সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হোক জাতীয় নির্বাচন

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পু
Published : 26 Nov 2018, 12:38 PM
Updated : 26 Nov 2018, 12:38 PM

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভোটাধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার প্রয়োগ করেই জনগণ তাদের সমর্থন জানায় কাঙ্ক্ষিত আদর্শের প্রতি। গণতন্ত্রের এই শান্ত স্নিগ্ধ পথযাত্রায় কেউ জয়ী বা কেউ বিজিত। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি, জামায়াত দল বা গোষ্ঠি যখন আদর্শিক কারণে অপশক্তির প্রশ্রয়ে ও আগ্রাসনে প্রতিরোধবিহীন তখন অসম্ভব ভীতিকর ঘটনা ঘটতেই পারে। ইতিহাসের এই জঘন্যতম বর্বরোচিত কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো ২০০১ সনে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ও পরবর্তীতে ।

প্রতিহিংসার রাজনীতিতে মানবতা লাঞ্ছিত । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি লণ্ডভণ্ড। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা বিরোধী শক্তি সমগ্র বাংলাদেশে শুরু  করে নারকীয় তাণ্ডব। এদের দ্বারা সংঘঠিত হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, সম্পদ লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, শারীরিক নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ন্যায় অসংখ্য ঘটনায় মানবতা ছিল ক্রন্দনরত ।

বিজিত দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এদের নির্মম, পাশবিক, হিংস্র ও জান্তব আক্রোশের শিকার। প্রতিটি সহিংস ঘটনা যেন মথিত হ্নদয়ের বেদনার্ত সমগ্রতা নিয়ে জীবন্ত অসহায় চিৎকারে বলেছে-  এই কি আমাদের জন্মভূমি? অপরাধীদের কোনও জবাবদিহিতা ছিল না, নির্বিকার ছিল প্রশাসন।

পক্ষান্তরে ২০০৮ সনে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় । বিজিত দল বিএনপি-জামায়াত । ২০০১ সনের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী রাজনীতিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নির্মমতার অভিজ্ঞতায় ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সহিংসতা সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি অমূলক ছিল না । কিন্তু জাতি উৎকণ্ঠিত এবং শঙ্কিত হলেও নির্বাচনে বিজয়ী প্রধান রাজনীতিক দলের শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতা, সহনশীল আচরণ ও প্রতিশোধ বিবর্জিত মানসিকতার কারণে তার নির্দেশের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিক্ষুব্ধ নেতা কর্মীদের সংযত আচরণ ও  পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব জাতি সে সময়ে স্বস্তির সাথে দেখেছে।  শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, আন্তরিকতা, প্রজ্ঞা ও সহনশীলতা গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অনুকরণীয়।

নির্বাচন পরবর্তী এই সম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক সহিংসতার উৎস কী? এ প্রসঙ্গে নির্দ্ধিধায় বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন ৭২ এর সংবিধানের মূল চেতনাকে ধ্বংস করে সাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ সংবিধানের প্রবর্তন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ,গণতন্ত্র , সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসাবে ভিত্তি করে ১৯৭২ সনের সংবিধান রচিত হওয়ায় এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা মৌলিক চারনীতির অন্যতম নীতি হওয়ায় বাংলাদেশে চমৎকার এক উজ্জ্বল অসম্প্রদায়িক ইতিহাসের সূচনা হয় । বস্তুত এটা ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির জন্য বড় অর্জন, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যা ছিল অনন্য।

একটি রাষ্ট্র কতটুকু সভ্য, আধুনিক এবং জনগণের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি কতটা দায়বদ্ধ তার পরিচয় পাওয়া যায় সে দেশের সংবিধানে । নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায় এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের দায় নিশ্চিত করে সংবিধান। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের দর্শন সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষতা,গণতন্ত্র,সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয় উল্লেখ থাকায় তা নি:সন্দেহে আদি সংবিধানকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানের মর্যাদা দিয়েছে।

১৯৭১ সনের পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে । ইতিহাসের জঘন্যতম রাজনীতিক প্রতিহিংসা ও বিকৃত মানসিকতার ঘৃণ্যতম উদাহরণ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড। এই  জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর এই দেশ প্রগতির ধারার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক ধারায় আবর্তিত হতে থাকে । স্বাধীনতার মূল চেতনাসমূহকে ‍ভূলুণ্ঠিত ও বিকৃত করা হয় ।

সদম্ভে আত্নপ্রকাশ ঘটে সামরিক তন্ত্রের। পশ্চাদপদ নীতি অনুসৃত হতে থাকে নব্য  পাকিস্তান সৃষ্টির দু:স্বপ্নে।  অবৈধ ক্ষমতা দখলদারী খুনি মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখলের পর ঘোষণা করলেন যে, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কোন স্থান নাই এবং দেশ পরিচালিত হবে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে।

উল্লেখ্য যে পাকিস্থানের প্রথম সংবিধান ১৯৫৬ সাল মার্চ মাস গৃহিত হয়। ওই সংবিধানে দেশটি ইসলামি নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে মর্মে উল্লেখ থাকায় এবং তা সংবিধানের মৌলিক চরিত্র হওয়ার কারণে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও বিভিন্ন আদিবাসী অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একই দেশের সমঅধিকার বঞ্চিত নাগরিক হিসেবে গণ্য করতেন । খুনি মোস্তাকের ধর্মনিরপেক্ষতা বিবর্জিত নীতি ও পাকিস্তানের সংবিধানের মৌলিক চরিত্র এক ও অভিন্ন । খুনি মোস্তাক পরবর্তী জিয়া, এরশাদ ও জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া সংবিধানে মৌলবাদী, ধর্মাশ্রয়ী মৌলিক অনুভূতিগুলোকে সর্বাত্মক জাগ্রত করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি করেছিলেন। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরো বেশি দৃশ্যমান হয় যখন স্বাধীনতা বিরোধি জামায়াত, বিএনপি ক্ষমতার অংশীদার হয়।

পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ করে তারা পাকিস্তানের আনুকূল্য পায়। এই নীতি পরবর্তীতে সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে । ৭৫ এর এই পরিবর্তনের পর থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনা শক্তিশালী হতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাজনীতির মূল স্রোতে পুনর্বাসিত হয় এবং ক্ষমতার ও কর্তৃত্বের চূড়ান্ত শিখায় তাদের অবস্থান সুসংহত হতে থাকে ।

স্বাধীন বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদীগোষ্ঠী  ইসলামের প্রকৃত চেতনায় নয় বরং বিকৃতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সংবিধান হতে ধর্ম নিরপেক্ষতা নির্বাসিত হওয়ার কারনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার অশুভ বিষ ছড়িয়ে দেয়।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উপরোক্ত দর্শনগত রাজনৈতিক অবস্থান ছিল বিধায় ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির উপর সহিংসতা সংগঠিত হয়েছে । সাম্প্রদায়িক চেতনায় উন্মাদ নির্যাতনকারীরা প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ভোট প্রদানের জন্য অভিযুক্ত করে নির্যাতনের তাণ্ডবলীলায় লিপ্ত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতায় সহিংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে বিতাড়িত করে ভোট সংখ্যা হ্রাস এবং হুমকী ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে  ভোট দান থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে ভোটের ভারসাম্য বিনষ্ট করার অপচেষ্টাও করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগে মানবাধিকার রক্ষা করার অঙ্গীকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা রোধ এবং কোনও বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ণ রোধ করার বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে ।

অনুচ্ছেদ ২৭ এ উল্লেখ আছে যে দেশের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮ এ বর্ণিত মতে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠি, বর্ণ, নারী, পুরুষভেদে বা জন্ম স্থানের কারণে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র  বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।

৩২ অনুচ্ছেদে আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনও নাগরিককে বঞ্চিত করা যাইবে না মর্মে উল্লেখ আছে।

সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদ সমূহে বর্ণিত নীতি অনুযায়ী সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতরূপে সংরক্ষিত হয়েছে।  একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাগত।  সংবিধানের বিধান অনুযায়ী স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, ভয়ভীতিমুক্ত নির্বাচন পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করাই স্বাভাবিক।

পুলিশ প্রশাসন এবং আইন  প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনপ্রশাসনের নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার বিষয়টি সাংবিধানিক দায়।  কাজেই প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় ও সময় উপযোগী আইনানুগ প্রশাসনিক উদ্যেগই জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশের সকল ভোটারকে নিরাপদ, সহিংসতা ও শঙ্কামুক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।  অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে জাতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও শঙ্কামুক্ত নির্বাচন প্রত্যাশা করে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে দৃঢ় ও আন্তরিক। গণতন্ত্রের এই অগ্রযাত্রাকে সমুন্নত রাখতে হলে জঙ্গিবাদমুক্ত  অসম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িকতা সার্বজনীন ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে অন্তরায়।