নিমতলী থেকে চকবাজার, আমাদের দায় ও তদন্ত কমিটি

জিয়া আহমেদ
Published : 26 Feb 2019, 01:51 PM
Updated : 26 Feb 2019, 01:51 PM

আর চার-পাঁচটা দিনের মতোই ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল চকবাজারের চুড়িহাট্টার মানুষজনদের সকাল, পার্থক্য শুধু রাত ১০ টার পরেরকার দৃশ্যপট। আগুনের লেলিহান শিখা পুড়ে ছাই করে দিয়েছে ৬৭ টি তরতাজা স্বপ্নের। পৃথিবীর আর কোথায় হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে রাসায়নিক কারখানার কাঁচামালের সাথে মানুষদের বসবাস করতে হয়। সে বিচারে গিনেসবুকে আমাদের নাম থাকলেও আমরা অবাক হব না। অনেকটা নিচে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি তার উপরে মানব বসতি, যখন আগ্নেয়গিরি জ্বলে উঠবে তা অপরিনামদর্শী হবে। আর সেটাই হলো ২০ ফেব্রুয়ারির চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। আগ্নেয়গিরি হচ্ছে রাসায়নিক কাচাঁমাল রাখার কারখানাগুলো, লাভা হচ্ছে তার রাসায়নিক দ্রব্যগুলো, আর সেই লাভা থেকেই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তরতাজা মানুষদের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেতে হলো। যাদের অনেককেই ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া সনাক্তকরণ অসম্ভব। তার মানে স্বজনদের পুড়ে যাওয়ার পর অবশিষ্টাংশগুলো পেতে হলেও অপেক্ষা করতে হবে। তৃতীয় বিশ্বে জন্মের পর আমরা সময়ের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠি দুর্যোগ মোকাবেলায় কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্যোগের দায় কার? সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকি জনগণের !

রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা সরকারের উপর দায় দিয়ে যারা বেঁচে যেতে চান তাদের উদ্দেশ্য মূলক আচরণ অনেকের কাছে সন্দেহজনক। দায় সবার। প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র একা দায় নিবে কেন? তবে এতটুকু বলা যায় অধিকাংশ দায়ভার রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা সরকারের উপর বর্তায়। নিমতলী ট্র্যাজেডির (নিমতলী ২০১০ সালের ৩ জুন) প্রাণহানী এর চেয়ে বেশি ছিল। নিমতলীর ঘটনার পর ১২ সদস্যের তদন্তকমিটির ১৭টি সুপারিশ দেয় যেগুলো বাস্তবায়ন সময় উপযোগী ও অতীব জরুরী ছিল। ১৭টি সুপারিশের মধ্যে প্রথম পাচঁটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা বাস্তবায়ন করলে হয়তো চকবাজারের চুড়িহাট্টার এতোগুলো প্রাণ ঝরে যেত না। ১৭টি সুপারিশের মধ্যে প্রথম পাচঁটিতে শিল্প মন্ত্রণালয়, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ করে এই চারটি প্রতিষ্ঠানের যে রকম তদারকি ও সমন্বয় করার দরকার ছিল আট বছরের মধ্যে তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। সে বিষয়ে একটি বিশেষ তদন্তকমিটি গঠন করা হোক। ২০১০ সালের পর আট বছর অতিবাহিত হওয়ার পর কেন জরুরী ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া হয়নি, কেন আইননুগ বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তদন্তকমিটি এই বিষয়ে একটি বিশেষ রির্পোট প্রদান করুক। নির্মম বাস্তব হচ্ছে পুরাতন ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য যে সমস্ত বিষয় অতীব গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়নের দরকার ছিল তার একটাও বাস্তবে রূপ নেয় নি। নিমতলীর তদন্তের পর যে প্রতিষ্ঠান বা যে ব্যক্তি তা বাস্তবায়ন করবেন তারা এতদিন কেন নিজ দায়িত্ব পালন করেন নি তা গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তদন্ত কমিটি আগে তদন্ত করে দেখুক যে ২৯ টি রাসায়নিক দ্রব্যকে অতীব দাহ্য বলে সনাক্ত করা হয়েছিল, নিমতলীর ঘটনার পর  সেই ২৯ টি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবসায়ীরা কী করে আমদানি করে পুরান ঢাকাতে দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছে। কারণ ওই সমস্ত রাসায়নিক আমদানি করতে গেলে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। আট বছর ধরে পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা কী করে তাদের ব্যবসার লাইসেন্স সিটি কর্পোরেশন থেকে নবায়ন করে যাচ্ছেন। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজা একান্ত জরুরী। ঢাকার দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের ভাষ্য মতে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গোলটেবিল বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল পহেলা মার্চ ২০১৭ থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোর কাজ শুরু হবে। শুরু হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মাঝপথে এফবিসিসিআই ও রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা নাকি অনুরোধ করে ছিলেন অভিযান বন্ধ রাখতে এবং বলেছিলেন কেরানীগঞ্জের শিল্প নগরী হলে তা স্থানান্তর করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কী চকবাজারের এই ঘটনার দায় এফবিসিসিআই ও রাসায়নিক ব্যবসায়ী সংগঠনের উপর কিছুটা হলেও বর্তায় না। দায় সরকারের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমরা বেঁচে গেলাম এই সংস্কৃতি থেকে বাহির হয়ে আসতে হবে। কারণ এই রাসায়নিক কারখানাগুলো অধিকাংশই ভাড়া নেওয়া। বাড়ির মালিকরা বেশি লাভের আশায় এর ভয়াবহতার রূপ জেনেও রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম ভাড়া দেন। বিভিন্ন তথ্য থেকে পাওয়া যায় যে, মুদি বা অনান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিলে তা থেকে ভাড়া অনেকটাই কম আসে। সেখানে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম ভাড়া দিলে সিকোরিটি টাকা হিসাবে অগ্রিম অনেক বেশি টাকা পাওয়া যায় এবং মাসপ্রতি ভাড়া কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা আসে। প্রশ্ন হচ্ছে এই বিষয়গুলো তদারকি করার দায়িত্ব কার? এম কাভালিনির 'ফায়ার ডিজাস্টার ইন টুয়েনটিথ সেঞ্চুরি' শীর্ষক একটা প্রতিবেদন দেখছিলাম যেখানে সবচেয়ে ভয়াবহ ফায়ার ডিজেস্টারগুলো ছিল ১৯৮০ থেকে ২০০০ সময় কাল পর্যন্ত। যার মধ্যে ১৯৮৪ সালের মেক্সিকোতে এলপিজি গ্যাস বিস্ফোরণে ৫৫০ জন মারা গিয়েছিল এবং ৬২৫ জনের মতো আগুনে পুড়ে আহত হয়েছিল। এর চেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৮৯ সালের ইউরাল অঞ্চলের উফা ট্রেইন ডিজাস্টার, যেখানে ৫৭৫ জনের মতো মারা যায় এবং ৮০০ জনের মতো অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলেন। মেক্সিকো কিংবা ইউরাল অঞ্চলের দুর্যোগের সাথে আমাদের এই দুর্যোগের তুলনা হয়না, কারণ দুই ঘটনার ডাইমেনসন ভিন্ন ছিল।

বসবাসের উপযুক্ত নয় এমন শহরের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয়, ভয়াবহ বিষাক্ত সীসার দূষণের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয়, দিনে দিনে ঢাকার মতো ৪০০ (চার শত বছরের) ঐতিহ্যবাহী শহরকে আমরা মৃত্যুপুরিতে রূপান্তর করছি। এ যেন এক মৃতপ্রায় ঢাকা। তার দায় কী কেবল সরকারের ! পুরোনো ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে যেখানে মানুষের চলাচল কষ্টদায়ক সেখানে কী করে এতগুলো রাসায়নিক কারখানার গুদাম থাকে তা সত্যি বোঝা অসাধ্য। পরিকল্পিত ও বসবাসের উপযোগী ঢাকাকে নিয়ে মাষ্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া হাতে নিতে হবে, শিল্পকারখানা গুলোকে ঢাকার আসে পাশে শিল্পনগরী স্থাপন করে স্থানান্তর করতে হবে, যেখানে সবধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। অনেক উন্নয়নমূলক কাজ ও প্রকল্প হাতে নিচ্ছে কিংবা চলমান। কিন্তু রাজধানী ঢাকা কে বসবাসের যোগ্য করার জন্য দরকার মহাপরিকল্পনার যা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান, তদারকি, পরিকল্পনা এবং অনুমোদন ইত্যাদি কাজের সাথে যুক্ত তাদের প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অবশ্যই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের সচিবদের কিংবা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে, তবেই তার ফল সুমধুর হবে।

নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে আমরা কিছুই শিখিনি, যার দরুণ এবং ফলাফল চকবাজারের চুড়িহাট্টা। অগ্নিনিরাপত্তায় বাংলাদেশের ইতিহাস খুব একটা ভাল না। তার অন্যতম কারণ নির্মাণ কাজ কী করে কম খরচে করা যায় এবং এই সমস্ত মানবসৃষ্ট দুর্যোগের জন্য দায়ী যারা তাদের যথাযথ শাস্তি না হওয়া। আমাদের দেশে কোনো ঘটনার পর তদন্ত কমিটি ঠিকই গঠিত হয় কিন্তু তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে যে সমস্ত পরামর্শ বা সুপারিশ দেয় তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ পরবর্তীতে নেওয়া হয় না। সময় শেষে আমরাও ভুলে যাই। আবার নতুন কোনও দুর্যোগ এলে আমরা পুরোনো দুর্যোগকে স্মরণ করি। ঢাকাকে একটি আদর্শ নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে হলে মহাপরিকল্পার দরকার এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি।

হাসপাতালের মর্গে নিথর দেহ, বিছানায় ক্ষত নিয়ে শুয়ে থাকা পুড়ে যাওয়া কোনও স্বজনের অশ্রুসজল চোখ আর যেন না দেখতে হয় এই আগামীর প্রত্যাশায়।