এইডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ : পোলিও নির্মূল কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা হতে পারে দিশারী

বুশরা জেরিন ইসলাম
Published : 4 August 2019, 08:47 AM
Updated : 4 August 2019, 08:47 AM

ডেঙ্গু নিয়ে পুরো দেশে যখন তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে সেই সময় পোলিও নির্মূলে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে কথা বললে ব্যাপারটা অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীতের মত হয়ে যাবে। তবে জনস্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে আমাদের কাজের একটি মূলমন্ত্র হল– Prevention is better than cure–  রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা উত্তম। আজকের অবস্থায় আসার আগেই যদি ডেঙ্গুকে প্রতিরোধ করা যেত তাহলে এইডিস মশা আজ এই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে  পারতো না।

বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সাফল্য শুধুমাত্র টিকাদানেই সীমাবদ্ধ না, পোলিওর মত সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্যও কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। যদিও পোলিওর কার্যকর টিকা রয়েছে, কিন্তু কোনো শিশু টিকাদানের আওতায় না আসতে পারলে আর তার আশেপাশে কোনো নতুন পোলিও রোগী থাকলে টিকা না পাওয়া শিশুটির পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। তখন টিকাদানের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা যেন সংক্রামক রোগ আর না ছড়াতে পারে। এটা যে কোন সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, ডেঙ্গুর জন্য আরো বেশি প্রযোজ্য কারণ, ডেঙ্গুর কোন কার্যকর প্রতিষেধক এই মূহুর্তে আমজনতার জন্য সহজলভ্য না। এবং এটি একটি মশাবাহিত সংক্রামক রোগ। বাংলাদেশ এর আগেও সাফল্যের সাথে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি যেহেতু প্রতিরোধ করেছে, সেসব পন্থায় পরিকল্পনামাফিক এখন থেকেই কাজ শুরু করলে ২০১৯ এর ডেঙ্গু চিত্র আর হয়তো ফেরত আসবে না।

সম্প্রতি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা কর্পোরেশনের সফল কিছু পন্থার কথা ঊঠে এসেছে। মজার বিষয় হল, বাংলাদেশে পোলিও নির্মূল কার্যক্রমে ব্যবহৃত পন্থার সাথে বেশ সাদৃশ্য রয়েছে ওপার বাংলার কার্যক্রমের। যেহেতু পোলিও আর ডেঙ্গু দুটাই সংক্রামক ব্যাধি, নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে এমন সাযুজ্য থাকাটাই স্বাভাবিক। আশার কথা হল, বাংলাদেশ সরকারের এই পোলিও নির্মূলের অবকাঠামো ও দক্ষ লোকবল এখনো বিদ্যমান যা পোলিও-পরবর্তী সময়ে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত Polio Transition Plan Bangladesh এ এই বিদ্যমান অবকাঠামোর কথা উঠে এসেছে। এর সাথে বাংলাদেশের পোলিও নির্মূল কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্পাদিত ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের একটি গবেষণার থেকেও এ সম্পর্কে তথ্য এসেছে।

বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত "ডেঙ্গু দমনে ঢাকা যখন ব্যর্থ তখন কলকাতা কীভাবে সফল " রিপোর্টে বলা হয় কিভাবে গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল বছরজুড়ে কয়েকস্তরের নজরদারি বা সার্ভেইল্যান্স (Surveillance)। কলকাতার ডেপুটি মেয়র ও স্বাস্থ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ জানান কিভাবে তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে একদল প্রচারণার কাজ করেন আরেকদল কোথাও পানি জমেছে কিনা তার উপর খেয়াল রাখেন। এছাড়া রয়েছে র‍্যাপিড অ্যাকশান টিম, যাদের কাছে সরঞ্জাম আর গাড়িও থাকে। কোথাও ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে তারা দ্রুত সেখানে দিয়ে এইডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের ব্যাবস্থা করে। বাংলাদেশে কিন্তু ১৯৯৫ সাল থেকে পোলিও নির্মূল কার্যক্রমের সাথে জড়িত আছে স্বেচ্ছাসেবকদের নেটওয়ার্ক যাদের বলা হয় key informant network। এরা টিকা দিতেন, পোলিও টিকার প্রচারণা করতেন এমনকি পোলিও সারভেইল্যান্স বা নজরদারির জন্য কাজ করতেন। ১৫ বছরের কম বয়সী কেউ হঠাৎ করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে এই স্বেচ্ছাসেবকেরা অতিসত্ত্বর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার Surveillance Medical Officer (SMO) কে জানাতেন। Transition Plan এ এদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে Asset বা সম্পদ হিসেবে, যারা পরবর্তীতে অন্যান্য রোগের জন্য নজরদারিতে কাজ করতে সক্ষম। বর্তমান ডেঙ্গুর প্রেক্ষাপটে আমাদের এই স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক কলকাতার মতই কাজ করতে পারে। শুধু প্রয়োজন পরিকল্পনা মাফিক তাদের ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রশিক্ষিত করে তাদের হাতে ঢাল-তলোয়ার তুলে দেয়া।

কলকাতার বেসরকারি ল্যাবরেটরি আর হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তদের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই কর্পোরেশনের প্রত্যেক ওয়ার্ডে একজন করে কর্মী খাতা নিয়ে চলে আসতেন এসব ল্যাব বা হাসপাতালে। "কত রোগীর রক্ত পরীক্ষা হলো, কী কী পরীক্ষা হলো, পরীক্ষার ফল কী, সেগুলো নোট করে আনবেন তারা। সঙ্গে সঙ্গেই সেই তথ্য অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌঁছিয়ে যায় বরো ভিত্তিক মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ টীমের কাছে।"  অতীন ঘোষ এর বর্ণনার এই টিমের মত বাংলাদেশ সরকার, ইপিআই আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হাত মিলিয়ে এই রকম সার্ভেইল্যান্স বা নজরদারির কাজ করে আসছে ১৯৯৭ থেকে। Surveillance Medical Officer (SMO) নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছিল পোলিওর উপর নজরদারির জন্য। SMO রা তাদের নির্দিষ্ট এলাকার হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিতেন ১৫ বছেরের কম বয়সী কারো হাত বা পা হঠাৎ করে থলথলেরকম পক্ষাঘাতগ্রস্ত (Acute Flaccid Paralysis- AFP) হয়েছে কি না। কোনো জায়গায় সন্দেহজনক পোলিও রোগী পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট SMO নিজে তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ছুটে যেতেন। সেই রোগীর মলের নমুনা নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠাতে হত পোলিওর পরীক্ষার জন্য। পোলিও রোগী পাওয়া গেলে তার আশেপাশের ০-৫ বছর বয়সী সব বাচ্চাকে পোলিও টিকা খাইয়ে দেয়া হত (Mop-up campaign) যেন পোলিও আর না ছড়াতে পারে। ঠিক একইভাবে আজ কলকাতার র‍্যাপিড অ্যাকশান টিম ডেঙ্গু রোগীর চারপাশে এইডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কাজ করে যেন ডেঙ্গু আর না ছড়াতে পারে। এত কিছুর পরেও কলকাতায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখে সরকারের ডেথ অডিট কমিটি। কারও ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে, এটা জানা গেলে সব তথ্য ওই কমিটির কাছে পাঠাতে হয়। সেসব দেখে কমিটির নানা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে না কী অন্য কোনো কারণে। পোলিও নির্ণয়ের জন্য বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করতেন Expert Review Committee (ERC) নিয়ে, যেখানে থাকতেন একজন শিশু বিশেষজ্ঞ, একজন নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, একজন ভাইরোলজিস্ট এবং ইপিআই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এর সংশিষ্ট কর্মকর্তারা– যারা রোগীর সব তথ্য আর রিপোর্ট দেখে সিদ্ধান্তে আসতেন। এই কমিটি ছাড়া আর কেউ পোলিওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখতো না। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর জন্য এমন কমিটি থাকলে হয়ত সব তথ্য আর রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ডেঙ্গুর পরবর্তী গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আঁচ করা আর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যাপারে আগাম প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব। প্রাণহানি আর ভোগান্তি দুটোই কমবে তাহলে।

পোলিওর ক্ষেত্রে এসবকিছুর ফলাফল ছিল অভাবনীয়। ১৯৯৫ সালে পোলিও নির্মূল কার্যক্রম ও নজরদারি শুরু করার পর মাত্র কয়েকবছর পর ২০০০ সালে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে তাদের লক্ষ্য অর্জন করে। ২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন পোলিও আক্রান্ত শিশু পাওয়া যায়নি। ২০০৬ সালে নতুন করে কিছু শিশু পোলিও আক্রান্ত হয়। এরপর জোরালো নজরদারি আর টিকাদান কর্মসূচির ফল হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের  আরো ১০টি দেশের সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা পোলিওমুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

যদিও বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু নজরদারি বা সারভেইল্যান্স এর কাজ বেশ ভালোভাবেই করে যাচ্ছে, কিন্তু কলকাতা কর্পোরেশনের কর্মপন্থা আমদের বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া বা বছরজুড়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যত কর্মযজ্ঞের জন্য হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে যখন দুই নগরের ভৌগলিক আর আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রায় একইরকম আর বাংলাদেশে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধের শক্তিশালী অবকাঠামো রয়েছে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আরো কিছু  সম্প্রসারিত নজরদারি জোরদার করা হলে আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যকম হয়তো অদূর ভবিষ্যতে পোলিও নির্মুলের মত এক সফলগাঁথায় পরিণত হবে।