আমাদের মঞ্চনাটকের ভেতরে বাইরে

আনিসুর রহমান
Published : 25 August 2019, 05:46 AM
Updated : 25 August 2019, 05:46 AM

কোরবানির ঈদের আগে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে বেশ কয়েকটি মঞ্চনাটক দেখার সুযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার আর অভিনয় বিদ্যা বিভাগ প্রযোজিত নাটমণ্ডলে মঞ্চস্থ নাটক 'অপরেরা' এবং শিল্পকলা একাডেমিতে 'আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে'।

প্রথম নাটকটি ইউরোপীয় তিন নাট্যকারের ছয়টি নাটকের অংশ নিয়ে সাজানো। এই সাজানোর কাজটি করেছেন নাট্যকলার শিক্ষক শাহমান মৈশান। সুইডিশ নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের 'দ্য ফাদার' ও 'মিস জুলি', রাশিয়ান নাট্যকার আন্তন চেখভের 'থ্রি সিস্টার' ও 'দ্য সিগাল' এবং নরওয়ের নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের 'আ ডলস হাউস' ও 'দ্য লেডি ফ্রম দ্য সি' নাটকের ছোট ছোট অংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে নাটকটি। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন একই বিভাগের শিক্ষক আশিক রহমান লিয়ন। পুরো নাটকটিতে উঠে এসেছে পারিবারিক সম্পর্কের- বিশেষ করে দাম্পত্য বোঝাপড়ার সঙ্কটগুলোর বিবিধ রূপ। চমৎকার উপস্থাপনা। এতে অভিনয় করেছেন একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা।

'আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে' হিন্দিভাষার নাটকটি মোহন রাকেশের রচনা। এটি বাংলায় অনুবাদ করছেন অংশুমান ভৌমিক। নাটকটি মহাকবি কালিদাসের জীবনী অবলম্বনে লেখা। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন অলোক বসু। প্রযোজনা করেছে নবগঠিত নাটকের দল 'থিয়েটার ফ্যাক্টরি'।

দুটো প্রযোজনাই আমার ভাল লেগেছে। তবে অবাক হলাম নাটকের বাইরের নাটকের মুখোমুখি হয়ে।

নাটক দুটোর মঞ্চায়ন শেষে বিশিষ্টজনদের বক্তৃতা দেবার পালা। আমার মত আমদর্শক টাকা দিয়ে টিকেট কেটে তো বক্তৃতা শুনতে যাইনি। আমি গেছি নাটক দেখতে। বিশিষ্টজনদের যদি নাটক সম্পর্কে কিছু বলার থাকে তারা পত্রিকায় লিখবেন। এটাইতো আধুনিক রীতি। কিন্তু সেদিকটায় না গিয়ে বিশিষ্টজনদের বিশিষ্ট বয়ান দর্শকদের শ্রবণশক্তির উপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য কী? বিশিষ্টজনদের খুশি করা? নাটমণ্ডলের নাটক শেষে যাদের বক্তৃতা করার জন্যে আহবান করা হলো তাদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের এক শীর্ষ ব্যক্তি।

নাটক প্রদর্শনী শেষে নাট্যকার, নির্দেশক আর কুশীলবরা দর্শকের মুখোমুখি হন। এরকম রেওয়াজ অনেক দেশেই আছে। কিন্তু আমাদের দেশে নাটকের উপর যেভাবে মোড়লতোষণের আড়ালে খুৎবা চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে তা নিতান্তই দৃষ্টিকটূ। এমনকি দিল্লির জাতীয় নাট্যবিদ্যালয়ের নাট্যপ্রদর্শনীর পরের দিন নাট্যকার নির্দেশক আর কুশীলবরা দর্শক শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। চমৎকার!

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কর্তা মহোদয়ের কাছ থেকে আমরা একটা জিনিস জানলাম, এ বছরের প্রথম সাত মাসে মোটের উপর এক ডজনের মত নতুন প্রযোজনা মঞ্চে এসেছে। এই খবরে আমরা কি খুশি হব? না চিন্তিত হব? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি আমাদের মঞ্চনাটকের অবকাঠামো নিয়ে আমার একটা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই।

প্রায় দুই কোটি লোকের ঢাকা শহরে নাটকের জন্য কার্যকর মোটের উপর মঞ্চ পাঁচ কি ছয়টি। আর জেলা শহরে শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে নাটক পরিবেশনের জন্যে আধুনিক সুযোগ সুবিধার বড়ই আকাল। ষোল কোটি মানুষের দেশে সাত মাসে নতুন নাটক এক ডজন। এই খবরে আমাদের আহ্লাদিত হবার কারণ নাই।

এরকম অবস্থায় বর্তমান ভূমিকায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের গদগদ হবার হেতু কী? ফেডারেশনের শুরুতে যে ভূমিকা ছিল স্বাধীনতা পঞ্চাশ বছরে অবশ্যই এর খোলনলচে পাল্টানোর সময় এসেছে। মঞ্চনাটকের আমূল ব্যবস্থার পরিবর্তন, সংস্কার আর উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক কার্যকর প্রস্তাবনা থাকা দরকার। এই সময়ে এসে সরকারের বাজেট সংকট- এরকম কোন অজুহাত থাকার কথা নয়। সরকার নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে মঞ্চনাটকের জন্যে নিয়মিত প্রণোদনা, নাটকের কুশীলবদের জন্যে নিয়মিত সম্মানী বা বেতন, তরুণদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, বিদেশের উৎসবে অংশ নেবার নিমিত্তে নাট্যপ্রযোজনার জন্যে ভ্রমণ বৃত্তির ব্যবস্থা আর প্রয়োজনীয় নাটকের মঞ্চ নির্মাণের অর্থ সহজেই বরাদ্দ করতে পারে। একই সঙ্গে নাটক বিনামূল্যে নাট্যমঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা দরকার। লিল্লাহ বোর্ডিং বা তাবলিগি ব্যবস্থায় আর যাই হোক আধুনিক নাটকের বিকাশ বা উন্নয়ন কোনটাই সম্ভব না। এতে বরং ঠিকাদার কর্পোরেটগোষ্ঠীর উচ্ছিষ্টভোগীদের একচেটিয়া খবরদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই থেকে যাবে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হর্তাকর্তা মোটের উপর নাটকের এক ডজন মোড়ল। অথচ খোদ নাটকের অঙ্গনটা অবহেলিত, নিগৃহীত আর দিশেহারা। এইসব ডজনখানেক নাট্যজন, নাট্যব্যক্তিত্বের কেউ কেউ নাট্যজননী, মঞ্চকুসুম, মঞ্চসারথী, ঋত্বিক নাট্যজন, সরৈষর্য, নাটকের সুবর্ণপুত্র, শিশুবন্ধুনাট্যজন- এরকম যত বাহারি উপাধিতে ভূষিত। তার বিপরীতে নাটকের অবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা।

অন্যদিকে যাত্রাশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। ঢাকা শহরের মত বড় বড় শহরে যাত্রাশিল্পের জন্য স্বতন্ত্র এবং স্থায়ী মঞ্চ এখনও কেন নির্মাণ করা হল না? যাত্রা শিল্পকে বাঁচানোর জন্যে কার্যকর ও লাগসই তেমন কোন উদ্যোগ এখনও কেন দৃশ্যমান নয়?

স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে নিচের তিনটি অঙ্গন ঘিরে অনেক সফলতার গল্প আমরা শুনি: পোশাকশিল্প, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আর থিয়েটার। পোশাকশিল্পের মালিকদের সাফল্য ও রমরমা অবস্থা দেশের জমিন আর সীমানা ডিঙিয়ে বিদেশে প্রসারিত হয়েছে। এমন কি কারও কারও রমরমা সুইস ব্যাংক পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। অন্যদিকে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অনেকে ভোগে মজুরিবঞ্চনা আর পুষ্টিহীনতায়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কোন কোনটা শেষতক কর্পোরেট শোষকে উন্নীত হয়েছে।

আর এর সমান্তরালে আমাদের নাটকের মোড়লরা হয়েছে টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপন ব্যবসার জুতসই ঠিকাদার। এই লেখায় পোশাকশিল্প আর উন্নয়ন সংস্থা নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাব না। এবার আমাদের 'নাট্যজন বা নাট্যব্যক্তিত্ব' পদবাচ্য নিয়ে দুই একটি কথা বলতে চাই।

আমাদের মঞ্চের এক সময়ের দাপুটে কুশীলব, এখন তেমন আর অভিনয়ও করেন না, নির্দেশনাও দেন না, লিখতেও আর পারেন না, তাদের জন্যে বিশেষ পদবাচ্য- 'নাট্যজন', 'নাট্যব্যক্তিত্ব'। আসলে এ ধরনের শব্দের কোন মানে নির্ধারণ করাই দুঃসাধ্য। আদতে এই শব্দের আবরণে আমাদের দাদার বয়সী বিশিষ্টজনেরা নিজেদের প্রভাব খাাঁটিয়ে আড়ালে করে যান ঠিকাদারি। কিন্তু ঠিকাদার পরিচয়ে তো আর জাতে উঠা যায় না। তাই তারা 'নাট্যজন' আর 'নাট্যব্যক্তিত্ব'। আহা! কী উদ্ভট শব্দচয়নলোভী।

এরকম প্রবণতা ধরে যদি চোরের দল ব্যবহার করা শুরু করে- 'চৌর্যজন', 'চৌর্যব্যক্তিত্ব' কিংবা ডাকাতের দল – 'দস্যুজন', 'দস্যুব্যক্তিত্ব' অথবা পণ্ডিতের দল- 'পণ্ডিতজন', 'পণ্ডিতব্যক্তিত্ব'-কেমন শোনায়? এক উদ্ভট অভিজাত্যের মোহ আমাদের নাটকের বয়োজ্যোষ্ঠ মোড়লদের।

নাটকের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। চতুর্থ শতাব্দীতে উৎপত্তি লাভ করা সংস্কৃত নাটকের উত্তরাধিকার বহন করা আজকের বাংলা নাটকের কী হাল? ষোল কোটি মানুষের দেশে বার মাসে বারটিও নতুন মৌলিক নাটক মঞ্চে আসে না। নতুন প্রযোজিত নাটকের প্রায় পুরোটাই অনুবাদনির্ভর। তাও আবার পশ্চিমের ইংরেজি আর ইউরোপীয় ভাষার নাটকের একচেটিয়া আধিপত্য!

যেভাবে অন্যান্য দেশের থিয়েটারগুলোর মাঝে প্রতিবছর নাটকের মৌসুমে অলিখিত প্রতিযোগিতা থাকে- কোন থিয়োটার নতুন মৌসুমে কোন নতুন নাট্যকার, নতুন মৌলিক নাটক, নতুন নির্দেশক আর নতুন কুশীলব উপহার দিল। আর আমরা পড়ে আছি দাদা দাদীর মৃত্যুর আগে সহস্রতম আখেরি অভিনয় দেখার জন্য। নতুনদের দাঁড়াবার জায়গাটা কোথায়?

এর বিপরীতে বাংলা একাডেমি নাটক বিভাগে পুরস্কার দেবার জন্যে নাট্যকার খুঁজে পায় না।

আর একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে লেখাটি শেষ করছি। ২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সারাদেশের উপজেলা সদরে পাঁচশ'র মতো যুবকমপ্লেক্স স্থাপনের কথা বলা আছে। প্রতিটি কমপ্লেক্সে একটি করে স্থায়ী নাট্যমঞ্চের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখনই আলোচনা শুরু করা দরকার। পশ্চিমা কল্যাণরাষ্ট্র, পাশের ভারত আর নিকটের দক্ষিণ কোরিয়ার থিয়েটারের হাল হকিকতও প্রসঙ্গক্রমে আমরা ঝালিয়ে নিতে পারি। আমাদের কর্মপন্থা ঠিক করার নিমিত্তে। এখনই সময়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর তো হয়েই গেল!