মুসলিম উম্মাহ ও অপ্রতিহত মোদী

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 28 August 2019, 09:55 AM
Updated : 28 August 2019, 09:55 AM

০৫ আগস্ট ২০১৯- ভারতে মোদী সরকার কাশ্মীরে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করার পর থেকে পরমাণু বোমার দুই শক্তিধর পাক-ভারতের মধ্যে বিরাজমান টানটান উত্তেজনা। ভারত-চাণক্যের রাজনৈতিক দাবাখেলায় ধীরে ধীরে প্রকাশ হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের সাম্প্রদায়িক হিংস্র নখ দাঁত। তাঁর একাগ্র দুচোখ যে জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ ছাড়িয়ে সুদূর কোনো এক মঞ্জিলে নিবদ্ধ তা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয়না। রাজনীতির এই ভারত-ঘুঘু ইঁদুর বেড়াল খেলছেন বিশ্ব-দরবারে কোণঠাসা পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে, সেটাই স্বাভাবিক। ইমরান খান প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন ও দেশবাসীকে আশার বাণী শোনাচ্ছেন, সেটাও স্বাভাবিক। ভয়াবহ অস্বাভাবিক যেটা তা হল যা দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে ও পাক-ভারত বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মওলানাদের গর্বিত উচ্চারণে হাজার বার শুনেছি:-

"আবূ নুঁআয়ম (রাঃ) নুমান ইবনু বশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তুমি মু'মিনদের পারস্পরিক দয়া ভালবাসা ও সহানূভূতি প্রদর্শনে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। যখন দেহের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশগ্রহণ করে" – সহি বুখারী হাদিস ৫৫৮৬ ও অন্যান্য হাদিস কেতাব।

এই হাদিসের সাথে বাস্তব মিলছে না। পাকিস্তানের সাথে ভারত-ঘুঘু যে ইঁদুর বেড়াল খেলছে তার অন্যতম শক্তি মুসলিম দেশগুলোই। লোহার কুড়ুলটা অন্য কাঠকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে কাঠের হাতলটার সাহায্য পায় বলেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সর্বোচ্চ সম্মান/পুরস্কার দিয়েছে কারা?  

  • ১. "অর্ডার অফ আব্দুল আজিজ আল সৌদ" – সৌদি আরব,
  • ২. গাজী আমীর আমাউল্লাহ খান অ্যাওয়ার্ড – আফগানিস্তান,
  • ৩. গ্র্যান্ড কলার অফ দি স্টেট অফ প্যালেস্টাইন,
  • ৪. "জায়েদ অর্ডার" – আরব আমিরাত (এতে খুব গোসসা হয়ে আমিরাত সফর বাতিল করেছেন পাকিস্তান সিনেট চেয়ারম্যান সাদিক সাঞ্জরানি),
  • ৫. "দ্য কিং হামাদ অর্ডার অব দ্য রেনেসাঁ" – বাহরাইন,
  • ৬. "নিশান ইজউদ্দীন" – মালদ্বীপ।

এ ছাড়াও মোদী পেয়েছেন :

  • ৭. রাষ্ট্রসংঘের "চ্যাম্পিয়ন্স অফ আর্থ",
  • ৮. "অর্ডার অব সেন্ট এন্ড্রু" – রাশিয়া, 
  • ৯. সিওল শান্তি পুরস্কার – দক্ষিণ কোরিয়া,  
  • ১০. লণ্ডনের বিখ্যাত মাদাম তুসো মোম জাদুঘরে মোদীর মোমের মূর্তি।

এই বিপুল শক্তির সামনে কি শক্তি নিয়ে দাঁড়াচ্ছে পাকিস্তান? দাঁড়াচ্ছে "গাজোয়া-এ হিন্দ" হাদিসের শক্তিতে। নবীজী'র (স) উপস্থিতিতে যে জিহাদ তাকে গাজোয়া বলে। দেশের মওলানারা উত্তেজিতভাবে এই হাদিস জাতিকে শোনাচ্ছেন, জাতি তা বিশ্বাসও করছে এমনকি পাক আর্মির ওয়েবসাইটেও এ হাদিস উজ্জ্বলভাবে ধরা আছে। এ হাদিস আছে প্রায় আধা ডজন, একটি আছে সহি হাদিস নাসাঈতে যা সহি সিত্তার অর্থাৎ "সত্য ছয়"-এর অন্যতম (সহি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ)। হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে, তবে সবগুলোর সারসংক্ষেপে ভারতের ব্যাপারে মোটামুটি এই দাঁড়ায়, – জেরুজালেম থেকে মুসলিমেরা এসে হিন্দুস্তান আক্রমণ করে জয় করবে, হিন্দু রাজাদেরকে শেকলে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবে, বিজয়ী মুসলিমেরা জান্নাতী হবে।

এই হাদিসের জোশে টগবগ করে ফুটছে পাকিস্তানি জাতি আর তার আর্মি। ওখানে কারো বলার হিম্মত নেই, কেউ খতিয়েও দেখছে না হাদিসটা কেন অবাস্তব। প্রবল ক্ষমতাশালী ইসরাইলের রাজধানী জেরুজালেম দখল করে সেখান থেকে ভারত আক্রমণ করার সাধ্য মুসলিম বিশ্বের নেই, কিংবা ভারতে এখন কোনো রাজা নেই যাকে মুসলিমেরা "শেকলে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবে"। অথচ "গাজোয়া-এ হিন্দ"- এর ভারত-বিজয়ের জোশ তাদের মন-মগজ গ্রাস করে রেখেছে। এভাবেই ইসলামের নামে আমরা অবাস্তব জগতে বাস করি, অলীক পরশপাথর খুঁজে বেড়াই। 

মুসলিম উম্মাহ'র ভাতৃত্ব শুধু বর্তমানেই ব্যর্থ হয়নি। ইমাম আবু হানিফাকে কারাগারে প্রহার করে হাড় ভেঙে বিষ দিয়ে খুন করেছিল খলীফা আল মনসুর। ইমাম তাইমিয়াকে দামেস্কের কারাগারে খুন করেছিল খলীফা, ইমাম হাম্বলকে কারাগারে অমানুষিক প্রহার করা হয়েছিল, ইমাম মালিকের হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল মদীনার শাসক, ইমাম শাফি'কে খুন করেছিল ইমাম মালিকের অনুসারী ফিতিয়ান (ইমাম মালিকের নির্দেশে নয়), লোকচক্ষুর অন্তরালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন নির্বাসনদণ্ডে দণ্ডিত ইমাম বোখারি, দু'হাত তুলে হাহাকার করতেন ইসলামের যুগশ্রেষ্ঠ এই ইমাম:- "হে আল্লাহ! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও− এ দুনিয়া আমার জন্য ছোট হয়ে গেছে"।

মুসলিমের হাতে মুসলিমের রক্তের বন্যায় স্তব্ধ হয়ে আছে ইতিহাস। আমরা শুধু যুদ্ধের কথাই পড়ি কিন্তু খেয়াল করি না সেইসব কোটি-কোটি মৃতদেহ এবং সেই সাথে কোটি-কোটি আহতের আর্তনাদ, উজাড় বসতি ও বিধবা-এতিমের হাহাকার। খেয়াল করুন, এ তালিকা কিন্তু শুধুমাত্র মুসলিমের সাথে মুসলিমের যুদ্ধের। সূত্রভেদে বিভিন্ন দলিলে নাম, জায়গা ও সালের কিছু পার্থক্য দেখা যায়।

সাল

  • ৬৬১ − হজরত আলী নিহত − সিরিয়ার শাসক মাবিয়া উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা,
  • ৬৮০ − মাবিয়ার মৃত্যু, এজিদ খলিফা হল − কারবালায় নবীজীর প্রিয় নাতি হযরত হোসেন (র) সহ পরিবারের অনেকে নিহত,
  • ৬৮৪ − মক্কায় আবদুলা বিন জুবায়ের-এর খলিফা হবার ঘোষণা, র্মাজ রাহাত-এর যুদ্ধ,
  • ৬৮৭−৬৯২ − কুফায় মুখতার নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলে মক্কায় জুবায়ের, কুফায় মুখতার ও সিরিয়ায় এজিদের বংশধর আবদুল মালিক, একসাথে এই তিন খেলাফতের উদ্ভব ও রক্তাক্ত যুদ্ধে মুখতার ও জুবায়ের নিহত। আবদুল মালিকের সেনাপতি হিসাবে ইতিহাসের কুখ্যাত নৃশংস হত্যাকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ক্রমাগত গণহত্যা। সাহাবীসহ লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে সে খুন করেছে,
  • ৬৯৫ − জাজিরা, আহয়াজ ও কারুন-এর তিনটে যুদ্ধ,
  • ৭০২ − ইরাকে আশাথ বিদ্রোহ, দায়রুল জামিরা'র যুদ্ধ,
  • ৭০২ থেকে ৭৩৭ পর্যন্ত মুসলিম সৈন্যদের বহু দেশ জয় ও ফ্রান্সের সীমানায় পরাজয় − আবার মুসলিমের গৃহযুদ্ধ শুরু,
  • ৭৪০ − (ক) ইরাবে শিয়া বিদ্রোহ। (খ) উত্তর আফ্রিকায় বারবার বিদ্রোহ,
  • ৭৪৩ − খোরাসানে শিয়া বিদ্রোহ,
  • ৭৪৪ − বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থানে খলিফা ২য় ওয়ালিদ নিহত,
  • ৭৪৫ − খোরাসানে আবার শিয়া বিদ্রোহ − খারাজী দ্বারা কুয়া ও মসুল দখল,
  • ৭৪৬ − খোরাসানে আবু মুসলিমের বিদ্রোহ,
  • ৭৪৯ − ইস্পাহান ও নিহাওয়ান্দ-এর যুদ্ধ,
  • ৭৫০ − (ক) আব্বাসীয়দের দ্বারা রক্তাক্ত গণহত্যায় উমাইয়া খেলাফতের অবসান। (খ) যাব-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ,
  • ৭৫৫ − খোরাসানে আবার বিদ্রোহ,
  • ৭৬২ − ইব্রাহিম ও নাফউজ জাকিয়া-র নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ,
  • ৭৬৭ − সিজিলমাসায় খারেজী শাসনের শুরু,
  • ৭৭২ − উত্তর আফ্রিকায় জানবির যুদ্ধ, মরক্কোতে বিদ্রোহী রুস্তমিদ খেলাফত শুরু,
  • ৭৮৮ − মগরেব-এ ইদ্রিসিদ খেলাফত শুরু,
  • ৭৯৯ − খাজারদের বিদ্রোহ দমন,
  • ৮০০ − উত্তর আফ্রিকায় আঘলাবিদ খেলাফত শুরু,
  • ৮০৩ − ইমাম জাফর বারমকির খুন,
  • ৮১৪ − খলিফা হারুন রশীদের মৃত্যুতে দুই পুত্র আল্ আমিন ও আল্ মামুনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। আল্ আমিন নিহত,
  • ৮১৫ − ইবনে তুবার নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ − কয়েকবছর যুদ্ধের পর সেনাপতি হুরমুজান নিহত,
  • ৮২০ − খোরাসান-এ তাহিরিদ খেলাফত শুরু,
  • ৮২৭ − মুতাজিলাদের সাথে অন্যান্যদের বিরোধ শুরু,
  • ৮৩৭ − জাট (ভারতের নয়) বিদ্রোহ,
  • ৮৩৮ − আজারবাইজান-এ বাবেক বিদ্রোহ দমন,
  • ৮৪৩ − তাবারিস্তান-এ মাজাইর বিদ্রোহ,
  • ৮৬১ − বিদ্রোহী অভ্যুত্থানে খলিফা মুতাওয়াক্কিল নিহত,
  • ৮৬৪ − তাবারিস্তান-এ যায়দি খেলাফত শুরু,
  • ৮৬৬ − খলিফা মুতাসিম বিতাড়িত − নতুন খলিফা মুতা'জ,
  • ৮৬৭ − সিস্তান-এ সাফারিদ খেলাফত শুরু,
  • ৮৬৮ − মিশরে তুলুনিদ খেলাফত শুরু,
  • ৮৬৯ − খলিফা মুতা'জ বিতাড়িত − নতুন খলিফা দাসী-পুত্র আল্ মুহতাদি,
  • ৮৭০ − তুর্কী বিদ্রোহে আল্ মুহতাদি নিহত − নতুন খলিফা আল্ মুতামিদ,
  • ৮৭৩ − রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তাহিরিদ খেলাফতের উচ্ছেদ,
  • ৮৭৪ − দক্ষিণ ইরাকে জাঞ্জ বিদ্রোহ,
  • ৮৯১ − কেন্দ্রীয় খেলাফত অস্বীকার করে বাহরায়েন-এ কামাতিয়ান শাসনে উদ্ভব,
  • ৮৯৭ − কামাতিয়ান দ্বারা বসরায় গণহত্যায়,
  • ৯০৫ − মসুল ও জাজিরা-য় হামদানিদ খেলাফত শুরু − মিশরে তুলুনিদ খেলাফতের উচ্ছেদ,
  • ৯০৮ − সামানিদ খেলাফত দ্বারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাফারিদ খেলাফতের অবসান….

অনেক লম্বা হয়ে গেল, এখানেই থামি।

মুসলিমের ওপরে মুসলিমের গণহত্যা একাত্তরেও শেষ হয়নি। এখনো সৌদি আক্রমণে মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের শিকার ইয়েমেনের কোটি কোটি মুসলিম। আর তাদের জন্য দুনিয়ার কাছে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে দুনিয়ার অনেক অমুসলিম মানবিক সংগঠন, দানও করছেন বহু উদার অমুসলিম।