আওয়ামী লীগের জন্ম কথা : অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষণমুক্ত-উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন

আশফাক হোসেন
Published : 23 June 2019, 01:01 PM
Updated : 23 June 2019, 01:01 PM

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই মুসলিম লীগ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ষড়যন্ত্রের ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগের 'অপশাসন'-এর বিরুদ্ধে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রামের সূচনা করে। এ কারণে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দলটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। একই সময়ে  ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সার্থক সংগ্রামের সূচনা হয়। কৃষক প্রধান পূর্ববঙ্গে বা বাংলাদেশেই অধিকাংশ কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের সময় কৃষক বিদ্রোহের অগ্নিশিখা কখনই নিভে যায়নি। বিশ শতকে পূর্ববঙ্গের বিদ্রোহী কৃষক  জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির আশায় পাকিস্তান নামক একটি 'কল্পরাজ্য' প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সামিল হয়েছিল। কিন্তু 'কল্পরাজ্য'-এর খলনায়করা যখন ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন জিঞ্জির পরিয়ে দিতে উদ্ধত হয়, মুখের ভাষা কেড়ে নিতে বাঙালি ছাত্রদের বুকে গুলি চালায়, তখনই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সার্থক সংগ্রামের সূচনা হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৯৫০ দশকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, পূর্ববাংলার ন্যায্য হিস্যা নিয়ে জনগণকে সংঘটিত করে । ১৯৬০ দশকে আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাংলাদেশকে নিয়ে যায় স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বারে।

মুসলিম লীগের অপশাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম

ঐতিহাসিকভাবে এটা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তান আন্দোলন ও বাস্তবায়নে পূর্ব বাংলার মানুষের অবদান অপরিসীম। তবে বাঙালি মুসলমান সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিম লীগের সৃষ্ট ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র। একমাত্র ধর্মীয় ঐক্য ছাড়া পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মানুষের মাঝে কোনো ক্ষেত্রেই মিল ছিল না। নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সামগ্রিক জীবনধারায় পূর্ব বাংলার মানুষ ছিল পাকিস্তানিদের চেয়ে ভিন্ন। পাকিস্তানের উভয় অংশের ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া, খাদ্যাভাস, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুস্তর পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সমগ্র দেশের মানুষের জন্য সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা, একটি কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন কোনোটিই করা সম্ভব হয় নি। বস্তুত মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মাঝে আধুনিক জীবনবোধ, দর্শনের অভাব, ধর্মান্ধতা থাকায় একদিকে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়, অন্যদিকে নতুন রাষ্ট্রের পথনির্দেশনা হারিয়ে যায়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের নির্দেশনা প্রদানে ব্যর্থতার জন্য ধর্মীয় নেতারা তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা নিয়ে এগিয়ে আসেন। তারা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, যেহেতু মুসলমানদের আন্দোলনে ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলাই হবে যুক্তিসঙ্গত। উপরন্তু ভারত থেকে আগত মুহাজির শরণার্থীরা পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক পদসমূহ একচেটিয়া দখল করে নেয়। এইভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ভূস্বামী, সামন্ত জমিদার, উলেমা, পীর, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক লুটেরা শাসক ও শোষক শ্রেণি। রাজনীতি ও প্রশাসনে গণতন্ত্র নয়, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রই হয়ে দাঁড়ায় মূল বৈশিষ্ট্য। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের নেতৃত্বেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। পূর্ব বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই বাংলার মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ও জনপ্রিয় অংশটিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার বলয় থেকে হটিয়ে দেয়া হয়। এমনকি দেশ বিভাগের পর তাদের অনেককে ঢাকায় আসতে দেয়া হয়নি। বলা যেতে পারে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই মুসলিম লীগ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ষড়যন্ত্রের ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯

এরকম একটি পটভূমিতে, আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই দল পরবর্তীকালে (১৯৫৫) আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম পরিচালনা এবং জাতিকে জাগ্রত করে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভূমিকা একক ও অনন্য। এই দলের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলন উত্তাল অগ্নিঝরা অধ্যায়ের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই পূর্ব বাংলা স্বাধীনতা অর্জন করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। এ দেশের আপামর জনসাধারণের দল আওয়ামী লীগ এবং সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে উঠে আসা বাঙালির অবিসংবাদিত জননেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী মুসলিম লীগের দানাবন্ধন ঘটেছিল বিশ শতকের চল্লিশের দশকের বহমুখী রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে। বিশেষত এই সময়কালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল অংশটি কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন।

১৯৪৭ সালের বিভাগ-পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ নেতারা ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাদের নেতৃত্বেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বাংলার বিধানসভার হিন্দু সদস্যগণ দেশ-বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রদেশ বিভাগের পক্ষে রায় প্রদান করেন (পক্ষে ৫৮, বিপক্ষে ২১)। এর পর পরই মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার আইনসভার জন্য নেতা নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। ৫ অগাস্ট অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দীন ৭৫-৩১ ভোটে সোহরাওয়ার্দীকে হারিয়ে সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। খাজা নাজিমউদ্দীন ও নূরুল আমীন নেতৃত্বাধীন বাংলার মুসলিম লীগের অংশটি ছিল গণবিচ্ছিন্ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি রাজনীতির বলয়ভুক্ত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে ও পরে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল অংশটিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার বলয় থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়। বলা বাহুল্য যে, এ সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল  কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পাকিস্তান আন্দোলনে এদের অবদান অনস্বীকার্য। দেশ বিভাগের পর এ সকল নেতা-কর্মী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নতুন সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়ে ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিতে অবস্থিত ছিল মুসলিম লীগের ওয়ার্কশপ ক্যাম্প। ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত এই ক্যাম্পের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন শামসুল হক (টাঙ্গাইল)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ক্যাম্পটিকে ঘিরে প্রতিবাদী মুসলিম লীগ কর্মীরা সংগঠিত হন। মাওলানা আকরম খাঁ তখন পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের সভাপতি। ১৯৪৯ সালের মে মাসের দিকে বাংলার মুসলিম লীগের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা এক সম্মেলন অনুষ্ঠান করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। এই প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কাছে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ব্যাপারে আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি পূর্ব বাংলার আকরম খাঁ, নাজিমউদ্দীন প্রমুখকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন। এতে পূর্ব বাংলার প্রতিবাদী ও তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীরা দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন।

এই সময়ের আরেকটি ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম ও পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ শাখাকে একীভুত করে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। এতে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী এবং সদস্য দেওয়ান বাসেত ও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যভুক্ত হন। মাওলানা আকরম খাঁ এই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নিজেই একটি নতুন কমিটি গঠন করেন। এছাড়াও পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ববঙ্গ বিরোধী কার্যকলাপ, ভাষা-সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ, সাধারণ জনজীবনের বিপর্যয় ইত্যাদি ঘটনাবলি মুসলিম লীগের তরুণ অংশকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। দেশ পরিচালনায় মুসলিম লীগের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দমননীতি শিক্ষিত সুধী সমাজকে দারুণভাবে হতাশ করে। এভাবে পূর্ববাংলার সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করে দেয়।

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। এই সম্মেলনে প্রায় তিনশ প্রতিনিধি অংশ নেন। এতে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ কে ফজলুল হকও সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি তখন পূর্ব বাংলা সরকারের এডভোকেট জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত। সম্মেলনে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি যথাক্রমে আতাউর রহমান খান (অ্যাডভোকেট), সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমদ (এমএলএ), আলী আমজাদ খান (অ্যাডভোকেট), আবদুস সালাম খান (অ্যাডভোকেট), সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সহ-সম্পাদক মোশতাক আহমদ, এ কে এম রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান।

আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে এই দলের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমশ পূর্ব বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত জননেতায় পরিণত হন এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দান করেন। তার রাজনৈতিক উত্থান মূলত শুরু হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের সূচনা থেকে।

শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান চল্লিশের দশকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৪৩ সালে তিনি মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই তিনি কয়েকবার কারারুদ্ধ হন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থন করার অভিযোগে ও বিভিন্ন হল ছাত্রনেতাদেরকে বহিষ্কার ও জরিমানা করার প্রতিবাদে গ্রেপ্তার হন। কোনো জরিমানা ও সরকারের কাছে মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় ১৯৪৯ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। অতএব আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে ১৯৪৯ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়কালে তিনি বিরোধী রাজনীতির ধরনটা আয়ত্ত করেন এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেকে তৈরি করেন। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মনে প্রাণে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাই ঢাকায় ফিরে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধেই তরুণদের সংগঠিত করেন। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ গঠনে ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠন ও মন্ত্রী হিসেবেও যতটুকু সম্ভব অবদান রেখেছিলেন।

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাংগঠনিক দক্ষতায়, আন্দোলন-সংগ্রামে, এই অঞ্চলের জীবন-বাস্তবতার আলোকে রাজনীতি পরিচালনায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার বিকাশে, সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তব রূপায়ণে এই দল একক ও অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার। এই দলের প্রথম ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয় যে, দেশ বিভাগের পর মুসলিম লীগ দেশ পরিচালানায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনে যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা অপরিসীম, দেশ বিভাগের পর তারা নেতৃত্বে আসতে পারেনি। মুসলিম লীগ জনগণের সমস্যা সমাধানে কোনো প্রকার উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। শাসক দল বিভিন্ন ধরনের কালাকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অবদমিত করে রাখে। মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গি দেশে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত এবং ভারত থেকে আগত শরণার্থীদের পুনর্বাসিত করার ক্ষেত্রে সরকার কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষত পূর্ব বাংলায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণ, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতের সঠিক প্রতিফলনকল্পে একটি রাজনৈতিক দলের বাস্তব ও সমযোপযোগী প্রয়োজন থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম।

এখানে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন যে, আওয়ামী মুসলিম লীগের এসব দাবি প্রণীত হয়েছিল তৎকালীন সময়ের রাজনৈতেক ও সামাজিক বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে। এই রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার পর পরই পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক সমস্যাবলিকে সামনে রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল জমিদারি প্রথার বিলোপ, বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির উচ্ছেদ, পাটের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, সারা দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন প্রভৃতি। এই কর্মসূচি থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এই দাবিগুলি ছিল এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের দাবি। মুসলিম লীগের বিকল্প রাজনৈতিক দল এবং গণমুখী কর্মসূচি জনগণের সামনে হাজির হওয়ার পটভূমিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ দল দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। সরকারি বৈরিতা এবং দমন-নির্যাতন সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এই দল পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ধারার রাজনীতি আওয়ামী লীগের একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড, ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার বিরুদ্ধে এটাই ছিল ১৯৪৭ উত্তরকালে সবচেয়ে শক্তিশালী, সুসংগঠিত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারার সংগঠন। এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মী, সংগঠক ও বুদ্ধিজীবীরা বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের সাথে সাথে অনুষ্ঠিত হয় কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এই সকল সাংস্কৃতিক সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রবল দাবি উচ্চারিত হয়। জাতির সামনে তুলে ধরা হয় বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিবর্তনধারা। এই সম্মেলনগুলোতে অংশ নেন দেশের সকল বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারাকে শক্তিশালী করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশের ক্ষেত্রে, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে বেগবান করে তোলার ক্ষেত্রে এই সকল সাংস্কৃতিক সম্মেলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা পূর্ববঙ্গের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কালক্রমে এটি পরিণত হয় বাঙালির মুক্তির সনদে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালি রাজনীতিবিদদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকেই ভয় এবং সমীহ করতো। কারণ, পদ সম্পদ কোন কিছু দিয়েই তাকে কেনা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিকভাবে তাকে শেষ করে দেয়ার জন্য ১৯৬৮ সালে তাকে আগরতলা মামলায় জড়ানো হয়। ১৯৬৯ সালে জনগণ তাকে মুক্ত করে এনে ভালবেসে উপাধি দেয় 'বঙ্গবন্ধু'।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ববাংলার প্রধান রাজনৈতিক দল এবং বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির একক নেতা হয়ে উঠলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার নামেই  এবং বাঙালি আর কখনও এতো ঐক্যবদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি দেশকে পুনর্গঠন করে এবং মাত্র নয় মাসের মধ্যে একটি সংবিধান উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষণমুক্ত-উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমিটাই নির্মাণ করে দিয়েছে।