বাংলাদেশের রূপান্তর, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সরকারের অপরাধসমূহ

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 6 June 2019, 11:12 AM
Updated : 6 June 2019, 11:12 AM

নামে দ্বিজাতিতত্ত্ব বলা হলেও আসলে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়েছিল এবং পাকিস্তান নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। যেহেতু সাম্প্রদায়িকতাই ছিল বিভক্তি ও সৃষ্টির মূল কারণ, ফলে সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্রীয় পোষকতায় ফুলে ফেপে উঠবে– এটাই ছিল স্বাভাবিক। পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সেটাই হয়েছিল একদল লেখক বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে লেখক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আবার আরও একটি ধারাও ছিল যারা সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছিলেন পরবর্তী ধারাটিই, এর কারণ রাষ্ট্র বা শাসক শ্রেণি সাম্প্রদায়িক হলেও বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনো প্রবণতা ছিল না, বা থাকলেও সেটা একটি ক্ষীণতর ধারা হিসেবেই ছিল। যদি প্রবলতর ধারা হিসেবেই থাকতো তাহলে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হতে পারতো না। এবং এটাও এক বড় উদাহরণ যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন করার জন্য কোনো ইসলামী বা সাম্প্রদায়িক হুজুক তুলে নয়, বরং উল্টো অসাম্প্রদায়িক বাণী তুলে ধরেছিলেন ।

আমাদের জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ'র স্মরণীয় উক্তি ছিল "আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালি"। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদুল্লাহর ওই উক্তিটিকেই জনপ্রিয় স্লোগানে রূপান্তরিত করে বলা হয়েছিল, "বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।" জনপ্রিয় এই স্লোগানের পতাকা-তলে একত্রিত হয়েছিল গোটা বাঙালি জাতি, যুদ্ধ করেছিল ইসলামপন্থী পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। এবং শেষ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িকতাই জয়ী হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ভারতবর্ষেই নয়, গোটা এশিয়াতে তিনিই একমাত্র নেতা যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জাতির ধর্মকে পুঁজি করে নয়, একেবারে বিপরীত এক ধর্মীয় অবস্থানে গিয়ে, অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থান থেকে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশটিকে স্বাধীন করেছিলেন। দেশটি যত ছোটই হোক না কেন, কিন্তু এই ছোট্ট দেশটিতেই ঘটে ছিল বিস্ময়কর রকমের এক বড় ঘটনা, যার নজির ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। তার সঙ্গে একমাত্র যার তুলনা করা যায় তিনি কামাল আতাতুর্ক। ধর্মের চেয়ে নরম কোমল আর স্পর্শকাতর বিষয় আর কিছু নেই। কপট, ধূর্ত আর অসৎ শাসক ও নেতারা বিনে পয়সায় আর বিনা পরিশ্রমে এই বিষয়টিকে অবলম্বন করেন ক্ষমতায় থাকার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সহজ উপায় হিসেবে। একজন বড় ও মহৎ নেতা জনরুচির তোয়াজ করেন না, তিনি জনরুচিকে বদলে দেন বা জনগণের মধ্যে সুপ্ত ও অবিকশিত প্রবণতাকে বিকশিত করেন। তৎকালীন শাসক ও পোষা লেখক বুদ্ধিজীবীদের ইসলামী বা সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও, বঙ্গবন্ধু বিপরীত স্রোতে যাওয়ার দুঃসাহসী, ঝুঁকিপূর্ণ এবং সৃজনশীল পথটিই বেছে নিয়েছিলেন এই কারণে যে তিনি গোটা জাতির মনোগঠন ও মনস্তত্বটি খুব পরিষ্কারভাবে জানতেন। তার জানা ও বিপরীত পথে যাত্রাটা যে নির্ভুল ছিল সেটা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতির ভাঙা কাচের টুকরোয় আকীর্ণ দীর্ঘ পথটি তিনি যে-সতর্কতায় সাফল্যের সঙ্গে পার হয়েছিলেন তার তুলনা গোটা ভারতবর্ষে কোনো নেতারই সাথে হবে না। ভারতবর্ষের বেশির ভাগ নেতাকেই তোয়াজ করে চলতে হয়েছে ধর্মকে কিংবা ধর্মকে পুঁজি করেই চলতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এই ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিপরীত মেরুরই শুধু নন, তিনি ওই বিপরীত পথে গিয়ে একটি দেশকে স্বাধীন করার বিস্ময়কর চমক সৃষ্টি করেছেন। মহাত্মা গান্ধীকে ধর্মের পথেই বিজয়ী হতে হয়েছে, ধর্মের লেবাস তিনি পরিত্যাগ তো করেনইনি, বরং তার কোনো উক্তি রাজনীতি সম্পর্কে হলেও তাতে ছিল রাজনৈতিক পাপপুণ্যবোধের প্রকাশ।। জিন্নাহকেও স্যুট টাই আর মদের বোতল হাতে যেতে হয়েছে ওই একই পথে। নেতাজী সুভাষ বসু বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ওই  পথে যাননি বটে কিন্তু তারা তাদের অসাম্প্রদায়িক স্বপ্নকে কোনো রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে পারেননি যা বঙ্গবন্ধু পেরেছিলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে-পরিশ্রম, সাধনা ও বিচক্ষণতা দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি তার মৃত্যুর পরপরই উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে দিল। খোন্দকার মুশতাক আহমেদ, তারপর জিয়াউর রহমান এবং সর্বশেষ হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের শায়িত নির্জীব দেহের উপর একটি কালো গিলাব চড়িয়ে দিলেন। এরপর, বিএনপি-প্রধানই হোন আর আওয়ামী-প্রধানই হোন তাদের কেউ-ই গিলাবটি সরিয়ে সেই দেহটিকে সজীব করার প্রয়োজন বোধ করেননি। বরং দুজনই ওই নির্জীব দেহটি ঘিরেই তাওয়াফ করেছেন মাত্র, সজীব করার উদ্যোগ নেননি। বিএনপি সেই উদ্যোগ নেবে না কারণ ওটা তাদের বিপক্ষ দলের আদর্শ। কিন্তু আওয়ামী লীগ? তাদেরই কি দায়িত্ব ছিল না লোপাট হওয়া আদর্শটিকে পুনরুদ্ধার করা? তারা এই দলের প্রাণ-পুরুষ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলেন– নেতা থেকে কর্মী পর্যন্ত—সবাই। ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রধান স্তম্ভ। সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর কোন স্বপ্ন ও আদর্শকে তারা বাস্তবায়ন করবেন? বঙ্গবন্ধুর পুরো লড়াইটাই ছিল স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। একজন স্বৈরাচারীকে উচ্ছেদ করার চেয়ে সংস্কৃতি থেকে সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মীয় প্রাচীনপন্থা ও উন্মাদনা উচ্ছেদ করা অনেক বেশি কঠিন। সংস্কৃতিকে ধর্মের আফিমে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারলে শাসকদের জন্য ক্ষমতায় থাকা যেমন সহজ তেমনি নিরাপদ । সংস্কৃতি কখনো রাজনীতির উপর নির্ভশীল নয়, কিন্তু রাজনীতিকে সংস্কৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। কারণটা পরিষ্কার করার জন্য আমার বহুদিনের প্রিয় লেখক মারিও বার্গাস যোসা থেকে একটা উদ্ধৃতি দিলেই ব্যাপারটা আরও স্বচ্ছ হয়ে উঠবে:

Culture does not depend on politics, or it should not, although this is inevitable in dictatorships, especially in ideological or religious dictatorships, in which the regime feels authorized to dictate norms and establish cannons of behaviour within which cultural life evolves, under the vigilance of the state, which is committed to making sure that cultural life does not stay from the orthodox that supports the regime. ( Notes on the death of culture, Mario Vargas Llosa, Picador, 2012, p-123)

আমাদের আজকের রাজনীতিবিদ ও ৭৫-পরবর্তী শাসকরা পাকিস্তানি শাসকদের আদর্শটিকেই পুনর্জাগ্রত করে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে স্বাধীনতা-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এখনকার পরিস্থিতি- অন্তত সাংস্কৃতিক বিবেচনায়- পাকিস্তান আমলের চেয়েও খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।  এই অবস্থায় পৌঁছার মূল কারণ religious dictatorships না হলেও  religion-এর  মাধ্যমে এক ধরনের  dictatorship-এ  পৌঁছানো যাতে করে ক্ষমতাকে সুরক্ষিত রাখা যায়। আওয়ামী লীগ হয়তো মনে করছে দলের আদর্শের বিরুদ্ধে ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে ধর্মনিষ্ঠ বিরোধী দলগুলোকে ঘায়েল করা যাবে। তা নিশ্চিতভাবে যাবে, কিন্তু এর মাধ্যমে রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে ধর্মাচ্ছন্ন করা হবে কেবল। ইতিমধ্যেই সেই আচ্ছন্নতা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে তা শেষ পর্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ বিরোধী দল ও ইসলামী দলগুলোর পক্ষে  সাংস্কৃতিক আনুকূল্য তৈরি করেছে। এর ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে আদর্শগতভাবে নিঃস্ব হয়ে বিরোধী দলগুলোর মতোই আরেকটি ধর্মনিষ্ঠ দল হয়ে উঠতে বাধ্য হবে। এইভাবে অপমৃত্যু ঘটবে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা ধর্ম সম্পর্কে কতদূর অসহিঞ্জু হয়ে উঠেছি আওয়ামী-অনুরাগী ‍বুদ্ধিজীবীদের অভিমত থেকেই তা জানতে পারছি।  প্রাবন্ধিক গবেষক শামসুজ্জামান খান সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন "পাকিস্তান আমলেও যতটা অসাম্প্রদায়িক কথাবার্তা চলত, এখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে (৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফও আমাদের এখনকার সংস্কৃতিকে ধর্মীয় হিজাব পড়ানোর ব্যাপারে একই প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন: "দেখতে পাচ্ছি, সমাজ এবং রাষ্ট্র ধর্মের সাথে একটি অবৈধ চুক্তিতে যাচ্ছে।(২৭মার্চ, ২০১৮, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

গবেষক শামসুজ্জামানের বক্তব্যটি যে মিথ্যে নয় তার একটা উদাহরণ আমরা দেখতে পাবো পাকিস্তানপর্বের এক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ইসলামিক চিন্তাবিদ আবুল হাশিমের লেখায়। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত তার As I see it নামক গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের প্রথম স্তবকেই বলেছিলেন:

In common parlance we say Allah has made me blind, He has made him rich and He has made him a king. We generally understand and interpret statements like these ignoring the natural process which makes one blind, rich and king. These could be true in the sense we generally understand them if Allah had created every individual out of nothing and dropping them from heaven as blind, rich or a king. The fact is that we have come into existence through a natural process. It is questioned whether God created man or man crated God. Both are true." ( As I see it, Abul Hashim, Islamic Academy, Dacca, 1965, p-1)

একজন রাজনীতিবিদ এবং ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে আবুল হাশিম উদ্ধৃত প্যারার শেষ বাক্যটিতে কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই বলতে পারছেন যে, প্রশ্ন হলো ঈশ্বর মানুষ তৈরি করেছে নাকি মানুষ ঈশ্বরকে তৈরি করেছে। উত্তরে তিনি বলছেন দুটোই সত্য। তাহলে দুটো সত্যের একটা হচ্ছে এই যে ঈশ্বর নয়,বরং মানুষই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। আজকে ইসলামিক কোনো চিন্তাবিদ তো দূরের কথা, একজন অধার্মিকও যদি একথা বলেন তাকে ধর্ম-কথিত উক্তি অবমাননার অভিযোগে শাস্তির দাবি জানানো হবে। কারণ, আবুল হাশিমদের সময়ে যা বলে সামাজিক বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ার আশংকা ছিল না, আজ সেই আশংকাটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। আর রাষ্ট্র এই ধর্মায়িত( Theoliged) সমাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা আদায় করে নিচ্ছে। এই নিশ্চয়তা কত দূর এগিয়েছে তার সর্বশেষ নজির হচ্ছে ডিজিটাল আইনে ধর্মানুভূতির প্রসঙ্গটি।

একটি রাষ্ট্র যখন অসততা ও ভণ্ডামিকে আশ্রয় করে তখন সে অজ্ঞাতে এমন এক গোলক ধাঁধা তৈরি করে যার মধ্যে নিজেই নিক্ষিপ্ত হয় আদর্শহীনতার কারণে।

বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মোহে  আচ্ছন্ন হয়ে ধর্মকে আরামের পেশা হিসেবে অবলম্বন করেছে। কিন্তু উভয় দলই যেহেতু অজ্ঞতার এক নিখিল পিণ্ড হয়ে উঠেছে তাই নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে ডিজিটাল আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। পাকিস্তান আমলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃতির  ইসলামীকরণের সময়ও ব্লাসফেমি আইনের ধারণার কথা তারা ভাবেনি। কিন্তু আজ আধা শতাব্দি পর আমাদের সরকার বাহাদুররা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অপরাধে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর।

ডিজিটাল আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতে অপরাধের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ সময়কাল কিংবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডই নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু কী বললে, কীভাবে এবং কতটুকু বললে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়- তার কোনই সুস্পষ্ট রূপ তুলে ধরা হয়নি। কেন হয়নি? কারণ ওটা নির্ধারণ করা অত সোজা নয়।  কথা হলো এই অস্পষ্টতা দিয়ে আইন করতে গেলে নিরপরাধীকেও অপরাধী বানাবার সুযোগ থেকে যায়। আজকাল যেসব ঠুনকো বিষয়কে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে গ্রাহ্য করা হচ্ছে তার চেয়ে বহুগুণ বড় আঘাত রয়েছে আমাদের জাতীয় কবির লেখায়। "মূর্খরা সব শোনো/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।" কই, এজন্য তো কেউ বলছেন না এই বাক্যের মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। তিনি তো ঠিকই জাতীয় কবি হিসেবে বহাল তবিয়তে আছেন। সরকার যদি ধর্মীয় অনুভূতি সুরক্ষায় এতই দরদী হয়ে থাকেন তাহলে নজরুলের এই উক্তির বিরুদ্ধে তারা কী ব্যবস্থা নেবেন? সরকারের জারী করা আইন অনুসরণ করলে এখন যে-কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতে সরকারের সমর্থন থাকার অপরাধে সরকারের বিরুদ্ধেই মামলা করতে পারে। কারণ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দানকারী নজরুলকে জাতীয় কবি করে সরকার আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে যাচ্ছেন। আরও একটি কারণেও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, সেটি হচ্ছে বেগম রোকেয়া। তিনি বলেছেন পৃথিবীর ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষদের রচিত।*  অথচ তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের অনুমতিক্রমে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এ দুজন ছাড়াও আরও অনেকেই আছে। আইনের অস্বচ্ছতার সুযোগে নানা ছুতায় যদি কাউকে গ্রেপ্তার করতেই হয় তাহলে সরকারের উচিৎ আগে উপরোক্ত বিষয়গুলোর ফয়সালা করা। একই আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগ হলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে জনগণ।

ধর্ম নিয়ে নজরুল ইসলামের  ওই একটি উক্তিই নয়, আরও বহু উক্তি আছে যার জন্য একসময় গোড়া মুসলমানরা তাকে "কাফের" বলেও আখ্যায়িত করেছে। সরকার কি জাতীয় কবিকে কাফের মনে করেন? আজকের ডিজিটাল  আইনে তিনি নিশ্চিতভাবেই কাফের বলে আখ্যায়িত না হলেও, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দানকারী হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারেন। আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দানকারীকে জাতীয় কবির সম্মান ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য সরকার প্রবর্তিত ডিজিটাল আইনে সরকার নিজেই অপরাধ করছে।

স্পেনে এক সময় ইনকুইজিশনের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপরাধে বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। ইউরোপের অন্যান্য দেশও স্পেন থেকে পিছিয়ে ছিল না । কিন্তু ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো অতীতের সেই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর আমরা অতীতের দুঃস্বপ্নে আবারও প্রবেশ করছি। হায় বঙ্গবন্ধু, আপনি কি   এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন আপনার প্রাণপ্রিয় বাঙালি জাতির জন্য?

*প্রবল সব বাধা অগ্রাহ্য করে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। …আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। …এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। …ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন " – 'স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রবন্ধের বাদ দেয়া কিছু অংশ। ১৯৭৩ সালে আবদুল কাদির সম্পাদিত রোকেয়া রচনাবলীতে এই অংশটুকু থাকলেও , পরবর্তী সংস্করণ থেকে এই অংশটিকে বর্জন করা হয় বিতর্ক এড়াবার আশংকায়। অথচ পরবর্তী সংস্করনে প্রকাশক বা সম্পাদকবৃন্দ( আবদুল মান্নান সৈয়দ , সেলিনা হোসেন, মহম্মদ শামসুল হক, মাজেদা সাবের, মুহম্মদ নূরুল হুদা) তাদের ভূমিকায় এই বর্জনের কারণ বা বর্জন সম্পর্কে পাঠককে অবহিত করেননি। একজন লেখকের রচনা অংশবিশেষ বর্জন করে কোনো বিশেষ প্রয়োজনে প্রকাশ করতে গেলেও সে সম্পর্কে তার কারণ জানানোটা দায়িত্ব। তারা কেউই সেই দায়িত্বের ধার ধারেননি। কোনো লেখকের রচনা পবির্তনের অধিকার অন্য কারুর নেই। সেই অনধিকার চর্চা করে তারা একটা আপত্তিকর দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন।