মহাবিশ্বের প্রতিসাম্য ও মৌলকণারা

মল্লিকা ধর
Published : 11 Dec 2018, 02:24 PM
Updated : 11 Dec 2018, 02:24 PM

২০১২ সালের ৪ জুলাই । সারা পৃথিবী উদগ্রীব ও উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছে । কেন? সার্ন (CERN) এর বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করবেন তাদের পরীক্ষার ফলাফল । লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার নামক বিশাল পার্টিকল কোলাইডারে উচ্চশক্তির পরীক্ষানিরীক্ষায় যে বিপুল তথ্য পাওয়া গিয়েছে তার বিশ্লেষণে পাওয়া গেল কিনা সেই কণা, যার সন্ধান চলছিল বহুকাল ধরে ।

কী সেই কণা? তার নাম হিগস বোসন । সেই ১৯৬৪ সালে লেখা এক গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানী পিটার হিগস এই কণার অস্তিত্ব বিষয়ে তাত্ত্বিক অনুমান করেন । শুধু তিনিই নন, আরও পাঁচজন গবেষকও এই বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন । কিন্তু কেনই বা এরকম কণার অস্তিত্ব অনুমান করা? কী ছিল সেইসব গবেষণাপত্রের মূল বক্তব্য? তাহলে একটু বিস্তারিত বলতে হয় । সময়ের পথে আর একটু পিছিয়ে যেতে হয় ।

CERN হল The European Organization for Nuclear Research এর সংক্ষিপ্তরূপ । এই বিখ্যাত গবেষণাগারে কণাপদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা হয় । এই গবেষণাগার সুইটজারল্যান্ডের জেনিভার কাছে অবস্থিত । লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার হলো এই সার্নের এক বিশাল শক্তিসম্পন্ন পার্টিকল কোলাইডার, এই টানেল আকারের যন্ত্রটি ভূগর্ভে, এর পরিধি ২৭ কিলোমিটার ।

এই বিশাল টানেলে প্রোটনগুচ্ছকে দৌড় করানো হয় দৈত্যাকার চুম্বক আর তড়িৎক্ষেত্রের সহায়তায় । দৌড় করাতে করাতে প্রোটনগুচ্ছের গতিবেগ বাড়ানো হয়, তাতে গতিশক্তিও বাড়তে থাকে । এইভাবে বাড়তে বাড়তে এদের গতিবেগ যখন আলোর গতির কাছাকাছি হয়, তখন দ্বিমুখী দুটি তীব্রবেগসম্পন্ন প্রোটনগুচ্ছকে মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়ানো হয় ।  এই ধাক্কার ফলে প্রচণ্ড শক্তি মুক্ত হয়, সেই শক্তি থেকে প্রচুর কণিকা তৈরি হয় । সেইসব কণিকার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয় সাব নিউক্লিয়ার জগতের অবস্থাটা ঠিক কীরকম । এক হিসেবে এই পার্টিকল কোলাইডারগুলোকে বলা যায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎ নিরীক্ষণের আলট্রা-মাইক্রোস্কোপ ।

আমাদের বিশ্বের সমস্ত মৌলিক পদার্থের (হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম, বেরিলিয়াম, বোরন, কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি, পর্যায় সারণীতে যাদের নাম তালিকাভুক্ত) ক্ষুদ্রতম অংশ যা ওই মৌলিক পদার্থের সমস্ত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় রাখে, তাকে বলে পরমাণু । এই পরমাণু অতি ক্ষুদ্র । কত ক্ষুদ্র? এর আকার এক মিটারের হাজার কোটি ভাগের এক ভাগ । এই পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, এ আরও অনেক ক্ষুদ্র কণিকা । কত ক্ষুদ্র? এর আকার পরমাণুর দশ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র । এর থেকেই ধারণা করা যায় কী প্রচণ্ড ক্ষুদ্র জগতের কথা আমরা জানতে চাইছি । শুধু তাই না, ঐ নিউক্লিয়াসের মধ্যেই পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভরটুকু থাকে । নিউক্লিয়াসের বাইরে ঘোরাফেরা করে যে ইলেক্ট্রনেরা, নিউক্লিয়াসের প্রোটন আর নিউট্রনের তুলনায় তারা অতি হাল্কা, নগণ্য বলা যায় । পরমাণুর বেশিরভাগটাই ফাঁকা, শূন্য । ভরটুকু ওই কেন্দ্রের নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিহিত ।

পার্টিকল কোলাইডারের পরীক্ষানীরিক্ষা থেকেই পদার্থবিদরা জানতে পেরেছেন আমাদের মহাবিশ্বে বস্তু তৈরির মৌলকণা হল ছয়টি কোয়ার্ক আর ছয়টি লেপ্টন । ছয়টি কোয়ার্ক হলো আপ (u), ডাউন (d), চার্ম (c), স্ট্রেঞ্জ (s), টপ (t) আর বটম (b) । এই কোয়ার্করাই হলো প্রোটন আর নিউট্রন তৈরির মূল কণা । এই কোয়ার্করা খুবই আশ্চর্য কণা । এদের বৈদ্যুতিক চার্জ আছে, কিন্তু সেই চার্জ ভগ্নাংশমানের । আপ কোয়ার্কের চার্জ ২/৩ , ডাউন কোয়ার্কের চার্জ -১/৩ ইত্যাদি । এই কোয়ার্কদের কখনই একটা করে পাওয়া যায় না, এরা হয় তিনটে করে একসঙ্গে থাকে নয়তো দুটো করে একসঙ্গে থাকে । যেমন প্রোটন তৈরি হয় দুটো আপ কোয়ার্ক আর একটা ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে ।

এই প্রোটন থেকে একটা আপ বা ডাউন কোয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে আনা যায় না । ওভাবে একক কোয়ার্ক ছিঁড়ে আনতে গেলেই এসে পড়ে কোয়ার্ক -অ্যান্টিকোয়ার্কের একটা জুড়ি, প্রোটনের ভেতরে যে তিনটে কোয়ার্ক ছিল, সেই তিনটেই থেকে যায় । কোয়ার্কের এই বৈশিষ্ট্যকে বলে কনফাইনমেন্ট । এরা চিরকাল প্রোটনের ভেতরে বা নিউট্রনের ভেতরে বা অন্য কোনো ব্যারিয়ন বা মেসনের ভেতরে থেকে যায়, এদের মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না।

এবারে যাওয়া যাক নিউক্লিয়াসের বাইরে । সেখানে ঘুরছে ইলেকট্রনরা ।  ইলেকট্রন খুব হাল্কা কণা, এর বৈদ্যুতিক চার্জ -১ । পরীক্ষানীরিক্ষায় দেখা গেল ইলেকট্রনের মতন আরো কিছু কণা আছে, যারা ইলেক্ট্রনের চেয়ে বেশি ভরযুক্ত কিন্তু অন্য সব বৈশিষ্ট্যে ইলেক্ট্রনের মতই । এরা হল মিউয়ন আর টাউ । এরা সবাই লেপ্টন নামের বিভাগে পড়ে ।  মোট ছয়টি লেপ্টন পাওয়া গিয়েছে । এরা হল ইলেক্ট্রন (e), মিউয়ন (μ), টাউ (τ), ইলেক্ট্রন-নিউট্রিনো (νe ), মিউঅন-নিউট্রিনো (νμ) আর টাউ-নিউট্রিনো (ντ )। এই কোয়ার্ক আর লেপ্টনদের মধ্যে  মিথস্ক্রিয়া ঘটে গোটা কয়েক বলবাহী কণার বিনিময়ে । হ্যাঁ, সেইসব কণার অস্তিত্বও পরীক্ষায় প্রমাণিত । ফোটন, ডাব্লু, জেড, গ্লুয়ন । কোন কোন মিথস্ক্রিয়া বহন করে কোন কোন কণা, তাও ভালোভাবে জানা । এইসব জানার পরে তৈরি হলো প্রমিত মডেল ( স্ট্যান্ডার্ড মডেল ), এই মডেল মহাবিশ্বের প্রায় সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে । প্রায় বললাম কারণ মহাকর্ষকে এখনও এই মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। (মহাকর্ষ ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয় সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব )

নিচের ছবিতে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সমস্ত মৌলকণাদের নাম ও বৈশিষ্ট্য দেওয়া হল ।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে প্রকৃতির সমস্ত মিথস্ক্রিয়া (মহাকর্ষ বাদে) ঘটে গেজ ইনভ্যারিয়েন্স আর প্রতিসাম্য (সিমেট্রি) এর কারণে । মিথস্ক্রিয়াগুলো সবই বিনিময়কণা দ্বারা বাহিত, এই বিনিময়কণাগুলোকে সাধারণভাবে বলে 'গেজ বোসন'। এই বিনিময়কণার ব্যাপারটা একটু পরেই বিস্তারিত জানতে পারবো আমরা ।
গেজ ইনভ্যারিয়েন্স ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার । গণিতের সাহায্যে ব্যাপারটা বলা সহজ । গাণিতিক পরিভাষায় বলা হয়, কোনও একগুচ্ছ সমীকরণে গেজ ট্রানসফর্মেশন ঘটার পরেও সমীকরণগুলোর মূলগত কোনও পার্থক্য না ঘটলে বলা যায় তারা গেজ ইনভ্যারিয়েন্ট । এই ব্যাপারটা আর একটু বিস্তারিত জানা যাবে পরে ।
প্রথমে জানা যাক বোসন কী । বোসন হল একধরনের কণা । এরা এদের নাম পেয়েছে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস এর নাম থেকে । কারণ এরা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ণ মেনে চলে । এই বোসন কণাদের অন্তর্নিহিত ঘূর্ণনের মাপ হয় পূর্ণসংখ্যায়, যেমন ১, ২ ইত্যাদি । অন্যধরণের কণা যাদের অন্তর্নিহিত ঘূর্ণনের মাপ অর্ধপূর্ণসংখ্যায় আসে, অর্থাৎ কিনা, ১/২, ৩/২ ইত্যাদি হয়, তারা মেনে চলে ফার্মি সংখ্যায়ন । ওই কণাদের বলে ফার্মিয়ন । মহাবিশ্বের সমস্ত কণাই হয় বোসন, নয় ফার্মিয়ন ।
এইবার আসি গেজ বোসনের কথায় । বস্তু তৈরির মূল কণারা যেমন কিনা কোয়ার্ক, ইলেকট্রন এরা সবাই হলো ফার্মিয়ন । অর্ধপূর্ণসংখ্যার স্পিন এদের । কিন্তু এরা সব মিলেমিশে বড় বড় জিনিস বানাতে গেলে তো পারস্পরিক ক্রিয়া দরকার? হ্যাঁ, তা তো বটেই। এরা সেই মিথস্ক্রিয়াগুলো করে গেজ কণা বিনিময়ের দ্বারা। যেমন, দুটো ইলেক্ট্রন – দুজনেই চার্জওয়ালা, এরা যখন তড়িচ্চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়া করে, তখন বিনিময় করে ফোটন । তাই তড়িচ্চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার 'গেজ বোসন' হল ফোটন । আর একটা উদাহরণ দিই । তিনটে কোয়ার্ক মিলে তৈরি করে প্রোটন । এই তিনটে কোয়ার্ক পরস্পরের সঙ্গে যে মিথস্ক্রিয়া করে তাকে বলে সবল মিথস্ক্রিয়া (Strong interaction)। এই ক্রিয়া সংঘটিত হয় গ্লুয়ন কণা বিনিময়ের দ্বারা । তাই গ্লুয়ন হল সবল মিথস্ক্রিয়ার 'গেজ বোসন' । এই বিনিময়কণারা সব সময়েই বোসন অর্থাৎ এদের স্পিন পূর্ণসংখ্যার হয় ।
দু'টি কণা, ধরা যাক 'ক' এবং 'খ', মিথস্ক্রিয়া করার সময় যে গেজ বোসনগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে বা লুফে নিচ্ছে, সেগুলো একই । বস্তুগতভাবে এটাই হল গেজ ইনভ্যারিয়েন্স । প্রক্রিয়াটি প্রতিসাম্য বজায় রাখছে, 'ক' আর 'খ' এর যদি জায়গা পাল্টাপাল্টি করে দেওয়া যায়, মিথস্ক্রিয়ার মূলগত কোনো পরিবর্তন হবে না ।
কিন্তু একটা বিরাট তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দিলো এই মডেলে । তত্ত্ব অনুযায়ী গণনা করে দেখা গেল সমস্ত কোয়ার্ক আর লেপ্টনেরা হবে ভরশূন্য, সবাই চলবে আলোর গতিতে । কিন্তু বাস্তবে তো তা নয়! সমস্ত কোয়ার্কের ভর আছে, লেপ্টনদেরও ভর আছে । আর এরা মোটেই আলোর গতিতে ছোটে না (ফোটন বাদে) ।
এবার? এই সমস্যার সমাধান হবে কী করে?
তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা নানা পথে চেষ্টা করতে করতে দেখলেন একটি উপায় আছে ভর পাবার । তার নাম স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভঙ্গ (Spontaneous symmetry Breaking) । এটা হলে ভরশূন্য কণা ভর লাভ করে।
এই হলো আসল ব্যাপার । স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভঙ্গ হয়ে বোসনের ভরযুক্ত হয়ে ওঠা। এই বিষয়ে প্রথম গবেষণাপত্র ইয়োইচিরো নাম্বু (Yoichiro Nambu) এর, ১৯৬০ সালে । তারপর ফিলিপ অ্যান্ডার্সন (Philip Anderson ) এই বিষয়ে গবেষণাপত্র বের করেন, ১৯৬২ সালে ।
তারপর আসে দ্রুত অনেকগুলো পেপার । François Englert আর Robert Brout -এর পেপার ১৯৬৪ এর অগাস্টে, Peter Higgs এর পেপার ১৯৬৪ এর অক্টোবরে, Gerald Guralnik, Carl Hagen, Tom Kibble এর পেপার ১৯৬৪ এর নভেম্বরে ।
এদের এই সব গবেষণাপত্রের তাত্ত্বিক গণনায় দেখা গেল স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভঙ্গ হতে পারে যদি মহাবিশ্বের সর্বত্র একটি অদ্ভুত ফিল্ডের উপস্থিতি থাকে, যার সর্বনিম্ন শক্তি শূন্য নয়, ধনাত্মক মানের । শূন্য মানে নামতে গেলে যার শক্তি খরচ করতে হয় । এই অদ্ভুত ক্ষেত্র বা ফিল্ডটিই হল হিগস ক্ষেত্র বা ফিল্ড । মিথস্ক্রিয়া করার সময় এই ফিল্ড যে কণা তৈরি করে তাই হল হিগস বোসন ।
এই হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে ক্রিয়া করেই নিউক্লিয় দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ার ভেক্টর বোসনেরা ভরযুক্ত হয়ে ওঠে, এই ক্রিয়াকে বলে 'হিগস মেকানিজম'। কোয়ার্ক আর চার্জযুক্ত লেপ্টনেরাও হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে থাকে একটু অন্যরকম ভাবে, তাকে বলে 'ইউকাওয়া কাপলিং' । এর দ্বারা এই কোয়ার্ক আর তড়িতাধানযুক্ত লেপ্টনেরা তাদের ভর পায় ।

এদের সকলের কাজই খুব গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু পিটার হিগসের পেপারটি আলাদা করে উল্লেখযোগ্য । হিগসই তার গবেষণাপত্রে প্রথম ম্যাসিভ স্কেলার বোসনের কথা বলেন । অন্যেরা ভেক্টর বোসন নিয়েই প্রধানত চিন্তিত ছিলেন, তাত্ত্বিক গণনাতেও সেইদিকেই জোর দিয়েছেন ।

হিগসের গবেষণাপত্রেই প্রথম স্কেলার বোসনের কথা পাওয়া যায়। স্কেলার বোসন অর্থাৎ কিনা যাদের অন্তর্নিহিত স্পিন শূন্য। হিগস বোসন ঠিক তাই, এটি স্কেলার বোসন, এদের স্পিন শূন্য। ভেক্টর বোসনদের স্পিন কিন্তু ০ নয়, ১ বা ২ বা অন্য কোনও পূর্ণসংখ্যা।

সেই ২০১২ এর ৪ জুলাইয়ের কথা মনে আছে তো? হ্যাঁ, সেইদিন বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন যে তারা সত্যিই হিগস কণা খুঁজে পেয়েছেন। তারপর আরও বহু পরীক্ষানিরীক্ষায় হিগস কণার অস্তিত্ব বিষয়ে প্রায় সকলেই নি:সন্দেহ হলেন ।

এই হিগস বোসনের ভর/শক্তি হলো- ১২৫ GeV। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় দু'টি, একটি হলো ভর/শক্তি (ভর আর শক্তিকে এখানে তুল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে) আর অন্যটি হল তার একক, GeV।

ভর আর শক্তি একে অপরের তুল্য । এটা আমরা আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে জানি । E=mc2, অর্থাৎ শক্তি = ভর X শূন্যে আলোর গতিবেগের বর্গ । যেহেতু শূন্যে আলোর গতিবেগ মহাবিশ্বের সর্বত্র একই, c, তাই এই গতিবেগ হল ধ্রুবক সংখ্যা । তাই শক্তি ভরের তুল্য, শক্তিকে আলোর গতিবেগের বর্গ দিয়ে ভাগ করলেই পাওয়া যায় ভর ।

এইবারে আসা যাক GeV তে। এটি শক্তির একক, গিগা ইলেক্ট্রন-ভোল্ট । ইলেক্ট্রন-ভোল্ট হল মৌলকণাদের শক্তি মাপার সবচেয়ে মানানসই একক । একটি ইলেক্ট্রন 1 ভোল্ট বিভব-পার্থক্যের মধ্য দিয়ে গেলে যে পরিমাণ শক্তি অর্জন করে তাকে বলে 1 ইলেক্ট্রন ভোল্ট (1 eV) । ইলেক্ট্রনের চার্জ (1.60 X 10-19 Coulomb ) সঙ্গে  ১ ভোল্ট গুণ করলেই এই শক্তির মাপ পাওয়া যাবে আমাদের চেনা শক্তি একক, জুল এর মাপে । তার একশো কোটি গুণ অর্থাৎ বিলিয়ন গুণ শক্তি হল এক গিগা ইলেক্ট্রন-ভোল্ট বা 1 GeV । একটি হিগস বোসনের ভর/শক্তি হল ১২৫ GeV ।

২০১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন হিগস আর এংলার্ট, তাদের সেই ১৯৬৪ সালের যুগান্তকারী গবেষণার জন্য । হিগস বোসন খুঁজে পাবার ফলে স্কেলার বোসনও প্রথম পাওয়া গেল, আগে যেসব বোসন পাওয়া গিয়েছিল সবই ভেক্টর বোসন ।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল খুবই সুন্দর ব্যাপার । মাত্র সতেরোটি কণা দিয়েই মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু আর তাদের মধ্যের তিনটি মূল মিথস্ক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায় । ছয়টি কোয়ার্ক, ছয়টি লেপ্টন, চারটি বিনিময়কণা আর হিগস বোসন (যার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে কণাদের মধ্যে যারা ভরযুক্ত তারা ভর পায় ) । তিনটি মূল মিথস্ক্রিয়া যা এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের দ্বারা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাত হয়, তা হল তড়িচ্চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়া, সবল (Strong) মিথস্ক্রিয়া আর দুর্বল(Weak) মিথস্ক্রিয়া ।

এত সুন্দর যে মডেল, তাও কিন্তু বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না । প্রথম প্রশ্ন হলো, নিউট্রিনোদের ভর এল কীভাবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, ডার্ক ম্যাটার কী? তৃতীয় প্রশ্ন হলো, মহাবিশ্বে এত বস্তু পাওয়া যায় কিন্তু অ্যান্টিম্যাটার অর্থাৎ প্রতিবস্তু পাওয়া যায় না কেন? কোথায় গেল প্রতিবস্তু? চতুর্থ প্রশ্ন হলো, মহাবিশ্ব ক্রমত্বরান্বিত হারে প্রসারিত কেন হচ্ছে, এর প্রসারণহার বাড়ছে কীভাবে, কোথা থেকে আসছে বাড়তি শক্তি? পঞ্চম প্রশ্ন হলো, মহাকর্ষের ব্যাপারটার কী হবে? মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়ার কি কোনো বিনিময়কণা আছে?

এরাই সব নয়, আরও প্রশ্ন আছে । আর কয়েকটি প্রশ্ন হলো, স্থানকালের জ্যামিতির উৎস কী? মৌলকণারা তাদের অন্তর্নিহিত ঘূর্ণন (স্পিন) পায় কোথা থেকে? সবল মিথস্ক্রিয়া এত জোরাল কেন যখন কিনা দুর্বল মিথস্ক্রিয়া তুলনামূলকভাবে এত দুর্বল? একই দূরত্বে রেখে বিচার করলে মহাকর্ষের জোর কেন এত এত এত ক্ষীণ অন্য তিনটি মিথস্ক্রিয়ার চেয়ে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য পদার্থবিজ্ঞানীরা সুপারসিমেট্রি বলে একটি ব্যাপারের প্রস্তাব করেন। সুপারসিমেট্রি হলো স্থানকালের এমন এক প্রতিসাম্য অবস্থা, যা ফার্মিয়ন আর বোসনদের মিলিয়ে দিতে পারে তাদের সমস্ত পার্থক্য সত্ত্বেও । বর্তমানের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাবে সুপারসিমেট্রি নীতি কাজে লাগাতে পারলে ।

কিন্তু কীভাবে বোঝা যাবে মহাবিশ্ব সুপারসিমেট্রিক কিনা? মহাবিশ্ব সুপারসিমেট্রিক হলে সমস্ত প্রচলিত মৌলকণার একটি করে সুপারসিমেট্রিক ভাগীদার কণা পাওয়া যাবে, ইলেকট্রনের জন্য সিলেক্ট্রন, ফোটনের জন্য ফোটিনো ইত্যাদি। এইসব সুপারসিমেট্রিক কণাগুলো সবই তাদের বাস্তব জ্ঞাতিবোন বা জ্ঞাতিভাইটির মতনই হবে, শুধু তাদের ভরগুলো ভিন্ন হবে স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিসাম্য ভঙ্গের কারণে ।

বর্তমানে সার্নের বিশাল সেই লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে এইসব সুপারপার্টনারদের সন্ধান চলছে । এখনও পর্যন্ত কোনো সুপারপার্টনার পাওয়া যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা যুক্তিনির্ভর অনুমান করছেন যে আরও উচ্চশক্তিতে পরীক্ষানিরীক্ষা চালালে সুপার-পার্টনার পাওয়া যেতে পারে ।

মহাবিশ্বে সুপারসিমেট্রি আছে কি নেই সেটা খোঁজার আর একটা জোরালো অনুপ্রেরণা হল হায়ারার্কি প্রবলেম (Hierarchy problem)। এই হায়ারার্কি প্রবলেম জিনিসটা কী?

ব্যাপারটা একটু সবিস্তারে বোঝার চেষ্টা করা যাক । কণা-পদার্থবিজ্ঞানে এই হায়ারার্কি প্রবলেম বা অনুক্রমিক সমস্যা একটা বিরাট অমীমাংসিত প্রশ্ন। সোজাসুজি বলতে গেলে বলতে হয় মহাবিশ্বের যে চারটি মূল মিথস্ক্রিয়া, সবল, তড়িচ্চুম্বকীয়, দুর্বল আর মহাকর্ষ – এই চারটের মধ্যে প্রথম তিনটি আপেক্ষিক তীব্রতার দিক দিয়ে বেশ কাছাকাছি ঘেঁষাঘেষি করে আছে। কিন্তু মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়ার মান অত্যন্ত অত্যন্ত ক্ষীণ, দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার তুলনায় ১০২৪ গুণ মাত্র ।

এটা একটা বিরাট রহস্য । কেন এই মিথস্ক্রিয়া এত ক্ষীণ, তার উত্তর পাওয়া যায় না তাত্ত্বিক বিচারে। এর সমাধানের আশায় নানারকম তাত্ত্বিক প্রস্তাব উঠেছে, তারই একটি হলো সুপারসিমেট্রি। অন্য প্রস্তাবগুলো হল উচ্চতর মাত্রার দ্বারা সমাধান ।

একমাত্র ভবিষ্যৎই বলে দেবে কোন প্রস্তবাটি শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করা হবে সঠিক হিসেবে । এখনও পর্যন্ত উচ্চতর মাত্রা বা সুপারসিমেট্রি কারুরই কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি ।

তবে যেকোনো মুহূর্তে উচ্চশক্তির পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল থেকে সন্ধান পাওয়া যেতে পারে এদের কোনোটার অথবা আরো আশ্চর্য অন্য কোনো কিছুর । ভবিষ্যৎ ভরে আছে অসংখ্য অভাবিত সম্ভাবনায় ।