মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংগ্রামে উদীচী

অমিত রঞ্জন দেঅমিত রঞ্জন দে
Published : 27 March 2019, 10:35 AM
Updated : 27 March 2019, 10:35 AM

ষাটের দশকের প্রথমদিক থেকে সামরিক শাসন বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়তে থাকে বাংলার জনগণ। তারুণ্যের দীপ্ত তেজে থরথর করে কেঁপে উঠে রাজপথ। পুলিশের পথরোধ, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার কুণ্ডলী, ব্যারিকেড ছিল নৈমিত্তিক দৃশ্য। গগনবিদারী শ্লোগান, পুলিশের লাঠিচার্জ জন্ম দেয় এক উত্তাল সময়ের। এক কালজয়ী গণ-অভ্যুত্থান উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকে। সেই উত্তাল সময়েই নিপীড়িত মানুষের গান গাইবার অঙ্গীকার নিয়ে গণসংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক, শিল্পীসংগ্রামী সত্যেন সেনের নেতৃত্বে জন্ম নেয় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে ঢাকাসহ সারা দেশ যখন উত্তাল মিছিল-মিটিং, শ্লোগান, গণসংগীতে­- সেই উত্তাল সময়ে মানুষকে জাগানোর জন্য এবং বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে কৃষক-শ্রমিকদের সভায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাকের উপর চেপে উদীচীর শিল্পীকর্মীরা পরিবেশন করতো গণসঙ্গীত, প্রদর্শন করতো পথনাটক। বাংলার নিপীড়িত মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার মুক্তিসংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। এই যুদ্ধের পটভূমি রচনায় শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-সংবাদিকরাও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। উদীচীর শিল্পীকর্মীরা একদিকে যেমন নিপীড়িত ছাত্র-জনতা আর শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রামে মেলবন্ধন তৈরি করেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে রাইফেল হাতে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে।

১৯৬৯ এর ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ স্বৈরাশাসক আইয়ুব শাহীর পুলিশের গুলিতে নিহত হলে দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে ঢাকা নগর ও শ্রমিক অঞ্চলে উদীচী 'শপথ নিলাম' নামে একটি পথনাটক নিয়ে পথে নামে । রাস্তায় তখনো পুলিশের লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস। কিন্তু উদীচীর তরুণ কর্মীরা সকল রকমের নির্যাতন ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। মঞ্চস্থ করে পথনাটক 'শপথ নিলাম'। উদীচী কর্মীরা নিউমার্কেট কাঁচাবাজার সেকেন্ড গেট, বিএমএ মাঠ, বায়তুল মোকাররম চত্বর, সদরঘাট টার্মিনালের পাশে, ধুপখোলা মাঠে, কমলাপুর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, বাংলা একাডেমি বটমূলে, ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে, বাওয়ানী ও আদমজী জুট মিল মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে এই পথনাটক নিয়ে উল্কার বেগে ছুটে বেড়ায় এবং গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। নাটক শেষে উপস্থিত আপামর জনতা মুহুর্মুহু করতালিতে একে অভিনন্দিত করেছে। 'জয় বাংলা' শ্লোগানে ফেটে পড়েছে ওই নাটকের নায়কের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে। এইভাবে ঊনসত্তুরের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনায় নাটকের মাধ্যমে, গণসংগীতের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে প্রেরণা বা প্রাণাবেগ সঞ্চার করেছে, সাহস যুগিয়েছে উদীচী। (তথ্যসূত্র: উদীচী থেমে থাকতে জানে না, আখতার হুসেন, উদীচীর নিয়মিত নাটক "হইতে সাবধান" নাটকের জন্য ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত স্যুভেনির।)

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরেই রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরায় শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। উদীচীর কর্মীরাও এই প্রস্তুতিতে অংশগ্রহণ করে। কখনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, কখনো পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এই সময়ে গানের পাশাপাশি উদীচীর নাটক বিভাগও রাস্তায় নেমে আসে নতুন পথনাটক নিয়ে। মিশে পড়ে জনগণের সাথে। নাটকের নাম 'সামনে লড়াই'। রচনা ও নির্দেশনা দেন আখতার হুসেন। এ নাটকটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়সহ আদমজী, কাঞ্চন, ডেমরা, শ্যামপুর, নারায়ণগঞ্জ, রায়পুরা ও নরসিংদির বিভিন্ন কৃষকদের মাঝে। শ্রমিক ও কৃষক এলাকাগুলোতে যখনই এই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তখনই সেই এলাকাবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে অভূতপূর্ব সাহায্য সহযোগিতা। তারা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে চৌকি খাটিয়ে মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে, রাত্রে নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে তারা নিজেরাই চাঁদা তুলে হ্যাজাক বাতি ভাড়া করে এনে মঞ্চের চারপাশ আলোকিত করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের জন্য কিছু করা হলে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া তাতে মিলবেই। উদীচী বারবার এ সাড়ায় ধন্য হয়েছে। উদীচী এ জন্য গর্বিত। (তথ্যসূত্র: উদীচী থেমে থাকতে জানে না, আখতার হুসেন, উদীচীর নিয়মিত নাটক "হইতে সাবধান" নাটকের জন্য ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত স্যুভেনির।)

এরপর ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে জনগণের হাতে হাত রেখে উদীচীর শিল্পীকর্মীরাও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। সে লড়াইয়ে যেমন সংগ্রামী চেতনার উপস্থিতি ছিল ঠিক তেমনি নান্দনিকতাও স্থান পেয়েছে সমভাবে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে উদীচীর ট্রাকস্কোয়াড বের হয়। যার ব্যাকগ্রাউন্ডে আঁকা থাকে সূর্যের মাঝখানে শৃঙ্খলিত হাত। সূর্যটি যেন কাঁটাতারের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসছে। পাশে শহীদ মিনার। শ্লোগান লেখা- 'একুশের শোককে শক্তিতে পরিণত করুন'। এ সময় 'একুশের গান' নামে উদীচী একটি গানের সংকলন বের করে (দৈনিক সংবাদ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১)। এর মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলমুক্তির লড়াইয়ে উদীচী তাঁর উপস্থিতি একে একে জানান দিতে থাকে। ক্রমান্বয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ঘনীভূত হতে থাকে। উদীচীর শিল্পীকর্মীরাও মাঠে নেমে আসে। ৫ মার্চ ১৯৭১ বাংলার জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমর্থনে উদীচী এক মিছিল বের করে। মিছিলটি নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে এবং গুলিস্তান, নয়াপল্টন, জিন্না এভিনিউ, সেগুনবাগিচা এলাকায় পথ সভা করে। উদীচীর সভাপতি সত্যেন সেন সভাসমূহে বক্তৃতাকালে দেশের বর্তমান দুর্যোগ মুহূর্তে সকল প্রগতিশীল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের গণআন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান (দৈনিক সংবাদ, ৬ মার্চ ১৯৭১)। ৬ মার্চ ১৯৭১ উদীচীর শিল্পীকর্মীরা আবার গণমিছিল বের করে। ৬ মার্চে সংবাদে বলা হয়, গণহত্যার প্রতিবাদে এবং গণআন্দোলনের সমর্থনে উদীচীর উদ্যোগে আজ সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররম থেকে গণমিছিল গুলিস্তান, টিকাটুলি প্রভৃতি স্থানে পথসভা করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ হবে। পরের দিনের সংবাদে প্রকাশিত হয় বায়তুল মোকাররমে উদীচীর গণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন রণেশ দাশগুপ্ত, ইকরাম আহমেদ, কামরুল আহসান খান। ১০ মার্চ ১৯৭১ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রদানের মাধ্যমে সংকল্প গ্রহণ করে, যা পরের দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

সাংস্কৃৃতিক প্রতিষ্ঠান 'উদীচী' বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সহিত আগাইয়া যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করিয়াছে। উদীচীর সাধারণ সম্পাদক প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয় সৈনিকসুলভ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা লইয়া বাংলার এই স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমরা শরিক থাকিব। (দৈনিক সংবাদ, ১১ মার্চ ১৯৭১)

১০ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়-

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে শহরের পাঁচটি এলাকায় পথিপার্শ্বে গণসঙ্গীতের আসর ও নাট্যানুষ্ঠান। নাটক মঞ্চস্থ হবে খোলা ট্রাকের উপর। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বেলা ৪টায় অনুষ্ঠান শুরু। এরপর বেচারাম দেউড়ী, হাজারীবাগ, মগবাজার ও মালীবাগে অনুষ্ঠিত। নাটকের নাম 'শপথ নিলাম'। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র-২য় খণ্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, পৃষ্ঠা-৮২৮।)

১২ মার্চ বিকেল ৫ টায় জিন্না এভিনিউ থেকে আবার বের হয় উদীচীর গণসংগীত স্কোয়াড। (দৈনিক সংবাদ ১২ মার্চ ১৯৭১, বাংলাদেশের  স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র-২য় খণ্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, পৃষ্ঠা-৮২৭) গণসংগীত স্কোয়াডের পাশাপাশি উদীচীর পথনাটক 'সামনে লড়াই' মঞ্চস্থ করতে থাকে। কৃষক-শ্রমিক ভাইয়েরা নিজেরাই চাঁদা তুলে এ নাটকের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন বিভিন্ন স্থানে। এ সময় উদীচীর আলাদা আলাদা কোনো বিভাগ ছিল না। যে শিল্পীরা গান করতেন তারাই আবার নাটক করতেন। কেউ কেউ আবার আবৃত্তি পরিবেশন করতেন। এ সময় উদীচীর শিল্পী কর্মীরা গান, নাটকের পাশাপাশি সিকান্দার আবু জাফরের 'বাংলা ছাড়ো' এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য' কবিতা দুটি বেশি বেশি আবৃত্তি করতেন। ১৫ মার্চ ১৯৭১ আবার ট্রাকযোগে উদীচীর শিল্পীকর্মীদের স্কোয়াড বের হয়। এই স্কোয়াডটি সদরঘাট, লালবাগ, হাজারীবাগ, মগবাজার, মালীবাগ ও নবাবপুর, রেলগেট এলাকায় গণসংগীত ও পথনাটক 'শপথ নিলাম' পরিবেশন করে। নাটকটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আলোকে রচিত (দৈনিক সংবাদ, ১৬ মার্চ ১৯৭১)। ১৮ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে গত পরশু সদরঘাট টার্মিনাল, হাজারীবাগ, মগবাজার ও শান্তিনগর এলাকায় গণসংগীত, গণনাট্য অনুষ্ঠান ও পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র-২য় খণ্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, পৃষ্ঠা-৭৫৯)। ১৮ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় আবারও প্রকাশিত 'বাংলা একাডেমি'তে লেখক সংগ্রাম শিবিরের কবিতা পাঠের আসরের পর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে পনেরো মিনিটের একটি নাটিকা মঞ্চস্থ করা হয়। সভাপতিত্ব করেন ড. আহমদ শরীফ'। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র-২য় খণ্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, পৃষ্ঠা-৭৭৯) এভাবে স্বাধীনতাসংগ্রামের সম্মুখযুদ্ধ আরম্ভের পূর্ব পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে 'উদীচী'র পথ চলা আরো উজ্জীবিত করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে।

তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল হাতে সরাসরি যুদ্ধে নামে উদীচীর শিল্পীকর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধের এই সূচনা পর্বে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে 'উদীচী' উজ্জীবিত করেছে স্বাধীনতার আন্দোলনকে। গেরিলা বাহিনীর প্রথম ব্যাচেই অংশগ্রহণ করেন (সবার নাম যুক্ত করা আজ সত্যি দূরহ ব্যাপার, অনেকের নাম বাদ পড়ে যাওয়ার আশক্সক্ষা, সঠিক নাম দিতে না পারা তবু চেষ্টা করা হলো) উদীচীর প্রথম আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক কামরুল আহসান খান। সেদিন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মনজুরুল আহসান খান, মোনায়েম সরকার, সেন্টু রায়, খাইরুল আহসান খান, সফিকুল ইসলাম গোলাপ, রঞ্জু সরকার, সনৎ কুমার ঘোষ (নেত্রকোনা) প্রমূখ। রাইফেল হাতে যুদ্ধ করার পাশাপাশি যুদ্ধে শ্রান্ত, ক্লান্ত সৈনিককে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে ক্যাম্পের মধ্যেই তারা গেয়ে উঠতেন- 'গেরিলা, আমরা গেরিলা', ধিতাং ধিতাং বোলে মাদলে তাল তোলে', ঝঞ্ঝা ঝড় মৃত্যু দুর্বিপাক, ভয় যারা পায় তাদের ছায়া দুর মিলাক', 'উঠলোরে ঝড় দিন বদলের পালা এলো, জাগলো মানুষ দিন বদলের পালা এলো'- এ রকম সব গণসংগীত।

১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর। মুক্ত স্বদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ গৌরবজনক স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের সংগ্রাম। মুক্ত স্বদেশে উদীচীর শিল্পী সৈনিকেরাও অস্ত্র জমা দিয়ে আবার হাতে তুলে নেয় ঢোল, করতাল, হারমোনিয়াম, তবলা, নাটকের পাণ্ডুলিপি। এবার দেশ গড়ার সংগ্রাম। সে সংগ্রামে শরীক আর সবার মত উদীচীর শিল্পীকর্মীরাও। উদীচীর সেই কর্মকাণ্ডে অন্যান্যদের মত যুক্ত হন অসংখ্য বীরমুক্তিযোদ্ধা। যারা উদীচীর সংগ্রামে আরো গতি সঞ্চার করেন।এদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদ সেলিম, আলী ইমাম দুলাল (জামালপুর), মোফাখ্খারুল ইসলাম জাপান, মনজুর আলী নন্তু, শ্রমিকনেতা সিদ্দিক আহমেদ, মহসীন, ডা. আবু বকর (গেণ্ডারিয়া), রতন কুমার দাশ, শেখ আব্দুল হান্নান (উত্তরা), ডা. সৈয়দ খলিল উল্লাহ (টঙ্গী), আব্দুল মান্নান (টঙ্গী), মো: শহীদুল্লা (টঙ্গী), আবু সাত্তার আবু (টঙ্গী), মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (টঙ্গী), মো: গিয়াসউদ্দিন (টঙ্গী), মো: জসিম উদ্দিন (টঙ্গী), মো: বছির উদ্দিন (টঙ্গী), আলফজ উদ্দিন আলফু(টঙ্গী), আজিজুল মালিক (কানাডা প্রবাসী), রেখা রাণী গুণ, শাহজামাল তোতা, অরুণ কুমার দেবনাথ (ভোলা), মাহফুজ রিপন (মুন্সিগঞ্জ), হারুণ (যাকে মেজর নামে ডাকা হত) অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ (কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ), এ্যাড. মোহাম্মদ শাহজাহান (বরগুনা), অমলেন্দু হাওলাদার (রাঙামাটি), হরেন্দ্রনাথ মণ্ডল (গোপালগঞ্জ), শেখ এ কে এম মজিবুর রহমান (ময়মনসিংহ), মানিক চন্দ্র সাহা (খুলনা), স ম হোসেন (দৌলতপুর, খুলনা) অমল কান্তি নাথ (চট্টগ্রাম), ডা. কাজী রবিউল হক (যশোর), এ্যাড. কাজী আব্দুস শহীদ লাল (যশোর), কাজী দুলু (যশোর), অশোক সেন (যশোর), তোফাজ্জেল আহম্মদ (যশোর), আমিরুল ইসলাম রন্টু (যশোর), আফজাল হোসেন দোদুল (যশোর), মকবুল হোসেন (যশোর), মনিরুল ইসলাম খান পিলু (যশোর), রবিউল আলম (যশোর), ডা. ইয়াকুব আলী মোল্লা (যশোর), একরাম-উদ-দ্দৌলা (যশোর), রুকুন-উদ-দ্দৌলা (যশোর), রুহুল হক খোকা (যশোর), মুজিবুর রহমান বাদল (ফরিদপুর), অধ্যাপক আব্দুল মোতালেব (ফরিদপুর), প্রয়াত মো: সিরাজুল ইসলাম (ফরিদপুর), আমিনুর রহমান ফরিদ (ফরিদপুর), কমলেশ চক্রবর্তী (ফরিদপুর), মো: আবুল ফয়েজ (ফরিদপুর), বেদানন্দ ভট্টাচার্য (সিলেট), প্রয়াত মো. নুরুজ্জামান (সিলেট), প্রয়াত অসিত চক্রবর্তী অঞ্জন (সিলেট), পুরঞ্জয় চক্রবর্তী বাবলা (সিলেট), ব্রজেন্দ্র কুমার দাস (সিলেট), রফিকুর রহমান লজু (সিলেট), এ্যাডভোকেট তবারক হোসেইন (সিলেট), প্রয়াত প্রফেসর আতিয়ার রহমান মোল্লা (বাকৃবি), প্রাক্তণ উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন (বিপ্রবি, পটুয়াখালী), আলী আসগর ফটু (বগুড়া), মাহমুদুস সোবহান মিন্নু (বগুড়া), সন্তোষ পাল (বগুড়া), প্রয়াত মীর্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু (দিনাজপুর), ডা. সৈয়দ খলিলুল্লাহ (দিনাজপুর), আব্দুস সাত্তার (দিনাজপুর), মহিউদ্দিন আহমেদ মোহন (দিনাজপুর) প্রমুূখ।

মুক্তিযুদ্ধের যে বহুমাত্রিকতা তাকে সফল করে তুলতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার পাশাপাশি আরো নানামুখি সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে সংগ্রামের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। সে সংগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় অর্জনের গৌরব গাঁথা সংবাদ পরিবেশন, অগ্নিঝরা গণসংগীত, কবিতা, কথিকা, পরিবেশন, চরমপত্র পাঠ এর মধ্যদিয়ে বাংলার মুক্তিযুদ্ধে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই স্বাধীনবাংলা বেতারের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই উদীচীর সাথে যুক্ত ছিলেন বা পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন সৈয়দ হাসান ইমাম (সালেহ আহমেদ নামে খবর পড়তেন), কামাল লোহানী, মঞ্জুশ্রী দাশগুপ্তা, তিমির নন্দী, প্রয়াত মিহির নন্দী (চট্টগ্রাম), প্রয়াত প্রবাল চৌধুরী (চট্টগ্রাম), বেগম মুসতারী শফী (চট্টগ্রাম), বাণী চৌধুরী (চট্টগ্রাম), মৃণাল ভট্টাচার্য (চট্টগ্রাম), কাজল দে (চট্টগ্রাম), দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় (খুলনা), আবুল কাশেম সন্দীপ (সাভার), প্রয়াত অধ্যাপক সুধীর দাশ (ময়মনসিংহ) প্রমুখ। এছাড়াও বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী সহায়ক শিল্পী সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন আলোকময় নাহা (ময়মনসিংহ), রঞ্জিত নিয়োগী (শেরপুর), স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের আরো একটি সহযোগী গানের দল 'সংগীতায়ন' এর সাথে যুক্ত ছিলেন কুমারেশ নাগ (ময়মনসিংহ)।

মুক্তিসংগ্রামের এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে উদীচীর শিল্পীকর্মীরা পর্যবেক্ষণ করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতার আলোকে উদীচী ১৯৭২ এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে মুক্ত স্বদেশে উদীচী গ্রহণ করে ব্যাপক কর্মসূচি। প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানায় ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিআন্দোলনের শহীদের স্মরণে এ দেশের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী মানুষের জীবনের উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন গণসংগীত রচনার। (দৈনিক সংবাদ, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বিকেল ৪টায় সত্যেন সেন-এর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোচনা সভা কবিতা পাঠের আসর, গীতিনকশা এবং পথনাটক পরিবেশিত হয়। (দৈনিক সংবাদ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সত্যেন সেন এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলোচনা করেন সন্তোষ গুপ্ত, খালেদ চৌধুরী, শেখ লুৎফর রহমান, ইকরাম আহমেদ। আলোচনা শেষে পরিবেশিত হয় গীতি নকশা ''রক্তে ভেজা লাল সকাল'', আখতার হুসেন-এর নাটক 'পোস্টার'। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২:০১ মি. থেকে ভোর পর্যন্ত উদীচীর শিল্পীরা আয়োজন করে সংগীতানুষ্ঠানের। এছাড়াও ২৩ ফেব্রুয়ারি বাওয়ানী জুট মিলে, ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গোপীবাগে এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় খিলগাঁওয়ে উদীচী একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার পাশাপাশি দেশ গড়ার সংগ্রামে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার আহবান জানিয়ে আখতার হুসেন নির্মাণ করলেন নাটক 'রক্তের ইতিহাস'। স্বাধীন দেশে এটিই সম্ভবত প্রথম পথনাটক। এ নাটকের মধ্য দিয়ে উদীচীর শিল্পীকর্মীদের সাথে শ্রমিকদের সরাসরি সম্পর্ক গড়ে উঠে। শ্যামপুর থেকে বেশ ক'জন শ্রমিক উদীচীতে যাতায়াত শুরু করে এবং উদীচীর শিল্পীকর্মী হিসেবে সংগীত ও নাটকে যোগ দেন। এই সময়ই উদীচী আর একটি পথনাটক পরিবেশন করে যার নাম 'সাচ্চা মানুষ চাই'। দেশ গড়তে মজুতদার, মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সাচ্চা মানুষের প্রয়োজনীয়তার কথা বিধৃত ছিল এই নাটকে। উদীচীর সভাপতি প্রয়াত সত্যেন সেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ও শরণার্থী শিবিরে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা নিয়ে লেখেন 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ'। যা আজও মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল হিসেবে পরিগণিত।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রেও উদীচী কখনো ভুলে যায়নি মুক্তিযুদ্ধ চারটি স্তম্ভ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। বারবার সাম্প্রদায়িক ও সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেছে। তাই তো ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধী একটি চক্র যখন দেশকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তিন নভেম্বর হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। একের পর এক জাতি প্রত্যক্ষ করতে থাকে ক্যু-এর ঘটনা। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সমগ্র জাতি, সারাদেশে বিরাজ করতে থাকে স্থবিরতা। রাজনেতিক সামাজিক সকল কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে। সর্বত্র এক শূণ্যতা দেখা দেয়। সাধারণ মানুষ অতিবাহিত করতে থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন। কিন্তু পালিয়ে বাঁচতে জানে না উদীচীর শিল্পীকর্মীরা। অচিরেই সংগঠিত হয়। '৭৫ এর আগস্ট থেকে '৭৫ এর ডিসেম্বর। মাত্র ৫ মাস। সারাদেশ তখন স্তব্ধ, মূক। কেউ কোনো কথা বলে না। উদীচীর শিল্পীরা শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানে গান ধরেছে সমবেত কণ্ঠে, 'এদেশ বিপন্ন আজ।' সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে শিল্পী অজিত রায়ের সুর করা গান। পরের গান সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে, 'প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা।' পরের গান মুকুন্দ দাশের 'ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে'। এরপর ১৯৭৬ এর একুশের অনুষ্ঠান। সেন্টু রায়ের পরিকল্পনায় ৬ ফুট উচ্চতায় খালি মাইক্রোফোন, ডায়াসে পাইপ আর চশমা রেখে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ। এর পর পরই মাহমুদ সেলিমের নেতৃত্বে রচিত হয় গীতিআলেখ্য 'ইতিহাস কথা কও'। লোকজ ফর্মে ও সুরে এই গীতিআলেখ্যের ভিতর দিয়ে প্রচণ্ড সাহসের সাথে উদীচী বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর অবদান, তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ তুলে ধরে। এটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৭৬ এর ১৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ইস্পাহানী কলেজের মাঠে। এর পরে ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রমনা বটমূলে "ইতিহাস কথা কও" এর নির্ধারিত মঞ্চায়ন যখন নিষিদ্ধ হয় তখন সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনের রাস্তায় ১৫/২০ হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চায়িত হয় "ইতিহাস কথা কও"। তারপর সারাদেশের আনাচে-কানাচে উদীচীর ২ শতাধিক শাখার মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য "ইতিহাস কথা কও" কয়েক সহস্রবার মঞ্চায়িত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর সনজীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত কবি মতিউর রহমান স্মারক বক্তৃতা প্রদানকালে বলেছেন-

উনিশশো আটষট্টি সালে 'উদীচী' সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হলো। এ প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য, এর উদ্যোক্তা সত্যেন সেন জনচেতনা উদ্বোধনে সংস্কৃতিকে কাজে লাগাতে চাইলেন। সর্বসাধারণকে জানাবার কথাগুলো সুরে-ছন্দে রপ্ত করে, কেবল ঢাকা নয়, দেশের সকল স্থানে গণসংগীতের দৃপ্ত আঘাতে আঘাতে মানুষকে জাগাবার জন্যে এঁরা সংঘবদ্ধ হলেন। গানের সুরে মানুষকে যত আকর্ষণ করা যায়, শুকনো কথা দিয়ে তা করা যায় না। 'উদীচী'র গণজাগরণ ঘটাবার চেষ্টা সেইজন্যে খুবই গুরুত্বপুর্ণ। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে রাজাকার আলবদর পুনর্বাসনের যে উদ্যোগ ভয়াবহ রূপ নেয়, তার স্বরূপ তুলে ধরে ব্যঙ্গাত্মক গান গেয়ে 'উদীচী' এক গুরুদায়িত্ব পালন করেছে। গ্রামীণ সুরে কথকতার ভঙ্গিতে 'উদীচী'র 'ইতিহাস কথা কয়' (কও হবে) নাটক তথা পালাটির ভূমিকা এক্ষেত্রে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। জেলায় জেলায় এঁদের শাখাগুলো মানুষকে জাগিয়ে তুলবার কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। (প্রফেসর সনজীদা খাতুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত কবি মতিউর রহমান স্মারক বক্তৃতামালার 'বাংলাদেশের সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাই' শীর্ষক ষষ্ঠ বক্তৃতা ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ)

এ সময় পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা ও সাম্প্রদায়িকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা শুরু হলে উদীচী তার বিরুদ্ধেও সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ১৯৭৮ সালের দিকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে চেতনাকে সমুন্নত রাখতে উদীচীকর্মী আলী রেজা খোকনের কথা ও সুরে উদীচীর শিল্পীদের গাওয়া একটি গান সেসময়কার অনুষ্ঠানের প্রাণ হয়ে ওঠে-

'জীবন মোদের দুর্বিসহ কইরা তুলছে রাজাকার
মুক্তিযুদ্ধের সেই হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।।
আমার শনের ঘরখানাটি
দিছে যে জ্বালাইয়া
পুড়ছে কতো কোরান-কিতাব
গেছ কি ভুলিয়া
আর দেব না করতে তাদের
এমনধারা অত্যাচার।। (তথ্যসূত্র: বিষয়বৈচিত্র্য: স্বাধীনতা ও পরবর্তীকাল, বাংলাদেশের গণসংগীত, সাইম রানা)

নব্বই-এর গণআন্দোলোনের মধ্য দিয়ে এরশাদশাহীর পতনের পর কেবল উদীচী নয়, গোটা জাতি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। উদীচীর শিল্পীকর্মীরা ২৭, ২৮, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ মিলিত হয় নবম জাতীয় সম্মেলনে। সম্মেলনে যে কতিপয় করণীয় নির্ধারণ করে তার প্রথমটি হলো-

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে। একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা জন্মলাভ করে বিকৃত চিন্তা থেকে, চিন্তার এই বিকৃতি দূর করার জন্য উদীচীর ব্যাপক সাংস্কৃতিক তৎপরতা পরিচালনা করা প্রয়োজন। তাছাড়া আত্ম অনুসন্ধান ও আত্ম পরিচয়ের মাধ্যমে আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে চিন্তার ক্ষেত্রে এই বৈকল্য দূর করা সম্ভব। লোকসংগীত উৎসবকে আরো ব্যাপকভাবে সাফল্যমণ্ডিত করারও উদ্যোগ প্রয়োজন। (সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন, নবম জাতীয় সম্মেলন, সেপ্টম্বর ১৯৯১)

এ সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র প্রকাশ করে 'একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়'। এই গ্রন্থটিকে মূল ধরে মোফাক্খারুল ইসলাম জাপান-এর রচনা ও নির্দেশনায় উদীচী মঞ্চস্থ করে পথনাটক 'রাজাকারের পাঁচালী'। এ নাটকটি ১৯৯১ সালে নির্মিত হয়। ১৯৯১ সালে 'ইঁদুরে কিসসা' নামে আরো একটি নাটক নির্মাণ করে উদীচী। আমরা একধরনের ইঁদুরকে চিনি, যারা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে সম্পদ। কিন্তু আমাদের সমাজে আরো অনেক ধরনের ইঁদুর গোত্রীয়রা রয়েছে যারা আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করছে, সমাজটাকে খেয়ে ফেলছে। এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ জয় ছিনিয়ে এনেছে বারে বারে। কিন্তু এই ইঁদুর শ্রেণীর সমাজ নেতাদের কারণে সে জয়ের কোনো হিসেব নেই। এদেরকে চিহ্নিত করা এবং ধরার আহবান জানিয়ে রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা রচনা করেন ইঁদুরের কিসসা। নির্দেশনা দেন সাবাব আলী আরজু। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এলাকার মানুষ তাঁদেরকে কেবল বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে ডাকে স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করার জন্য। এর বাইরে আর কেউ তাঁদের খবর রাখে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি বাস ড্রাইভার ছিলেন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করেন। যিনি দুর্বিসহ জীবন যাপন করতে থাকেন। ১৯৯১ সালে এরকম একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের কাহিনী নিয়ে 'একজন গনিমিয়ার সংবাদ' নামে একটি নাটক রচনা ও নির্দেশনা দেন রতন সিদ্দিকী। এরপর উদীচী মঞ্চে আনে সত্যেন সেন-এর বিখ্যাত উপন্যাস 'অভিশপ্ত নগরী' নাট্যরূপ। যে নাটকরে মধ্য দিয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হানাহানি ও সাম্প্রদায়িক কুপুমণ্ডুকতায় একটি জাতি কিভাবে ধ্বংস হয়ে যায় এবং অন্যরা সেখানে এসে জায়গা করে নেয় এবং তা কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দ্বন্দ্ব-সাম্প্রদায়িকতা থেকে জাতিকে বের করে আনার সার্বজনীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে উদীচী সত্যেন সেন-এর এই বিখ্যাত উপন্যাস 'অভিশপ্ত নগরী'র নাট্যরূপ মঞ্চে আনে।

আমাদের দেশে ইতিহাস তৈরির যেমন ঐতিহ্য রয়েছে তেমন রয়েছে ইতিহাস বিকৃতির নোংরা স্বভাব। একশ্রেণীর মানুষ সর্বদা এ ধরনের ঘৃণ্য অকর্মের সাথে লিপ্ত রয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৫ এর পর থেকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে স্বাধীনতার সত্যিকারের ইতিহাস বিকৃত করে ভ্রান্ত ইতিহাস তরুণ সমাজকে শেখানো হচ্ছিল। ১৯৯০ এর পর এই বিকৃতি চরমে পৌঁছে। ১৯৯৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শুরু হয়েছিল নানা চক্রান্ত। তাঁকে নিয়ে রীতিমত শুরু হয়ে গিয়েছিল নোংরা রাজনীতি ও নানা বিতর্ক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করা শুরু হয়েছিল। এমন সময় উদীচী কেন্দ্রীয় নাটক বিভাগ রাস্তায় নামে ব্যাঙ্গাত্মক নাটক 'ঈশ্বরের আদালত' নিয়ে। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনা দেন মোফাক্খারুল ইসলাম জাপান। প্রথম মঞ্চায়ন হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

ইতিহাসবিকৃতির এই নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং সমগ্র দেশব্যাপী শিশু কিশোরদেরকে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস পাঠ করানোর মানসে ১৯৯৪ তে উদীচী গঠন করে "স্বাধীনতার ইতিহাস প্রতিযোগিতা পরিষদ"। এর অধীনে সারাদেশের ১৩৫টি থানায় অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর ৪৫০০০ ছাত্রছাত্রী উদীচী প্রকাশিত ড. মোহাম্মদ হাননান রচিত "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: কিশোর ইতিহাস" বইটি নামমাত্র মূল্যে কিনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সারা দেশের থানা পর্যায়ে মেধাক্রম অনুযায়ী প্রতি শ্রেণীর দশজন করে ছাত্রছাত্রীকে পুরস্কৃত করা হয়। সকল থানার প্রথমস্থান অধিকারীকে ঢাকায় এনে পুরস্কৃত করা হয়। এতে শিশু কিশোরদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পঠনে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি হয়। এর মাঝে '৯২তে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য বেলায়েত হোসেনের দায়িত্বে উদীচী আবৃত্তি বিভাগ পরিবেশন করে 'প্রেসনোট'। তারপর সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গী, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি ও নগরের নানা অসামঞ্জস্যের উপর রচনা 'নগর তিলোত্তমার কথকতা' পরিবেশিত হয়। '৯৬ তে জাহিদ মোস্তফার গ্রন্থনায় বেলায়েত হোসেন এবং শাহরিয়ার সালামের নির্দেশনায় বাঙালির ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে উপস্থাপন করে 'ইতিহাসের ছেড়া পাতা'।

উদীচীর এ কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি স্বাধীনতা বিরোধীরা। আর তাই ১৯৯৯ সালে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা করে কেড়ে নিয়েছে দশটি তাজা প্রাণ। ক্ষতবিক্ষত করেছে দুইশতাধিক মানুষ। সন্ধ্যারাণী, বাবুল সুত্রধর, নুরুল ইসলাম, শাহ আলাম, তপন, রতন কুমার বিশ্বাস, ইলিয়াস মোল্লা, রামকৃষ্ণ, সৈয়দ বুলু, শাহ আলম পিন্টু। ২০০৫ সালে আবার নেত্রকোনায় উদীচী অফিসের সামনে বোমা হামলা করে কেড়ে নিয়েছে হায়দার-শেলীকে। কিন্তু থামাতে পারেনি উদীচীর কর্মকাণ্ড। বরং যশোরসহ সারাদেশে মানুষ হত্যাকারীদের ধিক্কার জানিয়েছে। ফুল বিক্রেতারা বলেছে, 'এই শহরে ফুল বিক্রি করতে আমাদের ঘৃণা হয়।' পরের দিন থেকেই সেই মঞ্চে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। যশোরের এই বোমা হামলাকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালেই মঞ্চস্থ করা হয়েছে নাটক 'পুনরুত্থান'। এসময় আবৃত্তি বিভাগের শিল্পীরা শাহরিয়ার সালামের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় পরিবেশন করে 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়'। অসংখ্য গান লেখা হয়েছে এ ঘটনার পর। যার মধ্যে প্রবীর সরদারের লেখা এবং ফারুখ ফয়সালের সুর করা 'গোধুলীর সাথে সন্ধ্যা যে যায়, আবার সন্ধ্যা আসে, রতন-তপন ভেসে ভেসে আসে বেদনার প্রতিভাসে' অন্যতম। যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার ঘটনার প্রেক্ষিত প্রদীপ ঘোষ নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চিত্র 'ক্ষতচিহ্ন'। নেত্রকোনার বোমাকে কেন্দ্র করে উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক সেন্টু রায় নির্মাণ করেন 'যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও' তথ্যচিত্র। উদীচী স্বাধীন দেশে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বরূপ উন্মোচন করে পরিবেশন করে বর্ণচোরা, স্বাধীনতার সংগ্রাম, তাতাল, পূর্ণিমা প্রভৃতি নাটক। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সারাদেশব্যাপী সংগঠিত সাম্প্রদায়িক তা-বের যারা শিকার হয়েছিল পূর্ণিমা তাদের অন্যতম। পূর্ণিমা লাঞ্ছনার পূর্বাপর ঘটনা নিয়ে প্রবীর সরদার রচনা করেন 'পূর্ণিমা'। ২০০৫ সালে নাটকটি উপস্থাপন করে উদীচী। মঞ্চস্থ করে মমতাজউদ্দিন আহমদের 'ক্ষতবিক্ষত'। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করাটাই একমাত্র কাজ ছিল না। এ সময়ে আরো অনেক ধরনের অসঙ্গতি বিরাজ করছিল। সে অসঙ্গতিগুলোকে মূল প্রতিপাদ্য করে ২০০৫ সালে রতন সিদ্দিক রচনা করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মঞ্চনাটক 'বৌবসন্তি'। নাটকটির নির্দেশনা দেন আজাদ আবুল কালাম।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে উদীচীর সংগ্রাম সংগীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি ও চিত্রকলা, চলচ্চিত্রসহ সংস্কৃতির সকল মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে তেমনিভাবে সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে সমান গতি সঞ্চার করেছে। অর্থাৎ উদীচী শিল্পীদের সংগঠন হলেও কেবলমাত্র বিনোদনের জন্য শিল্পচর্চা মুখ্য হয়ে উঠেনি। উদীচীর শিল্প চর্চার কেন্দ্রে সকল সময় অবস্থান করেছে মানুষ। সেখানে স্থান পেয়েছে মানবিকতা। উদীচী উদ্যোগে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গঠন করা হয়েছে 'বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটি'। যার আহ্বায়ক ছিলেন কামাল লোহানী এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক বদিউর রহমান। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামের অংশ হিসেবে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসেও যুদ্ধপারাধীদের বিচারকার্য ত্বরান্বিত করার দাবীতে সারাদেশে সপ্তাহব্যাপী (১২-১৮ জানুয়ারি ২০১৩) কর্মসূচি পালিত হয়। এরপর ৫ জানুয়ারি কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা করলে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চসহ সারাদেশে যে অগ্নিস্ফুরণ ঘটে উদীচী তার অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। উদীচীর শিল্পীকর্মীরা এ আন্দোলনে প্রথমদিন থেকে সংগীত, আবৃত্তি ও নাটক নিয়ে মুখর থেকেছে এবং প্রথম সংগঠন হিসেবে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। বেলায়েত হোসেনের নেতৃত্বে আবৃত্তি বিভাগ পরিবেশন করেছে হেলাল হাফিজের 'অস্ত্র সমর্পণ', রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর 'বাতাসে লাশের গন্ধ', সলিল চৌধুরীর 'শপথ' কবিতার প্যারোডি। নাটক বিভাগ রবিউল ইসলাম শশীর নির্দেশনা পরিবেশন করে একটি ব্যাঙ্গ নাটক 'ইহা একটি নাটক'। আর সংগীত বিভাগ পরিবেশন করে অগ্নিঝরা সব 'গণসংগীত'। এসময় উদীচীর শিল্পীকর্মীরা রচনা করেছেন অজস্র গান ও কবিতা। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চসহ সারাদেশে সনাতন মালো, আরিফ নূর, শাকিল অরণ্যসহ অজস্র উদীচীকর্মীর সৃষ্টিশীল শ্লোগান আন্দোলনে নতুন ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে।

একজন উদীচীকর্মী হিসেবে সমাজকে প্রগতিমুূখিন অভিযাত্রায় অগ্রসর করে নেয়ার লড়াই নিরন্তর। এটা উদীচীর জন্মের অঙ্গিকার। শত বাধা বিপত্তির মাঝে সে অঙ্গিকার থেকে উদীচী কখনো সরে যায়নি। আগামীর পথ চলায়ও সে ধারা অব্যাহত থাকুক সে প্রত্যাশা রইল।