চলুন বদলে যাই, বদলে দেই

শাম্মী আক্তার
Published : 6 May 2019, 08:33 AM
Updated : 6 May 2019, 08:33 AM

মিডিয়াতে অনুপ্রেরণাদানকারী, উদ্ভাবনী, সমাজ বদলের কারিগরদের গল্প পড়তে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে এবং তা যদি প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের হয় তাহলে তো সেটা আনন্দ, অনুপ্রেরণা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। আমার মনে হয় প্রত্যেকটা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার "সমাজ পরিবর্তনের ফেরিওয়ালা/সোশ্যাল চেঞ্জ মেকার" নামক নিয়মিত নির্দিষ্ট একটা কর্নার/সেকশন থাকা দরকার যেখানে সমগ্র দেশ থেকে ছোট ছোট ভালো লাগার, উৎসাহের, অনুপ্রেরণার গল্প উঠে আসবে। হতে পারে কেউ নিঃস্বার্থভাবে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে, কেউ সামাজিক উদ্যোক্তা হয়ে বেকারদের জীবন পাল্টে দিচ্ছে, সমাজের চিত্র বদলে দিচ্ছে, কেউ নতুন কিছু উদ্ভাবন করছে, কেউ সোশাল অ্যাক্টিভিজম এর মাধ্যমে মানুষকে নতুন আলোয় আলোকিত করছে, ইত্যাদি। মোটকথা, মিডিয়া হবে সমাজ পরিবর্তন করার, মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহিত করার, অনুপ্রাণিত করার অন্যতম মাধ্যম।

এতে একদিকে যেমন তারা উৎসাহিত হবে এবং আমরা পাঠকেরাও অনুপ্রাণিত হবো। আমার এলাকায় একজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি যে কি না ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য, তাদের বাবা-মাকে শিক্ষার প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য সন্ধ্যাবেলায় বিভিন্ন শিক্ষা সামগ্রী নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। তাদের সাথে কাউন্সেলিং করে। আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে, সমাজকে প্রকৃত আলোয় আলোকিত করার জন্য মানুষটি নীরবে-নিভৃতে রাতের আধারে কাজ করে যাচ্ছে। এই ধরনের ভালো কাজের বীজ একমাত্র মিডিয়ায় সর্বোত্তমভাবে বপন করতে পারে। যাই হোক, পত্রপত্রিকার অনেক মন খারাপ করা খবরের মধ্যেও একটা খবর দেখে একটু ভালো লাগলো। সাথে ছোটবেলার একটি স্মৃতিও মনে পড়ে গেল। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কবিতা আবৃত্তিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে একটি পুরস্কার পেয়েছিলাম। সেটা ছিল একটি গোল আকৃতির সিরামিক বাটি। পুরস্কার নিয়ে সবাইকে দেখাবো বলে তাড়াহুড়ো করে অতি আনন্দে অনেকটা নাচের ভঙ্গিতে বাড়িতে যাচ্ছিলাম হঠাৎ রাস্তায় কিসে যেন হোঁচট খেয়ে বাটিটা পড়ে ভেঙে গিয়েছিল! মনটা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল, বেশ কান্নাও পেয়েছিল।

যাই হোক, পরের দিন সকালে স্কুলে গিয়ে সরাসরি স্যারের রুমে চলে গিয়েছিলাম। হেড স্যারকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অভিযোগের সুরে বলেছিলাম স্যার আমাকে যদি কবিতা আবৃত্তির পুরস্কার হিসেবে বাটিটা না দিয়ে একটা কবিতার বই দিতেন তাহলেই ভালো হতো, ভাঙতো না!! সেখানে আপনাদের শুভেচ্ছা সহ স্বাক্ষর থাকতো, আমার নাম লেখা থাকতো সেটা মনে হয় বেশী আকর্ষণীয় হতো। সাহস করে স্যারকে বলেছিলাম; স্যার এর পর থেকে পুরস্কার বই দিবেন তাহলে আর ভাঙবে না! অবশ্য সেদিন স্যারের মৌনতা দেখে অভিব্যক্তি বুঝতে পেরেছিলাম না!

স্যার আমার কান্না দেখে বলেছিল নাও, আর একটা বাটি তুমি নিয়ে যাও। কিন্তু আমি বলেছিলাম স্যার বাটি তো আমার বাড়ীতে আছে। আসলেও তো তাই। থালা, বাটি, জগ মগ, গ্লাস তো সবার বাড়িতেই থাকে কিন্তু পুরস্কৃত ছাত্রছাত্রীদের নাম সম্মিলিত, অতিথিদের বা শিক্ষকদের শুভেচ্ছা স্বাক্ষরসহ শিক্ষা সামগ্রী তো সবার বাড়িতে থাকে না। এটাই তো পুরস্কার! এটাই তো আকর্ষণ! এটাই তো মজা!

সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার হিসেবে থালা, বাটি, মগ, জগ, গ্লাসসহ কোনো ধরণের ক্রোকারিজ সামগ্রী না দিতে নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এসবের পরিবর্তে পুরস্কার হিসেবে বই দিতে বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। আশা করি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সানন্দে নির্দেশনাটি গ্রহণ করবে। (একজন অ্যালামনাস হিসাবে আমার স্কুলে যখন কোন কিছু দেই তখন সেটা অবশ্যই শিক্ষা সামগ্রীই হয়।)

যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। দেশব্যাপী ২৩ শে এপ্রিল থেকে ২৯ শে এপ্রিল জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ পালিত হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টির একজন শিক্ষক হিসাবে আগ্রহটা যেমন বেশি ছিল তেমনি উদ্বেগটাও ছিল বেশি! পুষ্টি শিক্ষার বিষয়ে আমার মনে হয় যোগ বিয়োগটা একটু ভালো করে মেলানো দরকার। একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ, সুস্থ জাতি গঠনের জন্য অবশ্যই আমাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে কাজ শুরু করতে হবে। আসলে শিশুদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা দরকার। সেটার প্রথম ধাপ হতে পারে প্রাথমিক স্তরের বইগুলোতে বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে, বিভিন্ন ছড়ার মাধ্যমে, কবিতার মাধ্যমে, পুষ্টি শিক্ষা সংযোজন করা যাতে করে শিশুরা প্রথম থেকেই অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয় এবং তা অনুসরণ করে। যখন পাঠ্যপুস্তকে এই পুষ্টি বিষয়ক অধ্যায়গুলো ছেলে মেয়েরা পড়বে তখন এই বিষয়গুলো শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না পরিবারেও এগুলো আলোচনা হবে। এতে করে সবাই বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত হবে যা আস্তে আস্তে সঠিক খাদ্য নির্বাচন, সঠিক খাদ্যাভাস তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করবে। কিছুদিন আগে আমার একজন সহকর্মী আমাকে বলছিলো আপনাদের স্কুল নিউট্রিশন ক্যাম্পেইন প্রোগ্রামটা (নিউট্রিশন ইনিশিয়েটিভের স্কুল নিউট্রিশন এডুকেশন কার্যক্রম) দেখে আমার ছেলে এখন খাবার দাবার এর ব্যাপারে বেশ সচেতন হয়েছে। আসলে সরাসরি শিশুদেরকে জানাতে পারলে তা বেশ ফলপ্রসূ হয়।

এই যে তথাকথিত ছড়া বা রাইমস যেমন আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে ঢাকঢোল ঝাঁজর বাজে, হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম, ইত্যাদি। এসব পড়ে আমাদের শিশুরা আসলে কী শিখছে? ছোটবেলা থেকেই যদি তারা এরকম অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অর্থহীন বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত হয় এগুলো আত্মস্থ করে তাহলে কিভাবে একটি হেলদি, স্মার্ট জেনারেশন তৈরি হবে?

ইংরেজি বর্ণমালাগুলো এরকম কি হতে পারে না যেমন এ ফর অ্যাপল, অ্যাপল ইজ এ নিউট্রিশাস ফ্রুট। বি ফর ব্যানানা এন্ড ব্রকলি, ব্যানানা এন্ড ব্রকলি গিভস আস ভিটামিনস। সী ফর কোকোনাট, কোকোনাট ওয়াটার ইজ দা বেস্ট ড্রিঙ্ক। ডি ফর ডেট, ডেট ইজ এ ন্যাচারাল সুইট ইত্যাদি। এভাবে যদি খাবারের নাম দিয়ে বর্ণমালাগুলো সাজানো যায় তাহলে দেখা যাবে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে জানবে এবং এগুলো খেতে উৎসাহিত হবে যা পরবর্তীতে তাদের সঠিক খাদ্য নির্বাচনে এবং এই অভ্যাস ধরে রাখতে সহায়তা করবে।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সুস্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে ইদানিং কালে আমাদের লাইফস্পান অর্থাৎ গড় আয়ু (৭২ যা কিনা পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন ভারত পাকিস্তান থেকে বেশি ) বাড়লেও পক্ষান্তরে হেলথস্পান অর্থাৎ সুস্থ থাকার সময়কাল কিন্তু কমে যাচ্ছে যার অন্যতম কারণ লাইফ স্টাইল এবং খারাপ খাদ্যাভ্যাস। সেজন্য দেহ গাড়ি সচল, সক্রিয় রাখতে হলে ভিত্তি শক্তিশালী, সবল করার কোন বিকল্প নাই।

অন্যদিকে, শিশুদের ভিত্তি মজবুত ও অর্থপূর্ণ করতে ছড়া বা রাইমসগুলো অর্থপূর্ণ, উপদেশমূলক "ভালো অভ্যাস, সঠিক খাদ্যাভাস", ইত্যাদি বিষয় দিয়ে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। আমাদের মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি অনুরোধ থাকবে যেন উনি আমাদের কোমলমতি শিশুদের জন্য প্রি- প্রাইমারি ও প্রাইমারি স্তরের বইগুলো নতুনভাবে পরিমার্জন করেন "অ" তে অজগর যেন প্রথমেই আমাদের সন্তানদের দিকে তেড়ে না আসে! "অ" তে অলসতা ভালো নয়/অসৎ সঙ্গ ভালো নয় এমন গঠনমূলক বর্ণমালা ভিত্তি নিয়েই যেন আমাদের সন্তানরা গড়ে ওঠে। পুষ্টি সপ্তাহের সফলতা মাসব্যাপী, বছরব্যাপী চলমান রাখতে হলে এগুলো বাদেও আমাদের জরুরী ভাবে অন্য একটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অতিরঞ্জিত খাদ্যের বিজ্ঞাপন পুষ্টিসমৃদ্ধ সুস্থ জাতি গঠনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। আমরা ছেলে মেয়েদেরকে খাদ্যের ব্যাপারে যেমন ভাবে বলছি, যেমন ভাবে ভালো খাবারের দিক উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি টিভি বিজ্ঞাপন কিন্তু সেভাবে বলছে না। এতে করে শিশুরা দ্বিধান্বিত হয়ে যাচ্ছে। তারা বাবা মায়ের কথা শুনবে নাকি টিভিতে যেটা বলছে সেটা শুনবে। কারণ এই "আলফা (আলফাবেট জেড ইজ ওভার সো গ্রিক আলফাবেট আলফা হ্যাজ স্টার্টেড)/আই (ইন্সট্রাগ্রাম, আইপ্যাড) জেনারেশন (২০১০- ২০২৫) এর শিশুরা মিডিয়া দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। অনেক সময় তারা ভাবে টিভি নিশ্চয়ই ঠিক বলছে! মা বাবা মনে হয় খাওয়ানোর জন্য বাড়িয়ে বলছে, ভুল বলছে। তারা আসলেই দ্বিধান্বিত হয়ে যায়! তাই মিলেনিয়াল শিশুদের সঠিক ভাবে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে।

উপরোক্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলো আরো কঠোর, শক্তিশালী করতে হবে। যেমন ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট অ্যাক্ট আরো কঠোরভাবে কার্যকরী করতে হবে। অন্যদিকে, শিশু খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি যেন বেশি ইন্সেন্টিভ দিয়ে মিডিয়াগুলোকে কিনে না নেয় এদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। নাটক, সিনেমা যেমন সেন্সর বোর্ড পাস হয় তারপর প্রচার বা প্রদর্শিত হয় তেমনি বিজ্ঞাপনগুলোও সেন্সর বোর্ড পাস হবে তারপর বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় যাবে এমন নিয়ম করা প্রয়োজন। এই ডিজিটাল যুগে যেখানে আলফা বা আই জেনারেশন এর শিশুরা ব্যাপকভাবে মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় তাই "The Undesirable Advertisements Control Act, 1952" পরিমার্জন করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু এইসব আইন কানুন কার্যকরী হবে না যদি আমরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে নিজেরা দায়িত্বশীল না হয়, সচেতন না হয়, সৎ না হয়!

সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের একটা রিপোর্ট দেখে খারাপ লাগলো। কিছু ফুড ইন্ডাস্ট্রি কতিপয় রিসার্চারদের মোটা অংকের ইন্সেন্টিভ দিয়ে রিসার্চ ফলাফল তাদের খাদ্য পণ্যের পক্ষে নিয়ে যায়। যেটা কিনা সাংঘর্ষিক। এগুলো কোন ভাবেই কাম্য নয়। খাদ্য গবেষক, খাদ্য শিল্প মালিক, খাদ্য দ্রব্য উৎপাদনকারী, সবার যদি নীতি-নৈতিকতাই দুর্যোগ নেমে আসে, ধ্বস নেমে যায় তাহলে আসলে আমাদের সন্তানদেরকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। পাশাপাশি মিড়িয়ারও সামাজিক দায়বদ্ধতা ভুলে গিয়ে অতিরঞ্জিত, ভুলভাল তথ্য সম্বলিত বিজ্ঞাপন প্রচার করা উচিত হবে না। এটা আসলে একটা সামাজিক আন্দোলনের মতো বিষয়। চেইন অব পজেটিভ অ্যাকশন যদি না থাকে তাহলে একটা পুষ্টিসমৃদ্ধ, শিক্ষিত জাতি গঠন কঠিন হবে।

চলুন আমরা নিজেরা বদলে যাই, অন্যকে বদলে দেই।