মাতৃত্বকালীন ছুটি, জন্মহার এবং বিজিএমইএ

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 24 July 2012, 04:53 PM
Updated : 24 July 2012, 04:53 PM

মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়লে জন্মহারও নাকি বাড়বে, অন্যভাবে বলতে গেলে এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, জন্মহার কমানোর একটি অন্যতম বলিষ্ঠ উপায় হতে পারে মাতৃত্বকালীন ছুটি সংকোচন । জনসংখ্যা বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে এমন তত্ত্ব বা তথ্যের সাথে আমি এ যাবৎ কালে পরিচিত হতে পারিনি । জনসংখ্যা বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যে ডিটারমিনেন্টস অব ফার্টিলিটির সংজ্ঞায় কোথাও এ জাতীয় নির্দেশনা বা পরামর্শ আছে বলে আমার জানা নেই । ভাগ্যিস ম্যালথাস সাহেব স্বর্গবাসী হয়েছেন অনেক আগে নয়তো তিনি বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ধার করে হলেও এ বিষয়টি তাঁর থিওরীতে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন । একটি বহুল প্রচলিত দৈনিকে প্রথম পাতায় বড় হরফে এমনতর পরামর্শের খবরটি দেখে যারপরনাই আঁৎকে উঠেছি বৈকি।

খবরে প্রকাশ, শ্রম আইন সংশোধন বিষয়ক এক আলোচনা সভায় মাতৃত্বকালীন ছুটি কমানোর এই জ্ঞানগর্ভ পরামর্শটি দিয়েছে বাংলাদেশ তৈরি পোষাক রপ্তানীকারক সমিতি বা বিজিএমইএ।

অনেক বিচার বিবেচনা আলোচনা সমালোচনার পরে বাংলাদেশ সরকার ২৪ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি অনুমোদন করেছে এবং অন্যান্য আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এই ছুটি অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে নির্দেশ দিয়েছে যা প্রশংসার দাবি রাখে । আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, তবে কি সরকারের এই সিদ্ধান্ত জন্মহার বৃদ্ধিতে উৎসাহ যোগাচ্ছে এবং এটা কেন কোনভাবেই সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের গোচরে আসেনি ? বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা 'জনসংখ্যা' নিয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে তবে কি সরকার ব্যর্থ ?

সরকার যদি মনে করে দেশের সকল কর্মজীবি ও পেশাজীবি নারী ২৪ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করবে, তবে পোশাক শিল্পে নিয়োজিত নারী যারা দেশের জন্য সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে, তারা এই সুযোগ থেকে কেন বঞ্ছিত হবে ? সংবিধান অনুযায়ী সরকারের সকল আইন কানুন নীতি তো সকল নাগরিকের জন্য একই হওয়ার কথা ! আমি এবং আমার মত অনেক সুবিধাভোগী নারী যারা মাতৃত্বের স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করছি , এই আমরা কিন্তু একদিন এই খেটে খাওয়া অল্প শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত নারীদের উপার্জিত অর্থের একাংশ দিয়ে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে বড় সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে কর্মজীবন শুরু করে নিজের মাতৃত্বের স্বাদ আচ্ছাদন করার নিমিত্তে সর্বদা তৎপর আছি । আর সেই নারীরা যাদের দিয়ে সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছে এক শ্রেনী, যারা বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিনত করতে প্রানান্ত, যাদের উপার্জনে ঢাকা আজ তিলোত্তমা, যাদের টাকায় ঢাকায় এখন বিএমডব্লিও মার্সিডিজ চলে, তারা চাকরী-ওভার টাইম-মাতৃত্বকালীন উৎকন্ঠা জটিলতায় বিলিয়ে দিচ্ছে তাদের মাতৃত্ব—কি বিচিত্র—এবং পরম্পরায় তাদের দারিদ্র আর অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের ব্যবসা বাড়াবো, চকচকে বাড়ি আর গাড়িকে আরও চকচকে করবো, দেশ এগিয়ে যাবে আর আমরা সভা সেমিনারে অংক করে দেখিয়ে দিব আমরা আমাদের জন্মহার কমিয়েছি নাটকীয়ভাবে।

২৮ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়ার পেছনে যে জোড়ালো যুক্তি সর্বদাই উঠে এসছে তা হলো মা যেন ৬-মাস নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে পারে। এটা সন্তানের দেহ-মন গঠন ও বিকাশে জোড়ালো ভূমিকা রাখে বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত । আর এখন বাজারের যে ত্রাহি ত্রাহি দশা তাতে শিশুর জন্য বিকল্প খাবারের আয়োজন করতে একজন পোশাক শ্রমিক যদি তার সারা মাসের উপার্জনও দিয়ে দেয় তবু কুলাতে পারবে কি না সন্দেহ। মা যদি সন্তান হওয়ার সাথে সাথে পেটের টানে কাজে ফিরে যায় তবে তার অসহায় শিশু সন্তানটি কী খেয়ে বেঁচে থাকবে বলতে পারেন ? আপনারা যদি মায়ের কাছ থেকে শিশুকে এভাবে আলাদা করার জন্য উঠে পরে লাগেন তবে একটা কাজ করলে কেমন হয়—শ্রম আইনে এটা লিখে দেয়া যায় কিনা দেখুন— একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকার নীচে যাদের আয় তারা সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না—-ভালোই কিন্তু হয়——-জন্মহার তখন অনিবার্যভাবে গিয়ে দাঁড়াবে বিয়োগের কোঠায় ।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শ্রমনীতি নিয়ে আলোচনার টেবিলে বিজিএমইএ আরও অনেক দেশের উদাহরণ টেনে এনেছে। যুক্তির খাতিরে আমরা অনেক কিছুই বলতে পারি , কিন্তু যা সঠিক, যা মানবিক তাকেই তো গ্রহন করে সভ্যতা—-আমরা তো কোথাও না কোথাও অনুকরনীয়ও হতে পারি । তাছাড়া ঐ সকল দেশ পোশাক শ্রমিকদের জন্য এমন অনেক কিছুই করে যা আমরা কখনও করতে পারিনি—-আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নির্দেশ দেয়ার পরেও কি আমাদের শ্রমিকদের মজুরী কোন সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে ? এত সস্তা শ্রম পৃথিবীর আর কোন দেশে কি খুঁজে পাওয়া যায় ?

যারা বলছেন মাতৃত্বকালীন ছুটি কমাতে হবে তাদের বলছি—–আপনারা আপনাদের সন্তান জন্মগ্রহনের সময়কাল এবং এ সংক্রান্ত আয়োজনগুলো নিয়ে একটু ভাববেন কি ? কত আয়োজন কত স্বপ্নের মধ্য দিয়ে একটা শিশু পৃথিবীতে আসে। সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া , এ নিয়ে আবেগ উৎকন্ঠা, সন্তানকে বড় করে তোলার প্রক্রিয়া, সন্তানের জন্য মায়ের আবেগ ভালোবাসা এ সবই কিন্তু ধনী আর দরিদ্র সবার সমান । আয়ের উৎস ও পরিমাণ , মাতৃত্বকালীন ছুটির দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ দিয়ে মা আর সন্তানের চিরন্তন বন্ধনকে নানামুখী শ্রেনীতে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না এবং যারা করার চেষ্টা করবে তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই ।

হ্যাঁ , অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশে জন্মহারকে আরও কমাতে হবে । কিন্তু জন্মশাসন তো আর নদী শাসন না —এবং এটা গনচীনও নয় —এখানে স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নিষিদ্ধও নয় —তাই জন্মহারকে কমানোর জন্য নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, নারী তথা পুরুষকে সচেতন করণ, সমাজে নারীর নিরাপত্তা বিধান, মতামত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহ প্রদান এবং সেই সাথে নারী ও পুরুষের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা জন্ম নিয়ন্ত্রনের গ্রহণযোগ্য উপায় হিসেবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিহ্নিত হযে আসছে । মাতৃত্বকালীন ছুটি হ্রাস করা কখনোই জন্মহার নিয়ন্ত্রনের মানবিক উপায় হিসেবে আলোচনার টেবিলে আসতে পারে না। এটা নারীর মাতৃত্বের প্রতি উষ্মা প্রকাশ এবং প্রকারন্তরে নারীকে অপমানের শামিল।

একটা কথা মনে রাখতে হবে—শিশুরা জাতির ভবিষ্যত। এখানে কিন্তু কোথাও এটা বলা নেই যে—-পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিরদের শিশুরা ছাড়া অন্য শিশুরা জাতির ভবিষ্যত। একটা শিশু সে যে পরিবারে বা যে অবস্থায়ই জন্মাক না কেন সে কিন্তু জাতির ভবিষ্যৎ প্রতিনিধি হিসেবেই জন্মায়—-সুতরাং তার জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার দায়িত্ব কিন্তু শুধু তার পিতা মাতার নয়—সমাজের সকলের। সে তার পিতা মাতার সন্তান তো বটেই, সে কিন্তু সমাজ বা দেশেরও সন্তান। সামাজিক পিতৃত্ব তথা জাতীয় পিতৃত্ব অস্বীকার করে আপনি কি মনে করেন এই সমাজকে আপনি কুসুমাস্তীর্ন করতে পারবেন! নগর যখন পোড়ে দেবালয় কিন্তু এড়ায় না। নারীর নারীত্বকে, নারীর মাতৃত্বকে নারীর দুর্বলতা ভাবা নামান্তরে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। নারীকে সম্মান করুন, নারীর মাতৃত্বকে সম্মান করুন —জন্ম 'নিয়ন্ত্রন' নয় বরং জন্ম 'পরিকল্পনা'য় জাতিকে উদ্যোগী হতে আমরা আমাদের মেধা ও সম্পদকে আসুন কাজে লাগাই।

মাসুমা বিল্লাহ:গবেষক ও জনসংখ্যাবিদ।