঙার নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘুম চিরঘুমে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, ইতিহাস সাক্ষী।

তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমের আর্থিক সামর্থ, সাংবাদিককের চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি যতটা বল-ভরসা যোগায়, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সংবাদমাধ্যম ততটাই শক্তিহীন। তাই বলে সংবাদমাধ্যমের গোড়ার নীতিগত কথাটি কিন্তু উভয়ের জন্য ভিন্ন হয়ে যায় না। আর কে না জানে, নীতি নিজেই শক্তি, তার অন্য কোনো শক্তির দরকার হয় না।