প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযান হোক ত্যাগীদের তরে

সাইদুর রহমান
Published : 23 Sept 2019, 03:22 PM
Updated : 23 Sept 2019, 03:22 PM

শেখ হাসিনার শুদ্ধি অভিযান আপসহীন রক্তের বহির্প্রকাশ। নিজের ঘর নিজের মতো করে ঝাড়ু দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার দু:সাহসিক এই অভিযানে দেশের সকল স্তরের মানুষ তার সহযাত্রী। আর দলের ত্যাগীরা ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। ত্যাগীরা হলেন দলের প্রাণ আর দলের আদর্শ ও নীতির ধারক ও বাহক। 

ত্যাগী নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক দলগুলোতে দিনে দিনে কদর কমে যাচ্ছে অথবা কদর দিতে রাজনৈতিক দলগুলো অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে না। দলের নীতি নির্ধারকের ইচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায় হোক- ত্যাগীরা অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত- এটা শ্বাশত সত্য হওয়ার পথে।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকাল দেখেছি, তেমনি বিএনপি কিংবা চারদলীয় জোটের শাসনকাল দেখেছি। এরশাদ সাহেবের আমলে জাতীয় পার্টি মানেই- বিএনপি মনে হতো। এরশাদ সাহেব বিএনপির দলছুট নেতার সমন্বয়ের জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তখন দেশের মানুষ বুঝতো বিএনপির নেতারা সুবিধার জন্য জাতীয় পার্টিতে যাবেন। আর বিএনপির নেতারা আবার প্রয়োজনে বিএনপিতে ফিরে আসবেন।

এরশাদের রক্তচক্ষু শাসন আমলে অনেক বড় বড় নেতার বহর দেখা গেছে! আজকে জাতীয় পার্টির অবস্থা ও জনমর্থন তলানিতে ঠেকেছে। তার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ দলের নির্ধারকরা ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করেনি এবং নতুন করে ত্যাগী নেতা তৈরি করতে পারেনি।

ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পার্টিতে থাকা সেই দলছুট নেতাদের প্রতি সুদৃষ্টি পরলো বিএনপির। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্যাকেজের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপি কিছু কর্মী বিচ্ছিন্ন নেতাদের দলে ভেড়ালেন। হাইব্রিড নেতারা শুরু করলো দুর্নীতির মহোৎসব।

জিয়াউররহমান সাহেব বলেছিলেন, "রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদেরজন্য কঠিন করে দেব।"  দলের ত্যাগীরানিজের সন্তানের মুখে খাবার না দিয়ে দলের মুখে খাবার দেয়। চারদলীয় জোটেরদৌরাত্ম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকলো বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

অভিযোগহীনভাবে ত্যাগীরা দল থেকে প্রস্থান করলেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব এবং দুর্নীতির কারণে দেশের কয়েকবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আজ জেলের ঘানি টানছেন। বিএনপিতে যদি আজ ত্যাগীরা থাকতো,  তাহলে বুকে পাথর বেঁধে, রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করতো। কোথায় যারা চারদলীয় জোটের আমলে টাকা পাহাড় গড়েছিলেন? এসির ঠাণ্ডা হাওয়ার মায়ায় পরে আছেন অথবা দেশের বাইরে বিলাস বহুল জীবন-যাপন করেন।

'রাজনীতিতে দেশের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী নয়, কিন্তু দল দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে'। ত্যাগীরা যেমন উচ্চাভিলাষী হন না, তেমনই পদলোভী না হলেও দলের সম্মানজনক স্থানে থাকতে চান। ত্যাগীরা নালিশ করতে পারে না, আবার অভিমান পরিহারকরতেও পারেনা। ত্যাগীরা স্বার্থের জন্য চোখগুলো রক্তবর্ণ করতে পারেনা; আবার আড়ালে চোখের অশ্রু ঝরাতে পারে না। ত্যাগীদেরকোনদিন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়না। কিন্তু দলের প্রয়োজনে আঙ্গুলের চেয়ে বড় অঙ্গ দিতে প্রস্তুত। দলের সুসময়ে হয়তো তাদের উপস্থিতি কম, কিন্তু দুঃসময়ে জীবন বাজি রাখেন।

বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। রাজপথে যে দলের সৃষ্টি। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবহনকারী আওয়ামী লীগের আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় কাউন্সিল। এখন বাংলাদেশের চারিদিকে শুধু জয় বাংলার জয়গান। জাতীয় কাউন্সিলে ত্যাগীরা স্থান না পেলে দলে বিপর্যয় শুধু সময়ের ব্যাপার। 

আওয়ামী লীগতৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। দেশের যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দলেরক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। ১৫ বছরের ক্ষমতায় দলের আদর্শিক শিক্ষায়কয়জন নেতাকর্মী দীক্ষিত হয়েছে? এ দীর্ঘ সময়ে কয়জন ত্যাগী নেতাকর্মী দলে তৈরি হয়েছে?

দলের ভিতরেঅনুপ্রবেশকারীরা বা হাইব্রিডরা দলের সত্তরবছরের নীতি আদর্শকে কলঙ্কিত করেছে ক্যাসিনো স্টাইলে। এখন শুধু বাকি দলের গঠনতন্ত্রটা ছিঁড়ে খাবার! ত্যাগীরা দলকে ভালবাসে পাজরের অনুভূতিদিয়ে আর অনুপ্রবেশকারী ভালবাসে ক্যাসিনো অনুভূতিতে।  

দল এখনসুসময়ের পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত। এখন দলীয় অফিসে নেতাকর্মীর অভাব নাই। আগেরমতো হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কর্মী জোগাড়করতে হয় না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে দুঃসময় গেছে ৯০ দশকে। তখন 'জয় বাংলা' বললে এদিক সেদিক তাকাতে হতো নির্যাতন অথবামামলার ভয়ে। 

সেই ৯০দশকের ত্যাগী ছাত্রনেতা,  কর্মীরা আজ কোথায় ? যারা দলের অস্তিত্ব টেকানোর লড়াইয়ে জীবনবাজি রেখেছিল প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে। যারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, রাজপথ জয়বাংলা স্লোগানে কম্পিতকরতেন,ক্ষমতার স্বাদ কি তাদের জিহ্বাপ্রান্তকে স্পর্শ করেছে? হাইব্রিডের দৌরাত্ম্যেত্যাগীরা আজ দলে কোণঠাসা। কিন্তু ত্যাগীরা দলের নীতি আদর্শকেবুকে নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখেছে। 

দলের আদর্শএবং লক্ষ সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই- তারপরও বড় নেতা। মুজিবকোট গায়ে দিয়ে নিজেকে প্রকাশেরব্যর্থ প্রয়াস। বিভিন্ন দলীয় ব্যানার বা পোস্টারে অসঙ্গতি দেখেদেশবাসী বিভ্রান্ত হয়।  রাজনীতিতে দলীয় শিক্ষার বড় অভাব।

বঙ্গবন্ধুবলেছিলেন,  "নীতিবিহীন নেতানিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজেপাওয়া যায়না।"

আওয়ামী লীগের মতো অবশ্যবাকি রাজনৈতিক দলগুলোও ত্যাগী কিংবা মেধাবীনেতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে না। প্রাধান্য দিচ্ছে টাকার কুমিরকে। এখানেই শেষ না, আছে আত্মীয়করণ, মামাকরণ।

আওয়ামী লীগেরত্যাগী নেতাকর্মীরা ২১ অগাস্টে মানবঢাল তৈরি করে ভালবাসার নেত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকরেছিলেন তারা অনেকেই হয়তোবা জীবিত নেই। আর যারা জীবিত আছেন,  তারা দলীয়মূল্যায়ন কতটুকু পাচ্ছেন?

ময়মনসিংহের নান্দাইলের আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা তোফাজ্জল ডাক্তার সাহেব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসলে জুতা পরবেননা। চৈত্রমাসের তপ্ত রাজপথ হোক আর অগ্নি বালুকণা হোক, সবই তার প্রতিজ্ঞার কাছে পরাজিত হয়েছিল। জুতা না পরেই তিনি কয়েক যুগ কাটিয়েছেন। তিনি বেশ কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করেছেন। আমি তখন ছোট,  তার পায়ের বীভৎস অবস্থার স্মৃতি এখনও আমাকে বিচলিত করে তোলে। পা দু'টি চৈত্রের খড়া রোদে মাটি ফাটার মতো চৌচির দেখেছি। পায়ের গোড়ালির নিচও ছিল ফেটে চৌচির। রক্ত ঝরতে ঝরতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া রক্তনালিগুলো দেখা যেত।

ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় বিদেশ ভ্রমণেই খালি পায়ে যেতে হয়েছে তাকে। সেখানেও খালি পায়ের জন্য অনেক বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। আবার অনেকবার তার বিদেশ যাত্রা বাতিলও হয়েছে। অবশেষে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তার পায়ে জুতা পরিয়ে দিয়ে ত্যাগের কিঞ্চিৎ ঋণ শোধ করেন। ২১ অগাস্ট যারা নিহত বা আহত হয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে ত্যাগী নেতা। সবার কথা লিখতে পারছিনা বলে ক্ষমা চাইছি।

২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারফিকুল ইসলাম (আদা চাচা)। সহজ, সরল,দল পাগল মানুষ ছিলেন আদা চাচা। দলের লোকদের জন্য বিনামূল্যেআদা  দিতে গিয়ে তার পৈতৃক নামটা বিলুপ্তহয়ে যায়! তিনি হয়ে উঠেন সবার প্রিয় আদা চাচা। তিনি ত্যাগীদের উজ্জল দৃষ্টান্ত। আদাচাচা ১৯৬০ সাল থেকে আওয়ামী লীগের এমন কোনো কর্মসূচি নেই যাতে অংশ নেননি। খয়েরি পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরতেন আদা চাচা। তারপাঞ্জাবির পকেটগুলোতে কুচি কুচি করে শুকনা আদা কৌটাতে ভর্তিথাকতো।  আদা খাইয়ে সবার কণ্ঠ সচল রাখতেন রাজপথের মিছিলে। আদাচাচার আদা খায়নি এমনকোনও নেতা নেই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আদাচাচার আদার ভক্ত।জানা যায় ২১ অগাস্ট তখনকার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আদা দিতেগিয়ে গ্রেনেড হামলায় নিহত হলেন আদা চাচা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে আদা চাচাএকটি কথাই নাকি জিজ্ঞাসা করছিলেন- 'নেত্রী বেঁচে আছেন?'

ত্যাগীদেরমূল্যায়ন তখনই হবে যখন প্রতিটি দলে ত্যাগীদেরত্যাগের কথা লিপিবদ্ধ থাকবে। নতুন প্রজন্ম পড়বে আর নতুন করে ত্যাগী নেতা তৈরি হবে।