মায়েদের বাঁচাতে পারি না!

রাফে সাদনান আদেল
Published : 9 Sept 2019, 01:35 PM
Updated : 9 Sept 2019, 01:35 PM

নীলফামারীর সৈয়দপুরে অর্থাভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলেরচিকিৎসা করাতে না পারায় সাবিনা বেগম (৪৫) নামে এক নারী বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন।  সাবিনা বেগম উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের খামাতপাড়াএলাকার মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী।  সাবিনা বেগমেরছেলে সবুজ (২৫) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন থেকে শয্যাশায়ী।  অর্থাভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না পরিবারেরসদস্যরা।

এক সহকর্মী সংবাদটা আমাকে রেফার করে বললো, একটা 'কোট' দেবেন? সংবাদটা পরার পর মুখ দিয়ে রা করার মতো অবস্থাও আমার আর থাকলো না।  দিনের সবটুকু আলো হারিয়ে গেল নিমিষেই। নয় বছর আগে মায়ের ক্যান্সারের জন্য সর্বস্বান্ত হয়ে, খেয়ে না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার দিনগুলিতে ফিরে গেলাম আমি! তুমুল ব্যয়বহুল এই রোগের চিকিৎসা করা যে এই দেশের যেকোনো নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য কতটা কঠিন, তা ভাষায় বলে বোঝানো যাবে না।  এমনও সময় গিয়েছে যখন খুব অস্থির লাগতো, অসহায় হয়ে কত রাত শুধু বারান্দায় পায়চারি করে কাটিয়েছি তার হিসেব নেই। আমি এই মায়ের কষ্টটা যেন তিলে তিলে অনুভব করতে পারছি। এই কঠিন যুদ্ধে আমি আমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন ছুটে বেড়িয়েছে, লাজ-লজ্জা ভুলে হেন কোনো জায়গা নেই হাত পেতেছি।  আমার হতভাগা মা-ও আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট সয়ে যুদ্ধ করেছেন।  কখনো কখনো লজ্জায় তার চোখের ধারা বেয়ে শুধু গড়িয়েছে চোখের পানি, বুকে টেনে নিয়ে পাগলের মতো কান্না করেছি।  আমাদের আর কিই বা করার আছে?

আড়াই হাজার টাকার একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারও সেই সময়টায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসতো। এমনও হয়েছে, আইসিইউতে নিতে হবে দ্রুত, ফল করছে অক্সিজেন সেচুরেশান- আরো কত কি! গণ-অ্যাম্বুলেন্সকে দেওয়ার মতো আড়াইশ টাকাও নাই পকেটে, পাশে দাঁড়িয়েছেন আম্মার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. সুমন।  হাসপাতালের বিল ভরেছেন ডাক্তার নিজেই।  আমার মা অনেক সৌভাগ্যবান ছিলেন নিঃসন্দেহে।  আমার অনেক সহকর্মীরা পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমরা ফুটপাতের ডিম-তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছি ভাগাভাগি করে, আধপেটা হয়ে দৌড়ে বেড়িয়েছি একটু সহযোগিতার আশায় এখান থেকে সেখানে।  লম্বা সাড়ে তিনটা বছর, আম্মা যুদ্ধ করেছেন, আমরা যুদ্ধ করেছি সবাইকে সাথে নিয়ে।  

কিন্তু এই মায়ের কথাটা একবার ভাবুন তো। আমি ভাবতেই পারছি না। আমি লিখতেও পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, আমাকে আজকে অন্তত একবার চিৎকার করে কাঁদতে হবে।  সন্তানের একটু ব্যথা পেলে, একটু অসুস্থ হলে আমার মাথা কাজ করে না।  আমার সহধর্মীনি বলেন আমি নাকি উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাই সেসময়।  আমি মরে যাওয়া এই মায়ের মনে অবস্থা কল্পনাতেও আনতে পারি না।  কিন্তু এই সন্তানটি এখন কার মুখ দেখে বাঁচবেন আমাকে বলতে পারেন। কার মুখের দিকে চেয়ে ক্যান্সারের সাথে লড়বেন।  কোন অপরাধে সে আজ এতো বড় অপরাধী হয়ে গেল।  আমরাই বা কি করে মুখ দেখাবো তাকে! কোন অধিকারে তার পাশে দাঁড়াবো!  আমরা কি পারবো তার মাকে ফিরিয়ে দিতে।  ১৬ কোটি মানুষের দেশ একজন মায়ের কষ্টের বোঝাও হালকা করতে পারেন না।  এই লজ্জা কার কাছে গিয়ে বলবো?

আজকে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, বছর ঘুরলেই আমরা আমাদের দেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পালন করবো মহাসমারোহে।  কিন্তু আমার দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো আজো হিমশিম খাচ্ছে! অব্যবস্থাপনার বেড়াজাল থেকে তাদের মুক্তির কোনো আমাদের জানা নেই।  প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে যে ওষুধ পাবার কথা, আমাদের মত হতভাগাদের সেসব 'বিক্রির জন্য নহে' সিল দেয়া ওষুধ ঠিকই বিক্রি হচ্ছে পাশের ফার্মেসিতে।

শুধু ক্যান্সারকে ঘিরেই আমার যে কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে ঘোরার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার কোনোটিই সুখকর নয়।  মেনেই নিলাম সারাদেশের রোগীর চাপ সামলাতে তাদের জানপানি অবস্থা, কিন্তু যদি তাই হবে তবে সেখানকার তৃতীয় শ্রেণির একদল অসাধু কর্মচারিরা যারা বেসরকারি নামহীন ক্লিনিকের দালালি করছেন তাদের দেখার কী কেউ নেই?

না হয় আমরা এখনও ওয়েলফেয়ার স্টেইট নই, কিন্তু তাই বলে কি নূন্যতম কিছুটা চিকিৎসা সহায়তাও আমার প্রাপ্য নয়! উন্নয়নের জোয়ারে অন্তত গোটা ত্রিশেক গ্রুপ অব কোম্পানি তাদের বিত্ত বৈভবকে ছাড়িয়ে গেছেন ভাবনার থেকেও দূরে, তাদেরও কি এই সমাজটার প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা নেই?  তবে সিএসআর জাতীয় যে টার্মটা আমরা প্রায়ই শুনি তার কি কোনো কার্যকারিতা নেই! খুব উন্নত দেশ বাদই দিলাম, পাশে দেশ ভারতেও তো টাটার মতো কোম্পানিরাও দেশজুড়ে খুলে রেখেছেন হাসপাতালের চেইন, যার কয়েকটাতেই সরকারি মূল্যেই চিকিৎসা পাচ্ছেন তাদের দেশের নাগরিক।  ব্যবসার লভ্যাংশের একটা অংশ দিয়ে তারা নিরন্তর করে যাচ্ছেন নিজ দেশের মানুষের সেবা।

আর আমার দেশেও বড় বড় হাসপাতাল হচ্ছে, গড়ছে বড় বড় কোম্পানিও- কিন্তু সেটিও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই! পোড়াকপালি আমরা! দিন আনতে দিন ফুরায় এই আমাদের কোনো সঞ্চয় নাই, ক্যান্সারের মতো রোগের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই টানাপড়েন শুরু হয়!

ক্যান্সার নিয়ে লিখতে গেলে বিদিশা হয়ে যাই। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো সেটাই ভাবি। দেশি অনেক কোম্পানি ওষুধ বানাচ্ছে, তার মানটা নিয়ে ক্যান্সার স্পেশালিস্টরা নিজেরাই সন্দিহান। মায়ের চিকিৎসার সময় আর্জেন্টিনার একটা ওষুধ কিনতাম, একবার সেটা আর বাজারে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন দেশি একটা ব্র্যান্ডের ওষুধ ডাবল মাত্রায় কিনে আনার জন্য। আমি তো হতবাক, বললাম দ্বিগুণ কেন? তিনি জবাব দিলেন, দ্বিগুণ দিয়েও যদি একটার কাজ হয়! আমার কিছুই বলার ছিল না।

ক্যান্সার-টিউমার ফেলার জন্য চাই যুৎসই সার্জন। দেশের তাবত সার্জন র্নিদ্বিধায় ফেলে দেন ক্যান্সার-টিউমার। কোনো কোনো সময়ত তো তাদের সিরিয়াল পেতেও সচিবালয়ে দৌড়াতে হয় আমাদের। কিন্তু অনেক পরে হয়ত জানতে পারবেন, সার্জারির মার্কিং ভালো ছিল না।  টিউমার ঠিকই ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু ক্যান্সার-টিউমার ফেলার জন্য পড়াশোনার দৌড় না থাকায় তিনি সারফেসে ক্যান্সার জার্ম রেখেই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে ক্লান্তিমাখা মুখে অবলীলায় বলেছেন, 'অপারেশন সাকসেসফুল'! আমাদের তা শুনেই গদগদ থাকতে হয়।

এবার একটু বলি ক্যান্সারের চিকিৎসক হয়ে ওঠার আগ্রহের কথা। আমাদের দেশের তরুণ চিকিৎসকরা শুধু মেডিসিন, শিশু আর গাইনির ডাক্তার হতে চান। কাটতি ভালো। মাথা ভালো থাকলে তারা একটু সার্জারিতে যেতে চান। খুব কম লোকই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হতে চান। কারণ, রোগী নাই, অধিকাংশ সময় লাস্ট স্টেজে রোগীরা আসেন, বাঁচানো সম্ভব হয় না।  পুরোটা সময় হতাশা নিয়ে থাকতে হয়। তাদেরই বা দোষ কি? অনেক সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের আলাদা ডিপার্টমেন্টও নাই।  এখন অবশ্য তা অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনেক বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের রমরমা চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, দেশের অনেক বড় কোম্পানি ক্যান্সারের ওষুধ বানাচ্ছে, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাময় জীবন।

ক্যান্সার রোগীকে হাজারো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বাইরের দেশে অনেক হাসপাতালের বিশেষ গ্রুপ থাকেন যারা বাকি কাজটুকু আরামসে সারার জন্য এই অ্যাসিসটেন্ট গ্রুপগুলোকে তৈরি করেন।  হুম আমি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কথা বলছি। আমার দেশে কেমো শেষ হলে- 'এখন বাসায় যান আবার ২১ দিন পরে চলে আইসেন', ধরনের কথা বলে দেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। পরদিন থেকেই যে রোগীর তেরোটা অবস্থা সেটা দেখার জন্য কেউ নাই। রোগীর চিকিৎসক খানিকটা সময় পেলে তিনি বাকিটুকু সেড়ে দেন। ইদানিং তো বলতেও শুনি, সাইড ইফেক্টে পাতলা পায়খানা, বমি – যান মেডিসিনের ডাক্তার দেখান। কিন্তু এগুলো মোটেও স্বাভাবিক জ্বর-জারি, পেট খারাপ, কলেরা নয় এগুলো ক্যান্সার চিকিৎসা কোমো-রেডিয়েশনের সাইড ইফেক্ট।

প্রতিবছর লাখে লাখে মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছেন অনেকে।  আমাকে একটা ভালো ক্যান্সার সচেতনতার উদ্যোগের কথা কেউ বলতে পারেন? একটা ওয়েবসাইট, যেখানে থাকবে ক্যান্সারের আদ্যোপান্ত কিংবা একটা মাসিক ম্যাগাজিন? নাই। আমি ক্যান্সারবিডি ডট নেট নামে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেটাও ধুকধুক অবস্থা। এতোবড় দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের কোন এক কোণাতেও কি ক্যান্সারকে ঠাঁই দেয়া যায় না?

এমন হতাশার দায় আমি কারো কাঁধে চাপাতে চাই না।  আমিই অপরাধী। রাষ্ট্র নয়, সমাজ নয়, সাবিনা বেগমের প্রতিবেশী বা আপনজন কেউ নয়, অপরাধী আমি, আমরা। আমরা আমাদের মায়েদের বাঁচাতে পারি না, আমরা অক্ষম, আমরা নিকৃষ্ট সন্তান। আমাদের ক্ষমা করে দিন মা। আমাকে ক্ষমা করে দাও সবুজ।