এ আগুন পদ্ধতিগত, পদ্ধতি পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সমাধান আসতে পারে

কে এ এম মোরশেদ
Published : 30 March 2019, 07:38 AM
Updated : 30 March 2019, 07:38 AM

আবার অগ্নিকাণ্ড! এবার পুরান ঢাকার জীর্ণ-ঘুপচি বাড়িতে নিতান্ত কম পুঁজির ব্যবসা-কারখানায় নয়—বরং প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ উল্টো। নতুন ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা, এখানে আছে আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্যের দপ্তর, আছে বাসিন্দাদের সামর্থ্য, জ্ঞান, সক্ষমতা। এখানে যারা কাজ-কর্মে আসেন, তাদের বেশির ভাগই শিক্ষিত—হিল্লি-দিল্লি ঘুরে বেড়ানো মানুষ। তারপরও চিত্র একই। হঠাৎ আগুন—অসহায় আটকে পড়া মানুষ, চওড়া রাস্তার পাশে পানি-শূন্য আগুন-নেভানোর গাড়ি। কেন এমন হয়?

এই প্রশ্নের একটা উত্তর হলো, এগুলি পুঁজিপতিদের অতি মুনাফাখোরী মনোভাবের প্রতিফলন। আমি পত্রিকান্তরে যা দেখছি, তাতে এফআর টাওয়ারের মালিককে বলির পাঁঠা বানাবার কাজ প্রায় শেষ—যেন এত শত বহুতল ভবনের মধ্যে একমাত্র এই মালিকই দোষী—এই একজন সুচতুর, লোভী, অসৎ ব্যক্তিই শুধু রাজউক অনুমোদিত নকশা না মেনে ভবন নির্মাণ করেছেন—অতএব এই দুর্জনকে শাস্তি দিলেই হলো, বাকি শত-শত বাড়ির মালিকরা সব ধোয়া তুলসী পাতা। বলা হচ্ছে, অর্থলোভী এই ভবন মালিক তার ভবনে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখে নি। আর ভবনে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল তাদের মালিকরাও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছিলেন। কিন্তু গল্পটা কি এতই সরল?

কোনো ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে অতিরিক্ত অর্থ লাগে, সেই অর্থ কে দেয়? বাড়িওয়ালা? না, দেয় ভাড়াটিয়া। ভাড়াটিয়ারাও তো নিজেদের পকেট থেকে দেয় না, তারা এই টাকা নেয় তাদের পণ্য/সেবার গ্রাহকের কাছ থেকে? ধরুন, এফ আর টাওয়ারের একটি ট্রাভেল এজেন্সি যদি গ্রাহককে বলত যে তারা এজেন্সির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্নি নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি টিকিটের উপর ৫ টাকা বেশি ধার্য করবে, তা হলে গ্রাহকরা কি দিত? আমার ধারণা দিত না। আর কর্মচারীদের ঝুঁকির কথা বলবেন? বা এই যে এত বড় ঘটনা ঘটল। আগামী রবিবার এফআর টাওয়ারের মত আর যত অফিসে যারা দিন-কাবারি চাকরি করেন তারা কি অফিসে ঢোকার আগে দেখে নেবেন যে তাদের ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কাজ করে কি না? আবারো, আমার সন্দেহ আছে।

আরেকটা উত্তর হল, সরকারের আইন প্রয়োগের শিথিলতা। এই উগ্র-পুঁজিবাদী যুগে, আমার তো মনে হয়, সরকার কেন, কেউই আইন প্রয়োগ করতে পারবে না। এ যুগের সেক্যুলার আইনবেত্তাদের মধ্য অন্যতম হলেন এইচ, এল, এ, হার্ট। তার বিখ্যাত তত্ত্বের সার কথা হলো, আইন আর নৈতিকতা দুটি ভিন্ন জিনিস—এদের উৎসও ভিন্ন। তার মতে আইন হলো একটি সামাজিক বিনির্মাণ (social construction)। সমাজের বেশিরভাগজন যদি কোনো একটি আইন মানে, তবেই শুধু আইন ভঙ্গকারীকে ধরা যায়। কিন্তু যখন ঝিলের মাঝে ব্যবসায়ীদের সংগঠনের দপ্তর বীর দর্পে দাঁড়িয়ে থাকে, আবাসিক এলাকায় তাবৎ রাজনৈতিক দলে দপ্তর বিস্তার লাভ করে, মতিঝিল-বনানী-ধানমন্ডিতে প্রায় কোনো বহুতল অফিস ভবনেরই আগুন নেভাবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নাই অথবা থাকলেও কাজ করে না, প্রায় সকল আধুনিক আবাসিক ভবনই নকশা থেকে সামান্য হলেও বিচ্যুত, তখন ধরে নেওয়া যায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালাটি সামাজিকভাবে নিগৃহীত।

মোদ্দা কথা হলো, বনানীর এই অগ্নিকাণ্ডে আমাদের সকলের ভূমিকা আছে—আমরা যারা ভবন মালিক, আমরা যারা ওই ভবনে অফিস চালাই, ঐ সব অফিসে চাকরি করি, বা ঐ সব অফিসে থেকে পণ্য/সেবা কিনি বা বেচি, সবাই এই আগুনের জন্য দায়ী। তবে সবচেয়ে দায়ী সরকার—যার দায়িত্ব হলো এই সব সুবিধাভোগী গোষ্ঠী যারা একটি সাধারণ সাম্যাবস্থা (General Equilibrium) তৈরি করে সামাজিক ভাবেই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা উপেক্ষা করছি তাদের এই সাম্যাবস্থা ভেঙ্গে নতুন সাম্যাবস্থানে পৌঁছাতে বাধ্য করা।

কীভাবে সেটা সম্ভব? আমি নিশ্চিত আমার চেয়ে সরকারে বা প্রশাসনের যারা আছেন তারা আরো ভালো জানেন। তবে, সসংকোচে আমি একটা মত প্রকাশ করতে চাই।

এমন হতে পারে যে, প্রথম অবস্থায় প্রতিটি রেজিস্ট্রার্ড কোম্পানির দপ্তরকে বাধ্যতামূলকভাবে সর্বাঙ্গীন ভবন বিমা (Comprehensive building insurance) নিতে বাধ্য করা। বড় ব্যাংক-ঋণের জন্যও এই বিমা বাধ্যতামূলক করা যায়। এই বিমার পলিসির শর্ত হিসাবে প্রয়োজনীয় ইমারত সুযোগ-সুবিধা ও রক্ষণাবেক্ষণ (facilities and maintenance)-সংক্রান্ত বিধি সংযুক্ত করা যায়। বিমা কোম্পানিগুলো নিজ স্বার্থেই এইসব ভবন পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে পরিদর্শন ও সংরক্ষণের জন্য চাপ দিবে। ভবনের সামনেই ভবনটি কোন বিমা কোম্পানী কর্তৃক বিমাকৃত ও ভবনের নিরাপত্তা পরিদর্শন-সংক্রান্ত তথ্য প্রদর্শন করতে হবে। বিমা কোম্পানিগুলো নিয়মিত তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদন জয়েন্ট-স্টক রেজিষ্ট্রার ও সিকিউরিটিজ-এক্সচেঞ্জ কমিশনে দিবে। এই সংক্রান্ত জোচ্চুরি ঠেকাবার জন্য অবশ্যই বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

মূল কথা হলো, যেহেতু আগুন লাগলে বিমা কোম্পানির ক্ষতি হবে, কাজেই তারা তৎপর থাকবে যাতে ভবন মালিকগণ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেন। আবার অগ্নিনির্বাপণ ঝুঁকির উপর যেহেতু বিমার চাঁদার পরিমাণ নির্ভর করবে—সেহেতু ভবন মালিকরাও চাইবেন ঝুঁকি কমাতে। এই পদ্ধতি প্রথম-প্রথম বড় কোম্পানির বেলায় চালু করা গেলে পরে হয়েতো সকল ভবনের জন্যই করা যাবে।

তবে এই জাতীয় যে কোনো কিছু করার আগে যেটা করতে হবে তা হলো, এই একটি ভবন—সেটির মালিক—সেটির অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ইত্যাদি আলোচনার বাইরে আসতে হবে—একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে সকল দোষ দেবার প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। সমস্যা পদ্ধতিগত (systemic) এর সমাধানও পদ্ধতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। সমস্যাটার মূলে যাবার মানসিকতা নিয়ে একটা সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজতে হবে। শুধু তাহলেই হয়তো একটা পথ বের হতে পারে-না হলে পরের ঘটনার জন্য তৈরি থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।