মশা নিয়ন্ত্রণ: কার্যকর দমন পদ্ধতি, নিবিড় গবেষণা ও জনসচেতনতা

মো. আসাদুজ্জামান মিয়া
Published : 29 July 2019, 12:11 PM
Updated : 29 July 2019, 12:11 PM

মশা দমন নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের ভাবনাটা এখনো বিচ্ছিন্ন বলা যায়। মশার উৎপাত বাড়লে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নামে মাত্র এক্সপার্ট এনে মিটিং করে করণীয় ঠিক করা হয়। কিন্তু কার্যকর দমন আর হয়ে উঠে না। যদিও সম্মিলিতভাবেও কাজ করতে দেখা যায়, যেমন- ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়লে বিভিন্ন চিকিৎসা/গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর'বি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইত্যাদি) সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক/গবেষকরা সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসেন। যাই হোক, দেশে ডেঙ্গুর চিকিৎসা (কিউর) মোটামুটি ভালো চললেও এর প্রিভেনশনটা কিন্তু ঠিকঠাকমতো করা যাচ্ছে না । সুতরাং মশা নিধনে (প্রিভেনটিভ মেজার) সিটি কর্পোরেশনকে নতুন করে ভাবতে হবে। যেহেতু মশা নিধন ছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তাই এই সেক্টরটাকে আলাদা করে (দক্ষ লোকবলের সমন্বয়ে) যুগোপযোগী, গবেষণাভিত্তিক ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন শুরু থেকেই নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিলেও (যেমন-রুটিন করে সকাল বিকাল বিভিন্ন ওয়ার্ডে কীটনাশক স্প্রেইং ও ফগিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা) প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপারেশন টিম বা যারা স্প্রে করছে তারা কি জানে কোন প্রজাতির মশা কোথায় কী পরিমান কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে? তাদের কাছে কি কোনো কীটনাশক প্রতিরোধী পরীক্ষিত ডেটা রয়েছে, যা দেখে তারা রিকমেন্ডেড ডোজ প্রয়োগ করতে পারে? নাকি তারা মশা মারার জন্য কীটনাশকের ডোজ নিজেরাই ঠিক করছে বা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিচ্ছে? কিংবা যারা কীটনাশক প্রয়োগ করছে তারা কি ঠিকঠাক মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত? শোনা যাচ্ছে যে, ঢাকার মশা নাকি এখন কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ফলে কীটনাশকে আর মশা মরছে না। যদি কীটনাশকে ভেজাল না হয়, তবে অল্প ডোজে কাজ হওয়ার কথা। তবে সাধারণত কীটনাশকের ভুল প্রয়োগেই (অতিরিক্ত ডোজ/অদক্ষ স্প্রেয়ারম্যান) মশারা প্রতিরোধী হয় বেশি। কারণ মাত্রারিক্ত ডোজে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক ।

মশার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে কীটনাশক প্রতিরোধী হওয়ার। অতিরিক্ত প্রতিকূল পরিবেশে মশারা বাচাঁর জন্যে দেহের ফিজিওলজিকাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে পি-৪৫০ জিন-কে (প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে চরম প্রতিরোধী হয়ে উঠে। কীটনাশক দিয়ে এদেরকে আর ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং মাত্রারিক্ত ডোজ যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখান থেকে অনুমেয়। তাই, বিভিন্ন টার্গেট এরিয়ায় মশা কী পরিমান কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে এবং এ্ই প্রতিরোধের মাত্রা (রেজিসটেন্স রেশিও) কেমন তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। নিয়মিত ও রুটিন মাফিক গবেষণা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কোনোদিনই টেকসই হবে না।

সফলভাবে মশা ও মশাবাহিত রোগ দমন করতে আলাদা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সেল (মসকিউটো কন্ট্রোল ইউনিট) গঠন করা যেতে পারে। যার মূল কাজ হবে-

ক. মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম (অপারেশন),

খ. সফল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করা, এবং

গ. জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া।

এই তিন ধরনের কাজের জন্য আলাদা সাব-সেল থাকবে। এই সাব-সেলগুলো ১/২ জন সায়েনটিস্টের তত্ত্বাবধান ও কিছু দক্ষ টেকনিশিয়ান দ্বারা পরিচালিত হবে-

ক. মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (অপারেশন) জন্য একদল দক্ষ টেকনেশিয়ান (যাদের মশার বায়োলজি সর্ম্পকে মিনিমাম জ্ঞান থাকবে) লাগবে। যারা নিয়মিত কীটনাশক (অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) স্প্রে করবে। যারা বুঝবে অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড কোথায় কোন মাত্রায় ব্যাবহার হচ্ছে। যারা থারমাল ফগার, ইউএলভি স্প্রেয়ার ইত্যাদি সহ নতুন নতুন ইকুয়েপমেন্ট ঠিকঠাকমতো ব্যবহার করতে পারবে। যারা এডিস মশা (ডেঙ্গু/চিকুনগুনিয়া রোগবাহী) সহ অন্যান্য মশা সনাক্ত করতে পারবে। টার্গেটস ও নন- টারগেটস প্রজাতি চিনতে পারবে।

খ. মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (অপারেশন) পাশাপাশি মশা নিয়ে গবেষণা একটা অতীব জরুরী বিষয়, যার উপর ভিত্তি করে সাধারণত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণার বিষয় হচ্ছে মশার সার্ভিলেন্স (সাইনটিস্ট ও দক্ষ টেকনেশিয়ানরা দ্বারা পরিচালিত হবে)। এডিস সহ অন্যান্য মশার (অ্যাডাল্ট এবং লার্ভা) সার্ভিলেন্স কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে এবং তা মনিটরিং করতে হবে । হোস্ট-সিকিং মশা (মানুষ বা প্রাণিদের কামড়ায়) ও এগ-লেইং মশা (ডিম পারা মশা) ধরার জন্য বিভিন্ন ট্র্যাপ (মশা ধরার ফাঁদ) যেমন- লাইট ট্র্যাপ, বিজি ট্র্যাপ, গ্রাভিড ট্র্যাপ, অভি ট্র্যাপ (ডিম সংগ্রহের জন্য) ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কোন এরিয়ায় কী কী প্রজাতির মশা রয়েছে, এমনকি কোথাও জীবাণুবাহী মশা আছে কিনা তা জানা যাবে।

জীবাণুবাহী মশা এনে আরবোভাইরাল টেস্ট করতে হবে। নিয়মিত সার্ভিলেন্স করে কোথায় কোন প্রজাতির মশা আছে তা জেনে নিদিষ্ট কীটনাশক (ডোজ সহ) প্রয়োগে সুপারিশ করতে হবে। এ সমস্ত গবেষণা কাজের জন্য লাগবে ইনসেকটারি (মশা পালন), ল্যাবরেটরি, ট্র্যাপ রুম ইত্যাদি। ১-২ জন দক্ষ বায়োলজিস্ট/অ্যান্টমোলজিস্ট/মলিকুলার বায়োলজিস্টরা যেখানে কাজ করবেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মশা দমনে কার্যকরী পদক্ষেপ নিবেন।

গ. জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সারাদেশে অ্যওয়ারনেস উইক, ওপেন ডে পালন করা যেতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (মসজিদসহ) ভিজিট করে মশার প্রজাতি, মশার আক্রমণ, জীবন-চক্র, মশা বাহিত রোগ-জীবাণু, রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে আগাম অবিহিত করা যেতে পারে।

মশা নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে কীটনাশকের (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) পাশাপশি বায়োলজিকাল কন্ট্রোলও কার্যকরী হয়ে উঠেছে। বায়োলজিকালি কন্ট্রোল করতে বর্তমানে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উৎপাদন ব্যহত করে), মেল স্টেরাইল টেকনিক (মশাদের মেটিং হবে কিন্তু ডিম উৎপাদন হবে না), বিভিন্ন মশক প্রিডেটরস যেমন- মশক মাছ (গ্যামবুসিয়াসহ অন্যান্য), ওয়াটার বাগ, বিটল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

মশা এখন শুধু বিরক্তিকর নয়, আতঙ্কেরও বিষয়। ইমারজিং পাবলিক হেলথ ইস্যু। তাই, ইনটিগ্রেটেড মসকিটো ম্যানেজমেন্ট (আইএমএম) অনুসরণ করে আমাদের দেশে আলাদা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সেল (মসকিউটো কন্ট্রোল ইউনিট) প্রতিষ্ঠার নতুন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যেখানে অপারেশন ও গবেষণা দুটোই চলবে এবং প্রয়োজনে অন্যান্য আরবো-ভাইরাল ডিজেজ ভেক্টর নিয়েও কাজ করা যাবে। মশা নিয়ন্ত্রনের জন্য আলাদা করে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে প্রথমে কিছুটা সময় লাগলেও পরবর্তীতে খুব সফলভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

সফলভাবে মশা ও মশাবাহিত রোগ দমন করতে অবশ্যই নতুন ভাবনা এখন সময়ের দাবি। কারণ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নাগরিক সুবিধা কেন পিছিয়ে থাকবে?