আলিফ লাইলা-১০: রবীন্দ্রনাথ কি মুসলিম-বিদ্বেষী ছিলেন?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 22 Sept 2019, 12:06 PM
Updated : 22 Sept 2019, 12:06 PM

[পূর্বকথা: হিন্দুস্তানের এক বদমেজাজি বাদশাহ ছিলেন: শাহরিয়ার। এই বাদশা তাঁর এক বেগমের পরকীয়ার কারণে পুরো স্ত্রীজাতির উপর যারপরনাই নারাজ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করবেন এবং ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতল করাবেন। কয়েক বৎসর ধরে বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালো শত শত যুবতী কন্যা। বাদশার এক উজির ছিলেন এবং উজিরের ছিল দুই কন্যা: শেহেরজাদি ও দিনারজাদি। নারীজাতির প্রতি করুণাপরবশ ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী শেহেরজাদি ছোটবোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিকাহ করেন বাদশা শাহরিয়ারকে। জীবনের আখেরি রাতে নববধূর আবদার রাখতে বাদশার আদেশে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় দিনারজাদিকে। গভীর রাতে পূর্বপরিকল্পনামাফিক দিনারজাদি একেকটি সওয়াল পুছতে থাকেন আর শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না সেই সব সওয়ালের জওয়াব দিতে শুরু করেন, কিন্তু ভোরের আজান শোনা মাত্র শেহেরজাদি কথা বলা বন্ধ করে দেন এবং নকশি লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন দুই বোন। ধীরে ধীরে জ্ঞানপিপাসু হয়ে উঠছেন বাদশা শাহরিয়ার, শুনছেন তিনি মন দিয়ে দুই বোনের সওয়াল-জওয়াব, যার ফলশ্রুতিতে পর পর নয় দিন ধরে বার বার শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছেন তিনি। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের দশম রাত্রি]

তোমাকে আজ প্রশ্ন করতে হবে না, প্রিয় বোন দিনারজাদি। আমি বুঝে গেছি, তুমি কী জিজ্ঞেস করবে। তোমার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে: না, কখনই না। রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও মুসলিম-বিদ্বেষী হতে পারেন না।

আমি জানি, দিনারজাদি, তুমি তবুও হাত কচলে ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে: 'মানলাম, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন– এমনতর দাবির সপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানদের একটি অংশ বিশ্বাস করে বসে আছে, তিনি মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন। তাদের এই বিশ্বাসে কি বিন্দুমাত্র সত্যও নেই?

'দিদি শোনো!'- দিনারজাদি থামিয়ে দেয় শেহেরজাদিকে। 'ইংরেজ দণ্ডবিধি বলে: হাজার অপরাধী পালিয়ে যাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়। তুমি কি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে পারবে যে কথিত অপকর্মটি, অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করাটা কি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল? রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বহুপ্রজ লেখকের রচনার কোথাও না কোথাও মনের ভুলে লিখে রাখা মুসলমানদ্বেষের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রমাণ, একটি বাক্য কিংবা শব্দও কি নেই?'

'এক লফ্জ ভি নেহি!' বাংলাদেশের মুসলমানদের একটি গোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা উর্দুতেই বললাম, দিনারজাদি। কোনো বিশ্বাসে সত্য থাকে না। মানবজাতির ইতিহাসে কোনো বিশ্বাস এ পর্যন্ত সত্যে পরিণত হয়নি। প্রতিটি বিশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমি পুরো রবীন্দ্র রচনাবলী ওলট-পালট করে দেখেছি, দিনারজাদি। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমানদের এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই।

'দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো! বাংলাদেশে হিন্দু কিংবা বৌদ্ধরা সংখ্যায় 'লঘু', বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রে শুধু এই বিচারেই তারা দুর্বল! অখণ্ড ভারতবর্ষে মুসলমানদেরও সেই একই অবস্থা ছিল। 'সেই তো মহান লোক, গুণ গাই তার। মন-মুখ-ব্যবহার যার একাকার!' বেশির ভাগ বাঙালি মুখে এক, মনে আর এক, কাজে অন্য আর এক। রবীন্দ্রনাথ গড়পড়তা বাঙালির মতো ছোটলোক ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের যেই কথা, সেই কাজ। যখনি সুযোগ পেয়েছেন, মুসলমান দুর্বলের পক্ষে এবং হিন্দু প্রবলের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

১৯০৫ সালে ইংরেজরা বঙ্গবিভাগ, অর্থাৎ বাংলাকে দুই ভাগ করে, পূর্ববঙ্গ ওআসাম নিয়ে আলাদা একটি প্রদেশ করেছিল। কিন্তু বর্ণহিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে১৯১১ সালে বঙ্গবিভাগ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। বঙ্গবিভাগ বাতিল হওয়াতেক্ষুব্দ পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের শান্ত করতেই দশ বছর পর ১৯২১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারসিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইংরেজরা– এমনটা মনে করেন অনেকে। যদিও এই মনে করাটাবিতর্কের উর্ধে নয়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ববাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশচাইছিলেন, এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হোক, অন্ততপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবকদেরনামের তালিকা দেখেতো তাই মনে হয়। সেই তালিকায় মুসলমান-হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের লোকইছিলেন।

বর্ণহিন্দুরা যেহেতু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিলেন, সেহেতু তারা মুসলমানদের এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমি গত রাতে প্রসঙ্গান্তরে বলেছি, দুয়ে দুয়ে সব সময় যে চার হবেই, এমন কোনো কথা নেই। একটা সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন না– এ কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মুসলমানদের প্রতি তাঁর মনোভাব বর্ণহিন্দুর অনুরূপ ছিল। সব বর্ণহিন্দুই কি মুসলমানদের ঘৃণা করতো? রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পড়েতো তা মনে হয় না। 'গোরা' উপন্যাসের নায়ক গোরা, 'ঘরেবাইরে' উপন্যাসের নায়ক নিখিলেশ মুসলমানদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তাদের ভালো চাইতো। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মুসলমানরা হিন্দুদের পক্ষাবলম্বন না করার জন্য রবীন্দ্রনাথ বরং হিন্দুদেরকেই দোষ দিয়েছেন।

১. "নিজে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিব, অথচ অন্যে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনো নাম দেওয়া যায় না।"  (প্রবন্ধ: ছোটো ও বড়ো)

২. "বঙ্গবিচ্ছেদ ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল। সেই হৃদয়টা যত দূর পর্যন্ত অখণ্ড, তত দূর পর্যন্ত তাহার বেদনা অপরিচ্ছন্ন ছিল। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ, তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।" (প্রবন্ধ: লোকহিত)

মুসলমান প্রজাদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত প্রকাশিত হয়েছে 'ঘরে-বাইরে' উপন্যাসে। এই উপন্যাসের ভিলেন বা প্রতিনায়ক সন্দ্বীপ বর্ণহিন্দুদের প্রতিনিধি। সন্দ্বীপের ভণ্ডামি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে কাপর্ণ্য করেননি রবীন্দ্রনাথ। মুসলমান প্রজাদের পক্ষাবলম্বন করা, বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে স্বদেশী বাড়াবাড়ির সমালোচনা করা জমিদার নিখিলেশ কারও নিষেধ না শুনে গভীর রাতে অশ্বারোহনে ছুটে গিয়েছিলেন মুসলমান পাড়ায়, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা থামাতে। দাঙ্গাকারীদের হাতেই তিনি গুরুতর আহত কিংবা নিহত হন।

রবীন্দ্র রচনাবলীতে মুসলমান চরিত্রের সংখ্যা বেশি নয়– রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সত্য। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে সাহিত্য একটি সৃষ্টিকর্ম এবং হিসাব করে, আঁটঘাট বেঁধে সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। সাহিত্য রচিত হয়, রচনা করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ যে সমাজকে চিনতেন, জানতেন, সেই সমাজকেই তিনি তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য করেছেন। একজন ওরহান পামুক ইস্তাম্বুল নিয়ে লিখবেন, কিংবা জার্মানদের জীবন নিয়ে লিখবেন একজন গুন্টার গ্রাস– এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি মুসলমানেরা গত এক শতক ধরে লিখছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত কত জন মুসলমান লেখক বাঙালি হিন্দুর জীবন তুলে ধরেছেন তাঁদের রচনায়? তবে যত কম মুসলমান চরিত্রই অংকন করে থাকুন রবীন্দ্রনাথ, কোনো উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পে হিন্দুর তুলনায় মুসলমানকে তিনি ছোটো করে দেখাননি।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন, হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই নির্ভয়ে নিজ নিজ ধর্ম পালন করুক। "যাঁরা বলেন সত্য এক, অতএব কেবলই একটি ধর্মই সত্য, ধর্মের একটিমাত্র রূপই সত্য– তারা সত্য যে এক কেবল এই সত্যটিই মানেন, আর সত্য যে অনন্ত সে সত্যটা মানতে চান না।" (গোরা) রবীন্দ্রনাথ চাইতেন, ধর্মপালনে মুসলমান হিন্দুকে এবং হিন্দু মুসলমানকে যথাসাধ্য সহায়তা করুক। গল্পগুচ্ছের অন্তত একটি গল্পে মুসলমানের পূত চরিত্র দেখে এক অসহায়া হিন্দু নারী অবাক হয়েছে এবং স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে (মুসলমানীর কথা)। অন্য একটি গল্পে এক মুসলমান নবাবজাদি স্বেচ্ছায় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছে (দুরাশা) কিন্তু হিন্দুর জন্যে নিজের ধর্ম ত্যাগ করেছে, সেই হিন্দু তাকে গ্রহণ করেনি। রবীন্দ্র-নিন্দুকের দল হিন্দু বালিকার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি চেপে যায়, মুসলমান বালিকার স্বেচ্ছাধর্মান্তরের ঘটনাটি ফলাও করে প্রচার করে।

"বুঝেছি তুমি হিন্দু ঘরের মেয়ে, মুসলমানের ঘরে যেতে সংকোচ হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো– যারা যথার্থ মুসলমান,তারা ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণকেও সম্মান করে, আমার ঘরে তুমি হিন্দুবাড়ির মেয়ের মতোই থাকবে। আমার নাম হবির খাঁ। আমার বাড়ি খুব নিকটে, তুমি চলো, তোমাকে আমি নিরাপদে রেখে দেব!" (মুসলমানীর কথা)

বিনাদোষে হিন্দু সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্তা হিন্দু নারীকে আশ্রয়দানকারী মুসলমানহবির খাঁর উপরের বক্তব্যটি রবীন্দ্রনাথের মনের কথা হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। হবির খাঁরমা হিন্দু ছিলেন এবং নিজগৃহে হিন্দুর ধর্ম ও আচার পালন করতেন।

বলা হয়ে থাকে: 'ধর্মে জোর-জবরদস্তির কোনো স্থান নেই।' কিন্তু একটি ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্মে আসতে চাইলে জীবন-সংশয় হতে পারে, হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তির ধর্মপরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন না। 'দুরাশা' শীর্ষক গল্পে স্বেচ্ছায় হিন্দুধর্ম গ্রহণকারী নবাবকন্যার বক্তব্য: 

'হিন্দুশাস্ত্রে আছে জ্ঞানের দ্বারা, তপস্যার দ্বারা শুদ্র ব্রাহ্মণ হইয়াছে, মুসলমান ব্রাহ্মণ হইতে পারে কিনা সে কথার কোনো উল্লেখ নাই, তাহার একমাত্র কারণ, তখন মুসলমান ছিল না। আমি জানিতাম, কেশরলালের সহিত আমার মিলনের বহু বিলম্ব আছে, কারণ তৎপূর্বে আমাকে ব্রাহ্মণ হইতে হইবে। একে একে ত্রিংশ বৎসর উত্তীর্ণ হইল। আমি অন্তরে বাহিরে আচারে ব্যবহারে কায়মনোবাক্যে ব্রাহ্মণ হইলাম, আমার সেই ব্রাহ্মণ পিতামহীর রক্ত নিষ্কলুষতেজে আমার সর্বাঙ্গে প্রবাহিত হইল…"

একই গল্পে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারিনী হিন্দু রমণীর বক্তব্য:

"যে ধর্ম চিরদিন আমাকে জীবনের সব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে, অবজ্ঞার আস্তাকুঁড়ের পাশে আমাকে ফেলে রেখে দিয়েছে, সে ধর্মের মধ্যে আমি তো দেবতার প্রসন্নতা কোনোদিন দেখতে পেলুম না। সেখানকার দেবতা আমাকে প্রতিদিন অপমানিত করেছে সে কথা আজও আমি ভুলতে পারি নে। আমি প্রথম ভালোবাসা পেলুম, বাপজান, তোমার ঘরে। … তোমার মেঝো ছেলে করিম, তাকে আমি মনের মধ্যে গ্রহণ করেছি– আমার ধর্মকর্ম ওরই সঙ্গে বাঁধা পড়েছে। তুমি মুসলমান করে নাও আমাকে, তাতে আমার আপত্তি হবে না– আমার নাহয় দুই ধর্মই থাকল।"

'সমস্যাপুরণ' গল্পে জমিদার কৃষ্ণগোপাল সরকারের দুই স্ত্রী, একজন মুসলমানী, অন্যজন ব্রাহ্মণী। উভয়েই নিজ নিজ গৃহে স্বধর্ম পালন করেন। উভয় সংসারে এক জন করে পুত্রসন্তান: অছিমদ্দি এবং বিপিন। জীবন সায়াহ্নে জমিদার সুদূর কাশি থেকে বাংলায় ফিরে এসে বিপিনকে বাধ্য করেছিলেন মুসলমান সৎভাই অছিমদ্দির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে। আদালত প্রাঙ্গণে কৃষ্ণগোপাল ও হিন্দুপুত্র বিপিনের কথোপকথন:

"অছিমদ্দি তোমার ভাই হয়, আমার পুত্র।"

বিপিন চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, "যবনীর গর্ভে?"

কৃষ্ণগোপাল কহিলেন, "হ্যাঁ, বাপু।"

মুসলমান প্রতিবেশির জন্য সাধারণ হিন্দুর অন্তকরণে জমে থাকা সহমর্মীতারসংবাদ উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্পে:

"সেদিন সকালে একটি বৃদ্ধ মুসলমান তাহার পৌত্রীর ওলাউঠার চিকিৎসার জন্যতাহাকে ডাকিতে আসিয়াছিল। আমি শুনিতে পাইলাম সে কহিল, "বাবা, আমি গরিব, কিন্তু আল্লাতোমার ভালো করিবেন।" আমার স্বামী কহিলেন, "আল্লা যাহা করিবেন কেমন তাহাতেই আমার চলিবেনা, তুমি কী করিবে সেটা আগে শুনি।" শুনিবামাত্রই ভাবিলাম, ঈশ্বর আমাকে অন্ধ করিয়াছেন,কিন্তু বধির করেন নাই কেন। বৃদ্ধ গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাসের সহিত 'হে আল্লা' বলিয়া বিদায়হইয়া গেল। আমি তখনই ঝিকে দিয়া তাহাকে অন্তঃপুরের খিড়কি-দ্বারে ডাকাইয়া আনিলাম; কহিলাম,"বাবা, তোমার নাতনির জন্য এই ডাক্তারের খরচা কিছু দিলাম, তুমি আমার স্বামীর মঙ্গল প্রার্থনাকরিয়া পাড়া হইতে হরিশ ডাক্তারকে ডাকিয়া লইয়া যাও।" (দৃষ্টিদান)

হিন্দু সমাজের তুলনায় মুসলমান সমাজের, হিন্দু ধর্মের তুলনায় ইসলাম ধর্মেরযা কিছু ভালো তা নিজের রচনায় তুলে ধরতে কার্পণ্য করেননি রবীন্দ্রনাথ। প্রয়োজনে ইসলামেরআদর্শ কিংবা নবী মুহম্মদের (স.) আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুসলমানদের গঠনমূলক সমালোচনাওকরেছেন, তাদের মনে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা করেছেন।

"পল্লীর মধ্যে বিচরণ করিয়া গোরা ইহাও দেখিয়াছে, মুসলমানদের মধ্যে সেই জিনিষটি আছে যাহা অবলম্বন করিয়া তাহাদিগকে এক করিয়া দাঁড় করানো যায়। গোরা লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছে গ্রামে কোনো আপদ বিপদ হইলে মুসলমানেরা কেমন নিবিড়ভাবে পরস্পরের পার্শ্বে আসিয়া সমবেত হয় হিন্দুরা এমন হয় না। … ধর্মের দ্বারা মুসলমান এক, কেবল আচারের দ্বারা নহে। এক দিকে যেমন আচারের বন্ধন তাহাদের সমস্ত কর্মকে অনর্থক বাঁধিয়া রাখে নাই, অন্য দিকে তেমনি ধর্মের বন্ধন তাহাদের মধ্যে একান্ত ঘনিষ্ঠ। তাহারা সকলে মিলিয়া এমন একটি জিনিষকে গ্রহণ করিয়াছে যাহা 'না' -মাত্র নহে, যাহা 'হ্যাঁ'; যাহা ঋণাত্মক নহে, যারা ধনাত্মক; যাহার জন্য মানুষ এক আহ্বানে এক মুহূর্তে একসঙ্গে দাঁড়াইয়া প্রাণবিসর্জন করিতে পারে।" (গোরা)

"একজন বৃদ্ধ মুসলমান মাথায় এক-ঝাঁকা ফল সবজি আণ্ডা রুটি মাখন প্রভৃতি আহার্যসামগ্রী লইয়া কোনো ইংরেজ প্রভুর পাকশালার অভিমুখে চলিতেছিল। চেন-পরা বাবুটি তাহাকে গাড়ির সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইবার জন্য হাঁকিয়াছিল, বৃদ্ধ শুনিতে না পাওয়াতে গাড়ি প্রায় তাহার ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে। কোনোমতে তাহার প্রাণ বাঁচিল কিন্তু ঝাঁকাসমেত জিনিষগুলা রাস্তায় গড়াগড়ি গেল এবং ক্রুদ্ধ বাবু কোচবাক্স হইতে ফিরিয়া তাহাকে 'ড্যাম শুয়ার' বলিয়া গালি দিয়া তাহার মুখের উপর সপাং করিয়া চাবুক বসাইয়া দিতে তাহার কপালে রক্তের রেখা দেখা দিল। বৃদ্ধ 'আল্লা' বলিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া যে জিনিষগুলা নষ্ট হয় নাই তাহাই বাছিয়া ঝাঁকায় তুলিতে প্রবৃত্ত হইল। গোরা ফিরিয়া আসিয়া বিকীর্ণ জিনিষগুলা নিজে কুড়াইয়া তাহার ঝাঁকায় উঠাইতে লাগিল। মুসলমান মুঠে ভদ্রলোক পথিকের এই ব্যবহারে অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া কহিল, 'আপনি কেন কষ্ট করছেন বাবু, এ আর কোনো কাজে লাগবে না। … ঝাঁকা ভর্তি হইলে গোরা তাহাকে বলিল, 'যা লোকসান গেছে সে তো তোমার সইবে না। চলো, আমাদের বাড়ি চলো, আমি সমস্ত পুরো দাম দিয়ে কিনে নেব। কিন্তু বাবা, একটা কথা তোমাকে বলি, তুমি কথাটি না বলে যে অপমান সহ্য করলে আল্লা তোমাকে এজন্য মাফ করবেন না।"

মুসলমান কহিল, ' যে দোষী আল্লা তাকেই শাস্তি দেবেন, আমাকে কেন দেবেন?"

গোরা কহিল, "যে অন্যায় সহ্য করে সেও দোষী, কেননা সে জগতে অন্যায়ের সৃষ্টি করে। আমার কথা বুঝবে না, তবু মনে রেখো, ভালোমানুষি ধর্ম নয়; তাতে দুষ্ট মানুষকে বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের মুহম্মদ (স.) সে কথা বুঝতেন, তাই তিনি ভালোমানুষ সেজে ধর্মপ্রচার করেন নি।" (গোরা) ('স.' বা 'সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম' বর্তমান লেখকের সংযোজন)

পুরো রবীন্দ্রনাথ রচনাবলী খুঁজে সম্ভবত এমন একটি বাক্য কিংবা শব্দও পাওয়াযাবে না, যাতে রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সম্প্রদায়কে উদ্দেশমূলকভাবে হেয় করেছেন। মুসলমানেরবিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি রবীন্দ্রনাথ, যদিও প্রসঙ্গ উঠলেই মুসলমানের সঙ্গে মিলতেনা পারা হিন্দুর সমালোচনা করতে তিনি দ্বিধা করেননি।

"আমি এক ইংরেজিনবিশের কথা জানতেম, হোটেলের খানার প্রতি তাঁর খুব লোভ ছিল। তিনি আর-সমস্তই রুচিপূর্বক আহার করতেন, কেবল গ্রেট-ইস্টার্ণের ভাতটা বাদ দিতেন; বলতেন, মুসলমানের রান্না ভাতটা কিছুতেই মুখে উঠতে চায় না। যে সংস্কারগত কারণে ভাত খেতে বাধে সেই সংস্কারগত কারণেই মুসলমানের সঙ্গে ভালো করে মিলতে তাঁর বাধবে।" (কালান্তর)

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন, মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের সমকক্ষহয়ে উঠুক:

"ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তাহলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল-ঠেকা পালোয়ানির ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয় পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা।" (কালান্তর)

ঠাকুরেরা ছিলেন পিরালী ব্রাহ্মণ। বলা হয়ে থাকে, মধ্যযুগে মুসলমান-সংসর্গের কারণে পিরালী ব্রাহ্মণেরা সমাজে এমনই পতিত হয়েছিল যে অন্য ব্রাহ্মণ পরিবার এদের মেয়ে দিত না। ঠাকুর পরিবারের অন্তত একজনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল জাপানের ওসাকা অঞ্চলে: সন্দ্বীপ ঠাকুর। তিনি আমাকে বলেছেন, ঠাকুর পরিবারে মুসলমানী পোশাক, মুসলমানী খাবারের বিশেষ আদর ছিল। একেবারে শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ এক মুসলমান পাচক রেখেছিলেন, নাম গেদু মিয়া, বাড়ি সরাইল। বৃদ্ধবয়সে এই গেদু মিয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ চাইতেন, মুসলিম সম্প্রদায় শিক্ষিত হয়ে এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক উন্নতি করে হিন্দুদের সমকক্ষ হয়ে উঠুক। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় গেদুকে তিনি বলেছেন, সাবধানে থাকতে। 'মানুষে মানুষে প্রভেদ আমি করি না গেদু, কিন্তু হিন্দু আর মুসলমানেরা পাগল হয়ে গেছে। আমি সব ধর্মের পুস্তক পড়েছি, সেখানে শান্তির কথা আছে, হানাহানির কথা নেই।' বিদায়কালে তিনি গেদুকে বলেছিলেন: 'গেদু, আমারতো সময় শেষ, তাই তোমাকে বিদায় দিতে হচ্ছে। তোমার যখন ছেলেমেয়ে হবে, তুমি তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলো।' মুসলমান সম্প্রদায়ের এক নেতা শেরেবাংলা ফজলুল হকের উপর রবীন্দ্রনাথের অনেক আশা ছিল। এটাও গেদুই জানিয়েছেন আমাদের। লক্ষ্য করো দিনারজাদি, শেরেবাংলা ছিলেন জমিদারী প্রথা বাতিলের অন্যতম হোতা, অথচ জমিদার রবীন্দ্রনাথ তারই পক্ষাবলম্বন করছেন। 

তুমিই বুকে হাত দিয়ে বলো দিনারজাদি, এমন একজন ব্যক্তি কি আদৌ মুসলিমদ্বেষীহতে পারেন? মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষাবিস্তারের সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট করার চেষ্টাদূরে থাক, এমনতর চিন্তাও রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তির মাথায় আসার কথা নয়। 'আমার জন্মগতপেশা জমিদারি, কিন্তু স্বভাবগত পেশা আসমানদারি।' (কালান্তর) রবীন্দ্রনাথের শব্দচয়নলক্ষ্য করো, দিনারজাদি। আকাশদ্যোতক সংস্কৃতমূল শব্দের অভাব নেই বাংলায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথব্যবহার করেছেন উর্দু/ফার্সি শব্দ 'আসমান'। আসমানদার রবীন্দ্রনাথ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরবিরোধিতা করবেন– এমনটা ভাবতে পারাটাও ব্যক্তিবিশেষ কিংবা গোষ্ঠীবিশেষেরনীচতার অন্যতম লক্ষণ বটে।

ঢাকা কিংবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনো মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা নিম্নতর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেছেন– এই বহুশ্রুত, বহুচর্চিত দাবির সপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণের অনুপস্থিতিতে 'রবীন্দ্রনাথ বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' শীর্ষক মামলাটি আপাতত খারিজ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে যদি এ মামলা জনআদালতে আবার কখনও ওঠে, কোনো চৌকশতর ব্যবহারজীবী যদি অকাট্যতর কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে সক্ষম হন, সেক্ষেত্রেও যে সমস্ত প্রমাণ এখানে উপস্থাপিত হলো, সেগুলোর ভিত্তিতে বিবাদী অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের পক্ষের উকিলের জিতে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।

[ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠলে এবং ভোরের আযানও শোনা গেলে মুখে কুলুপ আঁটলেন শেহেরজাদি। ফজরের নামাজ পড়ে দুই বোন নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাদশা শাহরিয়ারও বেরিয়ে গেলেন ফজরের নামাজ আদায় করতে এবং অতঃপর রাজকার্যে। কিছু বাঙালির ভিত্তিহীন রবীন্দ্রবিদ্বেষের কথা শুনে বাদশা ভীষণ রেগে আছেন, কিন্তু তিনি জানেন, এই সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান তাঁর মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাদশার পক্ষেও করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাওতো দরকার। বাদশারা সাধারণত জ্ঞানী হন না, কিন্তু সঙ্গগুণে বাদশা শাহরিয়ারের জ্ঞানতৃষ্ণা উত্তরোত্তর প্রবল হয়ে উঠছিল যার ফলশ্রুতিতে শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড একাদশ দিন পর্যন্ত মুলতবী হলো।]