ভরা শ্রাবণে মনে পড়ে সোহাগপুরের গণহত্যার কথা

Published : 25 March 2014, 05:20 PM
Updated : 28 July 2012, 05:16 PM

১৯৭১ সালের ১০ শ্রাবণ।

''বাইরে বেরিয়ে এসে পাকসেনাদের দেখলাম। ওরা ভেতরে ঢুকতে চাইছে। আমি ঠিক এভাবে হাত দুটো উপরে তুলে বল্লাম, ভেতরে কেউ নেই। ওরা আমাকে লাথি দিয়ে উঠোনের বাইরে ছুঁড়ে ফেলল। আমার ছেলে আর স্বামীকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এল। এইখানে…. ঠিক এইখানেই গুলি করে মারল ওদের দুজনকে।''

''গ্রামের সব পুরুষকে ওরা গুলি করে মেরেছে…. কাউকে বাদ দেয়নি। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর মৃতদের কবর দেওয়ার মতো একজন পুরুষও জীবিত ছিলেন না। আমরা লাশগুলো টেনে নিয়ে কবর দিলাম। গোসল করানো গেল না, কাফনের কাপড় কোথায় পাব? আমি নিজে যে কবরটা খুঁড়েছিলাম, ওখানেই ক'জনকে শুইয়ে দিলাম। আসলে ওটাকে 'কবর' বলা যায় না, একটা গর্ত মাত্র। জানাজা-কাফনের কাপড় ছাড়াই শুধু মাটি দিয়ে ওদের শরীরের রক্তগুলো ঢেকে দিলাম। হায়রে কপাল!''

এ জন্যই সোহাগপুর গ্রামকে বিধবাদের গ্রাম বলা হয়।

২০০০ সালে সোহাগপুরে প্রথম গিয়েছিলাম। খুঁজে পেতে সমস্যা হল অনেক। পথে অনেক জায়গায় জিজ্ঞেস করতে হল। শেষে পৌঁছুলাম ওই অসাধারণ সবুজে মোড়ানো, শান্ত-নিভৃত গ্রামটায়। অনেক মৃত্যু আর সংগ্রামের বেদনা সয়েও গ্রামটার সৌন্দর্য এখনও অটুট। উবিনীগের ফরিদা আখতার আমাদের এই ভ্রমণের বিষয়টি ঠিক করেছিলেন। তিনি ক'জন গাইডের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। ফলে খুব সুবিধা হল আমাদের। জামালপুর জেলার একদম ভেতরের দিকে সোহাগপুর-কাঁকরকান্দির অবস্থান। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। একসময় ওই সব পাহাড়ে থাকতেন গারো আদিবাসীরা। পরে ওদের পাহাড় ছেড়ে সমতলে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। পাহাড়ের ঠিক ওপাশেই ভারত।

সোহাগপুরে যেতে কাঁচা রাস্তাগুলো বন্যার পানিতে ডুবে ভেঙ্গে গেছে। এবড়ো-খেবড়ো পথ। ছোট দুটো ছেল আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আমরা কীভাবে কষ্ট করে রাস্তায় চলছি। ওদের কাছে জানতে চাইলাম, ''সোহাগপুর কোথায় জানো?''
''ও…. বেওয়াদের গ্রাম?''

(নিচে সোহাগপুর সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র।)

)

ভাঙ্গাচোরা জরাজীর্ণ বাড়ির ভেতর থেকে কবেকার পুরনো কাঠের চেয়ার উঠোনে সাজিয়ে দেওয়া হল। 'সাহেবদের' বসার ব্যবস্থা আর কী। যাতে তাদের কষ্ট না হয়। কঠিন দারিদ্র্যের চিহ্ন সব জায়গায়। মৃত্যু আর ক্ষুধার স্মৃতি ওদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

শ্রাবণের সেই ভয়াবহ দিনটির স্মৃতি হাতড়ান তারা। গ্রামের কেউ কিছু জানতেন না। শ্রাবণের ১০ তারিখে হঠাৎ করে এই গ্রামে হামলা চালায় পাকসেনারা। গ্রামে ঘোরাঘুরিও করেনি ওরা। কাউকে কোনও জিজ্ঞাসাবাদও নেই। কে কী সে সব জানার চেষ্টাও করেনি। সরাসরি পাখির মতো গুলি করে নির্বিচারে গ্রামের সব পুরুষকে হত্যা করল। এত দ্রুত ঘটে গেল সব! ওই নারীদের মনে হচ্ছিল যেন আজরাইল নিজেই নেমে এসেছেন এতগুলো মানুষের জান কবচ করতে। আর তার যেন খুব তাড়াহুড়ো! সেই ভোরে গ্রামের মানুষের দৈনন্দিনের জীবন কেবল শুরু হয়েছিল। তখনই পাকসেনারা গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে তাদের মেরে ফেলল।

সোহাগপুর গ্রামের ওই দরিদ্র বিধবাদের জীবনের কঠিনতম দিনের স্মৃতির কথা শুনছিলাম। ওদের মুখগুলো দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন কিলবিল করতে লাগল। এই একুশ শতকে এসেও গ্রামটা খুঁজে পেতে আমাদের এত সমস্যা হল, পাকসেনারা ১৯৭১ সালে ওই ভরা বর্ষার মধ্যে কীভাবে খুঁজে পেল?
আর কেনই বা গণহত্যা চালানোর জন্য অনুল্লেখযোগ্য এই গ্রামটাকেই বেছে নিল ওরা!

গ্রামে এখন আর কোনও বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ নেই। প্রায় ত্রিশ বছর আগে (যেহেতু ২০০০ সালে আমরা ওখানে গিয়েছিলাম, সেই সময়ের হিসেবে ) যারা গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন, বেঁচে থাকলে তারাই তো হতেন গ্রামের মুরুব্বি। এক রক্তাক্ত ভোর বেশিরভাগ শিশুর বাবাকে কেড়ে নিল। এখন সেই শিশুরা বড় হয়ে কোনও রকমে অন্যের জমিতে কাজ করে টিকে আছে। কোনও সহায়-সম্পদও নেই ওদের। হয়তো শক্তিশালীরা ওগুলো কেড়ে নিয়েছে। আইন বা প্রচলিত প্রথাও ওদের পক্ষে কাজ করেনি।

''জীবন আমাদের কাছ থেকে সবই তো ছিনিয়ে নিল। আমাদের স্বামীদের। আমাদের জমিজমা। এমনকি শান্তিটাও, শুধু শরীরটা রেখে গেল!"

গণহত্যার জন্য পাকসেনারা কেন এ জায়গাটা বেছে নিল সে প্রশ্নর উত্তর কিন্তু অজানাই রয়ে গেছে। আমি একাত্তরকে পটভূমি করে বর্তমানের দিকে চোখ রাখলাম। গোটা বাংলাদেশেই একই অবস্থা। এই যে দরিদ্র মানুষগুলোর ক্ষুধা আর যন্ত্রণার মধ্যে জীবন কাটিয়ে দেওয়া– এর জন্য তো আমরাই দায়ী। এক বৃষ্টিস্নাত ভোরে পাকসেনারা যে ধ্বংসটা করে গেছিল, আমরা তো সেই যজ্ঞটা চালিয়ে গেছি। যেতে দিয়েছি।

কিন্তু যুদ্ধের চেয়েও লম্বা হয়ে গেছে এই দুর্ভাগাদের জীবন। একাত্তরে ওই গণহত্যার পরও যা বাকি ছিল সেটুকু আমরা কেড়ে নিয়েছি। সোহাগপুরের ওপর নিষ্ঠুরতার কাহিনী তো একটি দিক। অপর পিঠে রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার অবিশ্বাস্য গল্প।
"ওদের কবরের পাশেই জীবন কাটিয়ে দিলাম। এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যাব না আমি। এক জায়গাতে ওরা সবাই শুয়ে আছে। না খেয়ে মরলেও তাই এখান থেকে নড়ব না আমি। এখানেই আমার ঠিকানা। আমার জীবন।" জীবন যা পারেনি মৃত্যুই তা পেরেছে। কঠিন এক বন্ধনে আবদ্ধ করেছে ওদের।

সোহাগপুরের বিধবারা সেই রক্তাক্ত শ্রাবণ মেঘের দিনে দাফন-কাফন ছাড়াই কবরস্থ করেছিলেন স্বজনদের। এরপর কষ্টের দিনগুলোতে খাবারের অভাবের মধ্যে কীভাবে টিকতে হয়, সেটা তারা ভালোই শিখে গিয়েছিলেন। আলেকজান বেগম তার স্বজনদের কবরের পাশে গড়ে তোলা এক খড়ের চালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন তিনি। না-খেয়ে কীভাবে দিন কাটিয়েছেন সেটা বলতে গিয়েই তার অশ্রু ঝরল। গাছের শেকড়, ছোট চারা, বনজ ফল আর সবজি…. কত কিছু যে খেয়েছেন শুধু খিদা মেটাতে! দুর্ভিক্ষের সময় বাঙালি এ ভাবেই প্রাণ বাঁচায়। খাবারগুলোর নাম শুনে খুব খারাপ লাগল আমার।

"দিনের পর দিন চাল কিনতে পারিনি…. এ সবই খেয়েছি….. কলার থোড়ের ভর্তা খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি।

কী করুণ এই গল্পগুলো। যেভাবে ধর্মীয় আনুষ্ঠাকিতা ছাড়াই মৃতদের ওরা কবর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই গল্পটা যেমন ভয়ঙ্কর লেগেছে আমার কাছে, তেমনই ভয়ঙ্কর লেগেছে ওদের কলার থোড় খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা! এটা শুধু শরীরের যন্ত্রণা বাড়ায় না, মনের মাঝেও গভীর ক্ষত তৈরি করে।

এই কাহিনীর ফাঁকেই জানলাম কাদের ডাক্তারের কথা। সে-ই গ্রামের লোকদের রোগ-শোকে চিকিৎসা করত। একাত্তরে সে এই গ্রামের লোকদের তো বটেই, গ্রামের পাশ দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে যাওয়া শরণার্থীদের কাছ থেকেও জিনিসপত্র লুট করত। এই গ্রামের একটা কুঁড়েঘরে সে সব লুটের মাল রাখা ছিল। গ্রামের কেউ কেউ বিষয়টা টের পেয়েছিলেন। তাদেরই কেউ এক রাতে ওই কুঁড়েঘরেরর তালা ভেঙ্গে ভেতরের কিছু মাল লুট করে নিল।

এই ঘটনার পরই কাদের ডাক্তার কয়েক মাইল দূরের পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হল। সোহাগপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প আছে এ কথা বলে সে ওদের এই গ্রামে হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করল। গ্রামটার অবস্থান যেহেতু সীমানা ঘেঁষে, তাই পাকসেনাদের কাছেও তার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হল। এরপরই ওই গণহত্যা। ওরা কিন্তু শুধু পুরুষদেরই হত্যা করেছিল, কারণ ওদের ধারণা ছিল গ্রামের সব পুরুষই 'মুক্তি'। নারীরা এই আক্রমণ থেকে রেহাই পেয়েছেন। এ ভাবেই সাধারণ গ্রামীণ কৃষক আর কামলারা কাদের নামের এক ব্যক্তির লোভের শিকার হয়ে, 'মুক্তি' হওয়ার অপরাধে নির্মমভাবে নিহত হলেন।

গ্রামবাসীরা এখনও দাবি করেন তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। ওইদিন যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের অনেকে রাতেই ভারতে পালিয়ে যান। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া তাদের পছন্দ ছিল না। তাই ক'দিন পরই ওরা গ্রামে ফিরে এলেন। ফিরলেন তাদের ভাঙ্গা কুটির, স্বজনদের কবর আর ক্ষুধার রাজ্যে।

কাদেরের দুজন সহযোগী ছিল– সোনা মিয়া আর ময়না মিয়া। ওরা হালুয়াঘাটে পালিয়ে গিয়েছিল। একাত্তরের পর কখনও-ই ওদের এই গণহত্যার জন্য বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা হয়নি। একাত্তরের ওই সব গণহত্যার জন্য দায়ী খুনিরা ইতিহাসের গর্ভে এ ভাবেই হারিয়ে গেছে।

সোহাগপুরে যে বিষয়টি আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করলাম তা হল, বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে রাগ বা ক্ষোভ বলতে কিছুই নেই। বছরের পর বছর না-খেয়ে থাকতে থাকতে তাদের এই দশা। আশাহীনতা, জীবনের প্রতি মমত্ববোধ না থাকা- চিরদুর্ভিক্ষের মধ্যে এটাই স্বাভাবিক। আর এ সবের মিলিত ফলে প্রতিশোধের স্পৃহা তাদের মন থেকে উবে গেছে।
সোহাগপুরের গণহত্যার জন্য দায়ী কাদের ডাক্তারকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার কথা কেউ কেউ বললেন। হয়তো সেটা করা দরকার। কিন্তু ওই বিধবা-পল্লীতে এতদিন ধরে চিরদুর্ভিক্ষের অবস্থা বজায় রাখার জন্য আমরা কাকে শাস্তি দেব? সেই সোহাগপুরে 'যেখানে কিছু বেওয়া, বেওয়ারিশ আর বাংলাদেশের বাস!'

আমি নিজেও কি আসলে আরেকজন কাদের ডাক্তার নই?

দশই শ্রাবণকে তাহলে 'একাত্তরের নাম না-জানা শহীদদের দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হোক।