একটা কাঠগোলাপের গাছ ছিল মনিমালার

মাজুলহাসান
Published : 25 March 2014, 04:40 PM
Updated : 25 March 2014, 04:40 PM

এক.
'বাইরে শিকল দিছে কেডা? দজজা খোলো। বাইরে যামু'
রাত্রি দ্বিপ্রহর পেরিয়ে বাইরে তখন কেউ নেই, কিছু নিশাচর কুকুর, বাংলাখোর পোলাপাইন আর বখরার আশায় বসে থাকা টহল পুলিশ ছাড়া। একনাগাড়ে চেঁচাতে থাকে মনিমালা। কাবিলাও ফিরেছে নাইট সিফট করে অথবা ফেরে নাই। তবু বারোমাসী কাঠগোলাপ, মনি যাকে বলে কাডালিগোলাপ, সেই গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ে। বাচ্চাকাচ্চারা আকশি দিয়ে ফুল পাড়ে। মালা বানায়। মালা পরে কাজে যেতে পারে না খাদিজা-আকলিমারা। তবে কাঠগোলাপের মালা পরে ডাক্তারের কাছে মা-মরা শালিখের মতো বসে থাকে মনিমালা।
'আপনি নাকি আপনার স্বামীরে বালিশ চাপা দিয়া মারতে চাইছিলেন!'
ডাক্তারের কথা কানে যায় না মনিমালার।

আহ কী সুন্দর সাদা জামা! ধপধপা। এমন কাফনের কাপড় দেখছিল সেই ছোটবেলায়, যখন মনিমালা কেবল মনি। মা বলেছিল, সাদা পিরান। আর কর্পুরের সে কী সেন্ট! নাকটা কেমন কুঁচকে যায় মনিমালার। ভাবে, এই দজ্জার বেডিরও মন্নের ধাত। কী ধপধপা লেবাস। কেমন কইরা তাকায় যেন কাবিলার দিকে। ওর কাবিলা। মন ফেরাতে কাঠগোলাপের কথা মনে করে মনিমালা। আর সুবাসে সুগন্ধে সাপ চলে আসে। ডাক্তারনির গলায় ঝোলে। ভয় খেদাতে মনিমালা একমনে খোপার হলুদফুলে হাত বুলায়। যাতে ঘিরান বাইরে না যায়।
'কী বললেন না, ক্যান বালিশ চাপা দিছিলেন? স্বামী কি মারে?'
'না।'

ছোট্ট করে সাড়া দিয়ে মনিবালা সাপ তাড়াতে চায়। শব্দ করেই বলে, 'এই হালিমা আমার খানদানি লাঠিখান কৈ?'
হালিমা মনিমালাদের পাশের ঘরে থাকে। যখন কাজে যায় না কী ওর স্বামী ফরিদুর দপদপিয়ায় যায় বাপমার বাড়িতে, তখন বিশ পেরুনো হালিমা মাঝে মাঝে আসে মনির ঘরে। কাডালিগোলাপ গাছের গল্প শুনতে চায়।
'ভাবি, এই গাছটা তুমি নি লাইগাছ?'

'হ। তখন এই দিকে খালি জলা আর জলা। ধান হইতো এববার, নিচা নামা জমি। হাঁস তইতই করতো।'–এই বলে অদৃশ্য হাসের বাচ্চাদের মুড়ি ছিটায়া খেতে দেয় মনিমালা। কাউয়ার দল উলকিভুলকি দ্যায়। ছোঁ দিবো।
'হালিমা, হালিমা ও, তুই আমার হাসের বাচ্চাটারে দেখবি? খালি পালায়া পলায়া থাকে।'–বলেই কাবিলার পুরনো শার্ট ফরফর করে ফেড়ে ফেলে মনিমালা। এখন কেমন ডিফেক্ট শার্ট বানায় আজকালকার অপারেটররা। চেস্টে ডান বামে এলাইনমিন্ট মিলে না। যদিও আর গার্মেন্টে কাজে যায় না মনিমালা, তারপরও বহুদিনের অভ্যাসে জামা-কাপড় কাটা ছেড়া করে। কিছু না পেলে নিজের শরীলে সুইসুতা দিয়ে জামা আটকে নিতে চায়।
'কি করো ভাবি, দেও সুই সুতা দেও আমারে। শরীলে দুক্খ লাগবে তো!'
অঁ, খুব দরদ না! জানি জানি সব ফিকির। তবু মাঝেমাঝে হালিমাকে বইন বলে ডাকতে মন চায় মনিমালার। এই শয়তান বেটিরও নজর কাবিলার দিকে।

এইসব ষড়যন্ত্র কাকে বলবে মনিমালা?
মাঝে মাঝে ভাবে, যাক সব চলে যাক। সব সতীনের ঘরে যাক। সব হালিমার ঘরে যাক। তবু মন তো মানে না। বলে–'হালিমা, হালিমা ও, তুই আমার হাসের বাচ্চাটারে দেখবি? খালি পালায়া পলায়া থাকে।'
কৈ হাসের বাচ্চা? বলতে গিয়েও থেমে যায় হালিমা। কারণ, ততোক্ষণে সতিসত্যি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দেয় মনিমালা–'রোহান, রোহান রে, কৈ গেলি রে বাপ?'
হালিমা বোঝে না কাকে দেখতে বলে মনিমালা? রোহান নাকি অদৃশ্য হাসের বাচ্চা? সে শুধু কাঠগোলাপ গাছটার দিকে তাকায়া থাকে। কী ঘিরাণ!

এমন ফুলের ঘ্রাণে মাতাল হয়েছিল কাবিলা। শোনা যায়, জিরাবোর গোলাপ বাগানে দুই তিন জন ছোঁড়া-ছোকড়ার সর্বস্ব লুটে নেয়ার পর এক অভূতদর্শন গোলাপ ফুটেছিল। তাই দেখে মজেছিল মনিমালা; আর তারচেয়েও বেশি কাবিলা। লোকে অবশ্য বলে, কবিলা বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু গোলাপের পাপড়ির মতো সালোয়ার খোসা অবস্থায় ওদের হাতে নাতে ধরেছিল এলাকার লোকজন। লগে লগে নিকা।
কাবিলা ফুল ভালবাসে। মনিমালারে বিয়ার এক মাস পর থেকেই বলত, তুই হইলি পাতাবাহার, কাটাবিছা। তোরে আমি দেখামু, কি করি? আরো অনেক কিছুই বলত কাবিলা। আর ওর ঠোটের কোণে একটা ফড়িং হাসি। ধরতে গেলেই ফুরুৎ। ফড়িং ধরতে হলে অসহায় মনিমালা আর কিই বা করতে পারতো কাডালিগোলাপ গাছ লাগানো ছাড়া।

মনে মনে দোয়া করে, কাবিলার বাপমা যাতে না আসে। শুনছে, খুব বড় ঘর কাবিলার। বড় দীঘি, বড় খোলাবাড়ি, খেড়ের পুঁজ, চৌচালা ঘর। তবু হাফফাস লাগে মনিমালার। বাইরে কিছু নিশাশর কুকুর, বাংলাখোর পোলাপাইন আর বখরার আশায় বসে থাকা টহল পুলিশ। হুইসেল বাজে। বাজতেই থাকে।
পুলিশ আইলো নাকি নিয়া কবিলার বাপ-মা? এখন কাবিলাকে কৈ লুকায়?
এতো ছোট্ট ঘর, চান্দের আলো আসে, পাতার শব্দ হয় টিনের চালে, এমনকি শীতের শিশিরও।
'কেডা আছে; এই যে দজজা খুইলা দেও। বাইরে শিকল দিছে কেডা? আমার হাসের বাচ্চা ডাকে! দজজা খোলো।'
দরজায় মাথা খুঁটে নিরাশায় জমে যায় মনিমালা; হয়তো ঠান্ডায়।

এসির বাতাসে থেকে থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ডাক্তারনির হাত মনিমালার মাথায় ঘাড়ে ঘোরাঘুরি করে। ওর তখন দাঁত কপাটির দশা। শীতের রাতে কাঁথার ফোকর দিয়ে নাক বের করার মতো আলগোছে সব দেখে মনিমালা। ডাক্তারনি একবার ডানে গেল, এবার বামে; একবার শুধু কি যেন বিছরায়। সব ফুসলানির ধান্দা।

ও মোর আল্লা। ডাক্তারনির হাতে কাবিনের কাগজ। এখন যদি ছিইরা ফালায়। তাইলে তো কাবিলা যে ওর বর সেইটার প্রমাণ কি?
ডাক্তারনি মিটমিটি হাসে। কি যেন লেখে। ত্রাহি ত্রাহি ওঠে মনিমালার-'নাম কাটে নাতো মোটা ছুরি দিয়া? ছুরি দিয়া রক্ত পড়ে গো ডাক্তারনি। থামান, চৌখে জ্বালা করে গো!'
ডাক্তারনি ছুরিটা টেবিলে রাখে। মুখটা একদম কাছে আনে। মনে হয় মনিমালার কাডালিগোলাপের মালার গন্ধ নেয়। বলে– 'না, না, আমি আপনার বন্ধু। বলেন, কেনো কাবিলাকে বালিশ চাপা দিয়ে মারতে চাইছিলেন?'
তবু সাড়া নেই বলে মুখের ওপর আরো ঝুঁকে কৌশল পাল্টায় ডাক্তারনি। গলার সাপটাকে এক প্যাচ দিয়ে মাথাটাকে পেছনে ঘুরিয়ে দেয় সে। খানিক আশ্বস্ত হয় মনিমালা।
'ডাক্তার আপা আমি খালি কাবিলারে লুকাইতে চাইছিলাম।'
"স্ট্রেঞ্জ, বালিশ চাপা দিয়ে!"

দুই.
ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর পর মানুষ যেমন রিক্ত, শক্তিহীন অথচ দৃঢ় হয়ে ওঠে, তেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মনিমালা। সামনে কতো গণ্যমান্য মানুষ, বিচার করতে আসছে। কবিলাটা যেন কেমন; ঠাওর করতে পারে না। সব খেয়াল রাখে, বলে–'কি বৌ, ওষুধ খাইছ?'
কথা শুনে না মনিমালা। খালি দাবড়ানি দেয়। আবার কখনো হুহু বাতাসের মতো শুলায়া শুলায়া সেঁধিয়ে যেতে চায় বুকের ভেতর।
এরমধ্যে বুক-পেট এক হয়ে যাওয়া কুঁজো বুড়ি মাঝে মাঝে আসে মনিমালার খোঁজে। যখন গোলাপবাগানে যেত কাবিলার সাথে, রশিদের সাথে, হাবিলের সাথে অথবা একা-একা তখন মনি ওকে দশ টাকা করে ভিক্ষা দিতো। কুঁজো বুড়িও বিশ্বস্ত। কখনোই বলে নাই–'এই বেডি তোরে না দেখলাম কাইলকা আরেক বেডার লগে লটরপটর করতে!'
টাকার লোভে নাকি সত্যিসত্যি বানে ভেসে যাওয়া মাইয়ার প্রতিচ্ছিবি দেখে কুঁজোবুড়ির এক রা–'মা ভালা নি আছ? মুকখান হুগনা ক্যান?'
কি করে বলে মনিবালা ওর মালা বানানোর কতো শখ! বাগানে কতো পোলাপাইন! মালি কৈ? বলে–'বুড়ি রে, বাগানে খালি সাপ। মালি নাই। খালি ডাকাইত। আমারে কাইটা ফালাইতে চায়।'
'কে রে বেডি? কে?'
'কাবিলা। আমারে কয় ওষুধ। কিন্তু আসলে দেয় বিষ।'
কুঁজো বুড়ি চিন্তা আরো নুয়ে পড়ে, যেন এখনই মাটি চাটতে লেগে যাবে। বলে, 'খুব সাবধানরে মা। খুব সাবধান!'
কম সাবধান কি থাকে মনিমালা? এই যে রোহান তার পেটের বাচ্চা। সাক্ষাত শয়তান। শরীলে দাদা-দাদির গুটিবাজি রক্ত!
ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, 'আপনি আপনার ছেলেকে ভাঙ্গা ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দিতে চাইছিলেন ক্যান?'
মনিমালা কিছু বলে না। সে তখন একটা কাডালিগোলাপ হয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়। হলদে ছোপ সাদা ফুল। বসির ফুল কুড়াতে কুড়াতে মনিকে বলে, 'বুবু কি রূপ গো তোমার?'

আরো সাদায় হোলদে ছোপ হয় মনিবালা। একটা কুড়ি হয়। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কুড়ির ভাঁজ খোলে বসির। ওর ঘরে তখন কেউ নাই। জালাল যে হরিজন অ্যাপারেলে লোডারের কাজ করে, জাঙ্গিয়ার ভেতর কাপড় চুরি করে ফেরার পথে কি সুপারভাইজারের সাথে নকতামি করে পারা খায়; সেও নেই।
একটা বিড়াল শুধু। হুলো বিড়াল।
বসির বলে, 'দেখছো বুবু আমার বিলাই, কেমন তাগড়া!'
মনিমালা একটু কাঁত হয়ে নির্লিপ্ত মুখে বসে থাকে। হঠাৎ মনে হয় 'আমার হাসের বাচ্চা!'
সাথে সাথে, বলে, তোমার বিলাই আমার হাসের বাচ্চা খায়া ফালাইব, খেদাও অইটারে, খেদাও।
বসির হাসে। কয়, 'ডরাইও না।'

তবু মনি মাথায় মনিধারী কালনাগিনীর মতো ফোঁস ছাড়ে দেখে বসির ঠোটের কোণে ফড়িং ধরে আনে। তিরতিরি। কাঁপে। মনিমালা কাঁপে। ধীরে ধীরে কুড়ি ঘুরিয়ে জড়িয়ে মাড়িয়ে বসির বলে, 'চিন্তা কইরো না বুবু আমি তোমার কাবিলার ওপর নজর রাখমু।'
পুরো হলুদ হয়ে যেতে যেতে মনি শুধু বলে, 'ঠিক কইতাছ তো?'
'হ্যা, এক্কেরে হাছা কতা। শতে শ।'

তখনই একটা হাসের বাচ্চা বসিরের ঘরের ফাঁক গলে ঘরে ঢোকে। প্যাকপ্যাক করে। মা হাসীর ডানার উষ্ণতা খোঁজে।
এই সামান্য ঘটনায় তিল থেকে তাল। বুঝতে পারে না মনিমালা। কে বলল, কোন সুমুন্দির পুত কইলো, ও বসিরে সাথে লটরপটর করছে!
পরদিন অবশ্য বসির বলেছিল, 'অইসব ভাইবো না বুবু। আমার বিলাই দুধ খায়, মাছও খায় না। আর হাসের বাচ্চা, না না, অইটা তোমারই থাকব।'

কিন্তু পানি কৈ? খালি খটখটে মাটি। সারাদিন লোহালক্কর, ইট খোয়ার চিৎকার। দুই মাইল দূরে মরা নদী; ভাঙ্গা ব্রিজ। নিচে বালির মতো চিকচিক করে পানি। মনিমালা সেখানেই তার হাসের বাচ্চা রেখে আসতে চায়।
'যা, শয়তানের বাচ্চা, আমার ঘরে কৈ থাকবি? দরিয়ায় যা… মরা দরিয়ায় যা।'

তিন.

সেদিনের সেই বিচারের পর অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছিল মনিমালা। একারণে নয় যে সালিশে মহিলা কাউন্সিলর, যার স্বামী আড়াপাড়ার সরকার দলীয় নেতা, সেই মহিলা হাকিম বসিরকে নয়; ঘুষ খেয়ে উল্টা কাবিলাকেই একশ বার কান ধরে উঠবস করিয়েছিল আর মনিমালার মনে হয়েছিল 'উচিৎ শিক্ষা হইছে।'

তেমনি মনিমালার আপাত স্বাভাবিকত্বে ফিরে আসার পেছনে কাজ করেনি মর্মান্তিক সেই কারণটিও। বিচারে ছোট্ট রোহান সবইকে জানিয়েছিল সেদিন বসির মিয়ার ঘরে সে কি দেখেছিল। তবে, এতো কিছুর পরেও কাবিলা মনিমালাকে ফুলের টোকাও দেয়নি, উল্টো ধাইধাই করে ঘুষি চালিয়ে দিয়েছিল বসিরের নাকে।

ডাক্তারনি আপা জিজ্ঞেস করে- 'মনিমালা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন তো? আর ঘুম?'
মনিমালা রোগা বাছুরের মতো টঙ্গরবঙ্গর চোখে তাকায়। চোখ ঢুলুঢুলা। কিন্তু ঘুম আসে না। মনিমালার পিঠে ব্যথা। দূরে নার্গিসের একটা গান বাজে- 'কোপা সামসু কোপা। সামসু এখন জেলে কোপাবে তার ছেলে।'

কে হাসে বসির আর সাদেক, খালেকরা? বসিরের ঘরের আর সব সঙ্গীসাথীরা গাইল পারে, 'শালা নিটি পাগলির ভাতার। মার মার!'
ভীষণ ভয় পেলে মানুষ যেমন হাল ছেড়ে দিয়ে আলাভোলা হাসে তেমন মুখ করে থাকে মনিমালা। পেপারওয়েট ছুয়ে থাকে। টেবিলে বসে গাড়ি চালায়। পু- ভু-উ।
ডাক্তারনি বলে, 'বাহ বেশ ইমপ্রুভ করেছেন তো! ঠিকঠাক ওষুধ খান? আর রাতবিরাতে বেরিয়ে পড়েন না তো?'
কিছু বলে না মনিমালা; হাসে। তার সরু উঠানে এতো কাঠগোলাপ, মনেহয় সেই আগের মতো জিরাবোর গোলাপবাগান। কতো পদের গোলাপ। আর কী দিকবিদিক রোশনাই!

হলদে ছোপ সাদা থেকে রাতারাতি রং বদলে কাঠগোলাপ হয়ে যায় লাচিয়া সাদা। এই অলৌকিক পরিবর্তন অন্য কেউ দেখতে পায়নি। সহসা বোধি লাভের মতো শুধু মনিমালাই দেখে। কিন্তু যখন ভবন ধসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল নুলা হাত, থেতলানো মুখ, জামাকাপড়হীন জখম, তখন মনিমালা নিশ্চত হয়ে যায় এবার কাবিলা তাকে ঠিক দাগা দিয়েছে। সে ভুল ভেবেছিল। কাঠগোলাপ লাল হয়ে যাওয়া ছিল তার দুর্গতির পূর্বাভাস।

হালিমা যতোই বলে, সে আর কাবিলা ছিল ধসে যাওয়া ভবনের একই ফেক্টরিতে। তার সামন দিয়ে ছিটকে হারিয়ে গেছে কাবিলা; তবু বিশ্বাস হয় না মনির। জ্বালা ধরে গায়ে।
'হায় বুজি, তোর সওয়ামী রে আনতে পারলাম না… মোর আল্লা খোদা রে'– বলে হালিমা যতোই বিলাপ করে আর চোয়াল শক্ত হয় মনিমালার। ভাবে, 'শালি অন্যখানে বাড়ি নিছে'। কাবিলা নিশ্চয় ওখানে আছে লুকিয়ে। নাকি বড় দীঘি, বড় খোলাবাড়ি, খেড়ের পুঁজ, চৌচালা ঘরেই ফিরে গেল?
মনিমালার চোখের সামনে কাঠগোলাপ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সন্ধ্যাগুলো আরো সিন্দুরী লাল। পঁচা গলা লাশের গন্ধে মাইলের পর মাইল লোকালয় জুড়ে ভেদবমির মহামারি দেখা দেয়।

চার.

ভাগ্য নাকি ভ্রমর, কার গুনে বাঁচে মানুষ? কে মারে; মহুয়া নাকি মোহ? এক পায়ে সাদা পলেস্তারা লাগিয়ে দশ বাই আট ফুট ছাপড়া ঘরে শুয়ে শুয়ে তাই ভাবে বসির। কি দোষ ছিল তার? এই কথা ভাবতে গিয়ে খানিক হোঁচট খায় বসির। ভাবে, কিন্তু কি দোষ আছিল মনিমালার? ভাবে আর খালি হয়রান লাগে।

বিল্ডিং ধসের কয়েক দিন পর ভোরে যখন ছাপড়া ঘরের ফোকর দিয়ে একটা চড়–ই পাখি যুদ্ধবিমানের মতো কানচি মেরে বেরিয়ে যায়, আর টনটন ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে যখন খুব পেচ্ছাব পায় বসিরের, কিন্তু সে নড়াচড়া করতে পারে না; ঠিক তখনই সেই ছায়া মূর্তি আসে। বলে, 'বসির, ভাই আমার; কাবিলা কৈ? হেরে ফিরায়া আন। আমি জানি হেয় বিশ মাইল পালায়া আছে।'

বসির বোবা হয়ে যায়। মাথার পেছনে কে যেন টাটায়, চোখগুলো পাথরের মনে হয়। আরো পাথর তার শরীর, নিসঙ্গ; ঠোট। শুধু কাঁপে। দেখে, মনিমালা তার শাড়ি গুটিয়ে ছেদরে বসে পড়ে চৌকিতে। ঘুণ পোকারা ঘুইঘুই করে হাসে।

'এই নে লাল কাডালিগোলাপ। আমার সোয়ামিরে চোখে চোখে রাখবি? ক না হে কৈ?' বসির চুপ করে থাকে দেখে লোভ দেখায় মনিমালা। মিনতি করে- 'ভাই আমার ভাল লাগে না, ফুলে ঘিরান পাই না। কিরে মাছ খাবি, তোর বিলাই কৈ? হেরে কাটা খাওয়ামু আমি। দে না ভাই, মাইনষটারে খুঁইজা আইনা।'

রোহান জন্মের পর যে মনিমালার মাথাটা কেমন জানি আউলায়া যায়, সেই নারী অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে তাসের ঘরের মতো অতোবড় বিল্ডিংটা ধসে যাওয়ার পর।
মনিমালার তখন পাখির দশা। স্বাধীন। ডাক্তরনিকে বলে–'আমার এখন হাড় জুড়াইছে গো আপা! যে গেছে সে তো যাইতোই; অহন পালাইয়া আছে।'
কিন্তু প্রতিদিন ভোরে ঠিকই একটা ছায়ামূর্তি সেদিন বসির ঘরের ফোকর গলিয়ে ডেকে অনবরত ডাক দেয়–'বসির, এই বসিইরর‌্যা, মাছ খাবি? পুটি, খলকি? নাকি তুই ভেব্দা মাছ?'
হিহিহি।

চোয়ালের ব্যাথাটা কমলেও ভয়ে মাছ খেতে পারে না বসির। সাদেক-পাভেলরা আসে মাঝে মধ্যে। বলে, 'টাইম নাইরে, মেলা কাম।'
মাঝে মাঝে একটা বন রুটি নিয়ে রাতে ফিরে কখনো কখনো আকলিমাদের কাউকে আলগোছে ডেকে আনে। তখন সে কি ভুলভুলাইয়া। মনে হয় মনিমালাই আসছে। ভয়ে ঘর থেকে ছিটকে পড়ে বসির। পথে কনো মানুষ নাই, জন নাই, খালি জুনিপোকা; জ্বলে। কে মিটমিইট্টা কথা কয়? কে ডাকে গোলাপবাগানে?

সরু গলি ধরে পথে বেরিয়ে বোঝে এখনো রাত। ঠিক কয়টা বাজে এখন? অন্ধকারের বেশ-কমে নাকি নিজের বিভ্রমে পথের গাতাগাতি ঠাওর করে ছায়ায় ছায়ায় ছড়িয়ে পড়ে বসির। ওর পকেটে তখন কচকচে পাঁচ হাজার টাকা। ওর বাপ মদারু মতিন দিয়ে গেছে। বাকিটা হাপিস। ভবন ধসে মৃতদের জন্য বিশ আর আহতদের জন্য পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়েছে দয়ালুরা। বসির বিড়বিড় করে, 'হায়রে বাপ, তুই মোক জিন্দা অবস্থাত মারি দিলু?'

মতিনকে জিজ্ঞেস করে অফিসার- 'এইটা আপনার ছেলের লাশ; ঠিক তো? সাথে মোবাইল ছিল না?'
মতিন কান্নায় নুয়ে যেতে যেতে বলে, 'হয় বাহে, এইটা মোর বেটা বসির। মোপাইল পাবে কুনঠে? কয় টেকা দেয় মালিক?'
এই সব অদৃশ্য চোখে দেখে নিতে নিতে মোবাইলের আলোয় পথ দেখে সামনে পা বাড়ায় বসির। তবু খানান্দ বোঝা দায়। এরমেধ্যে সমনে একটা কাঁপা কাঁপা আলো দেখে সেদিকে এগুতে থাকে বসির।
আরে মনি বু, তুমি এইখানে, তোমার পোলা তো কান্দে!

বসিরের কথায় আর পা বাড়ায় না মনিমালা। সব হাসের বাচ্চা। শততুর! এক দালা থুতু কি ছিটিয়ে দিলো? মাথা থেকে কপাল বেয়ে ঢুকে যাচ্ছে চোখের ভেতরেও। থুথু এতো গরম হয়?
সহসা বসিরের মনে হয়, কে যেন শরীরে আঁচড় কাটে।
বিলাই?
পাথর শরীরের প্রলম্বিত হাতে টেনে নাকি ইচ্ছের জোরে ছাতার মতো চোখের পাপড়ি খুলে দেখে- 'রোহান!'

রোহন হাসে। বলে, 'মামু, তুমি এইহানে ক্যান? এইখানেই কি বিল্ডিং পরছে?'
কেমন মায়া করে বসিরের। আহা, বেচারা রোহান, কাবিলা যখন নেই বলে সবাই নিশ্চিত সেই দিন কোলের বাচ্চাটা ফেলে চলে গেল মনিমালা।
কাবিলা গজরায়–'অই নটির পুত, আলাভোলা পাইয়া ভুলাইয়া ভালাইয়া রুটি সেকো; খারা তোর কলিজা বাইর কইরা কুত্তা দিয়া খাওয়ামু!'

একটা কুকুর ভুকভুক করে বসিরকে দেখে, মনে হয় আজীব লাগছে। হাপরের মুখে কাচা লাল লোহার মতো বসিবের চোখগুলো গলে যেতে থাকে। কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পায়, আবারো চান্দির ফাটাটা দিয়ে রক্ত ঝরছে।
রোহান জিজ্ঞিস করে-' মামু, আমার বাবায় কৈ? হে নাকি মইরা গেছে?'

'নারে বাপ। এই যে আমি আছি না'– বলে ছোট্ট বাচ্চাটাকে হাতের নাগালে নিতে চায় বসির। বলে, 'তোর মা ফিরছে?'
কুকুরটা খুব ভুকভুক করছে দেখে সপাটে একটা লাথি ঠুকে দৌড়াতে দৌড়াতে রোহান গলা উঁচুতে তোলে–'মনে হয় হাসের বাচ্চা বিছরাইতে গেছে অই ঐ দিকে।'

দেখতে দেখতে চোখের পলকে কাঠগোলাপের গাছটাতে তরতর করে উঠে পড়ে রোহান। সেই দিকে তাকিয়ে বসির দেখতে পায় ওর মাথার লাল কাঠগোলাপ ওপরে পুরো আকাশটায় আগুন ঢালছে। আর সকালটা ভীষণ জ্বলছে আর জ্বলছে…